নামে কুয়াকাটায় নারিকেল বাগান, ঝাউবন, ইকোপার্ক, লেম্বুরবন, গঙ্গামতি, চর-গঙ্গামতি বনাঞ্চল থাকলেও বাস্তবে তা এখন প্রায় বিলীনের পথে। একদিকে সমুদ্রের তাণ্ডবে বিলীন, অন্যদিকে বনের গাছ কেটে উজাড় করার কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলের কয়েক লাখ মানুষ।
স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রভাবশালীদের তাণ্ডব আর বনের গাছ কেটে উজাড় করার বিষয়ে প্রশাসনের নীরবতায় বড় বড় গাছ এখন অতীত। তবে লোকবল সংকট ও জীবনের নিরাপত্তায় এগুলো আটকানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
সম্প্রতি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের লেম্বুরবন, গঙ্গামতি, চর গঙ্গামতী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বনের ভেতর পড়ে রয়েছে গাছের ডালপালা। মূল গাছের অংশ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে এগুলো কে বা কারা কেটেছে সে খবর নেই প্রশাসনের কাছে।
চর-গঙ্গামতি এলাকার বনাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, এক স্থান থেকেই কেটে নেওয়া হয়েছে কয়েকশো ঝাউ গাছ, যার গোড়ার অংশ পড়ে আছে, আর ডালপালা শুকিয়ে রয়েছে। প্রশাসন এর খবর না জানলেও স্থানীয়রা জানায়, বঙ্গোপসাগরের অবৈধ বেহুন্দী জাল দিয়ে মাছ শিকার করতে জেলেরা এই ঝাউ গাছ কেটে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে।
‘আমরা গাছ কাটি না, ডালপালা কেটে জালের খুঁটা বানাই। আর এগুলো কাটার আগে এখানে ফরেস্টার আছে জাকির স্যার। স্যার ডালপালা কাটতে কইছে, গাছ কাটতে নিষেধ করেছে।’
গত ৪ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে গঙ্গামতি এলাকার লেকের পাড়ে ৯ জন জেলে প্রায় অর্ধশতাধিক ঝাউগাছসহ বিভিন্ন গাছ দিয়ে খুঁটি তৈরি করে একটি মাছ ধরার ট্রলারে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এমন সময় তাদের মধ্যে মো. সোবহান মাঝি নামের এক জেলেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমরা গাছ কাটি না, ডালপালা কেটে জালের খুঁটা বানাই। আর এগুলো কাটার আগে এখানে ফরেস্টার আছে জাকির স্যার। স্যার ডালপালা কাটতে কইছে, গাছ কাটতে নিষেধ করেছে।’
এক সময় এই বনে ঝাউগাছ, রেইনট্রি, আকাশমনি, জাম, রাম তিতুল, কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, শালসহ বিভিন্ন প্রকার গাছের দেখা মিললেও এখন ঝাউগাছ ছাড়া মিলছে না তেমন কোনো গাছের দেখা। আর এই বন ধ্বংস হওয়ার কারণে শঙ্কায় রয়েছে স্থানীয়রা।
আরও পড়ুন-
- উপকূলীয় মানুষের জ্বালানির জন্য ভরসা সমুদ্রে ভেসে আসা সুন্দরী ফল
- উদ্বোধনের আগেই সমুদ্রে বিলীন ৫ কোটি টাকার মেরিন ড্রাইভ
- সমুদ্রে বিলীন হচ্ছে কুয়াকাটা সৈকত, রক্ষার দাবি স্থানীয়দের
স্থানীয়রা জানায়, বছরে বেশ কয়েকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয় এই উপকূলীয় এলাকায়। আর উপকূলে এই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের প্রাণ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই সংরক্ষিত বন। যার অন্যতম সাক্ষী বিগত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বড় বড় ঘূর্ণিঝড়।
‘এখন পর্যন্ত যতগুলো বন্যা হয়েছে, তার সবগুলো বন্যায় উপকূলের রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করেছে এ বিশাল বন। তবে এখন বেশিরভাগ বিলীন হয়ে গেছে, এখন জোয়ারের পানিও বন ভেদ করে লোকালয়ের দিকে চলে আসে। বড় বন্যা হলেতো আর আমাদের রক্ষা নেই।’
কুয়াকাটা এলাকার হোসেন পাড়ার বাসিন্দা আ. মোতালেব (৫৫) বলেন, আমরা সাগর পাড়ের মানুষ। আমাদের জীবন, পরিবার সবকিছুই সমুদ্রকে কেন্দ্র করে। এখন পর্যন্ত যতগুলো বন্যা হয়েছে, তার সবগুলো বন্যায় উপকূলের রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করেছে এ বিশাল বন। তবে এখন বেশিরভাগ বিলীন হয়ে গেছে, এখন জোয়ারের পানিও বন ভেদ করে লোকালয়ের দিকে চলে আসে। বড় বন্যা হলেতো আর আমাদের রক্ষা নেই। আমরা চাই যাতে কেউ এই বনটা ধ্বংস না করে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
দক্ষিণ মুসল্লীয়াবাদ গ্রামের বাসিন্দা মো. হযরত আলী বলেন, বনের গাছ কে কখন কাটতো এর খবর জানত সদ্য বদলি হওয়া মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ। শুধু বন নয়, বনের মাটি বিক্রি করেও কোটি টাকার মালিক হয়েছে সে।
সৈকতের ভাঙন ঠেকাতে আর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৫ সালে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে কুয়াকাটা ইকোপার্ক নির্মিত হয়। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর পার্কটিকে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান নামকরণ করা হয়। তবে ১৪ বছরে সেই উদ্যানটি বিলীন হয়ে গেছে। কিছু অংশ বাকি থাকলেও গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। অনেক সময় সমুদ্রে ভাঙনের ফলে গাছের গোড়া থেকে বালুক্ষয় হলে গাছ হেলে পড়ে, সেই গাছগুলো নিলাম কিংবা কেটে নেওয়ার নিয়ম না থাকলেও তা কেটে নিয়ে যায় দিনে দুপুরে।
উপককূল পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের (উপরা) আহ্বায়ক কেএম বাচ্চু বলেন, গঙ্গামতিসহ অত্র এলাকার সংরক্ষিত বন ধ্বংস হলে শুধু গাছই নয়, উপকূলের প্রাকৃতিক ঢালও ধ্বংস হবে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় এই বনই ঢেউয়ের আঘাত ঠেকায়। সরকার যদি এই বনখেকো আর প্রশাসনের দিকে নজর না দেয়, তাহলে হুমকিতে পড়তে পারে পরিবেশ, বিলীন হবে বিশাল এই বনাঞ্চল। এতে ঝুঁকিতে পড়বে উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। নষ্ট হবে পর্যটনের বড় সম্ভাবনা। তাই বন রক্ষায় প্রশাসনের দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
‘সরকার যদি এই বনখেকো আর প্রশাসনের দিকে নজর না দেয়, তাহলে হুমকিতে পড়তে পারে পরিবেশ, বিলীন হবে বিশাল এই বনাঞ্চল। এতে ঝুঁকিতে পড়বে উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। নষ্ট হবে পর্যটনের বড় সম্ভাবনা।’
এ বিষয়ে বর্তমান মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা কে এম মনিরুজ্জামান বলেন, আমি মাত্র ২ মাস হলো এখানে দায়িত্ব নিয়েছি, বিভিন্ন স্থানে যে ঝাউগাছগুলো কাটা হয়েছে এগুলো আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুর্বৃত্তরা কেটেছে। আমাদের লোকবল কম থাকায় অনেক সময় অভিযানে বেগ পেতে হয়। এমনকি আমাদের নিজেদের জীবন নিয়েও শঙ্কা, অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকিও থাকে। আমরা এরইমধ্যে বেশ কয়েকাটি মামলা দিয়েছি, যার কার্যক্রম চলমান।
অভিযোগের বিষয়ে মহিপুরের সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি পাঁচ মাস আগে রাঙ্গাবালী রেঞ্জের দায়িত্ব নিয়েছি। মহিপুরে থাকাকালীন মাটিকাটা এবং বন কাটার অভিযোগে ১৪টি মামলা করেছি। দশটি মাটিকাটা ট্রাক জব্দ করেছি, যার মধ্যে চারজনকে জেলে পাঠিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে যে টাকা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এ বিষয়ে কথা বলতে পটুয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান মিঞাকে বেশ কয়েকদিন ফোন করা হলেও তাকে পাওয় যায়নি। এমনকি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
এফএ/এমএস