উন্নয়নের আড়ালে উপেক্ষিত যাদের জীবন

5 hours ago 5

রবিউল আওয়াল পারভেজ

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিগত দেড় দশক মানুষ নানাভাবে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অপমানিত, অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, মতামত বিভিন্নভাবে প্রকাশ করছে। এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার খুব বেশি সফল না হলেও সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, এবার হয়তো দেশের সার্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। সর্বোপরি তাদের দুর্ভোগ কমবে এবং জীবন মানের উন্নতি হবে।

এতক্ষণ যেসব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ও প্রত্যাশার কথা বললাম, মোটাদাগে তারা মূলত সবাই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির। এই তিন শ্রেণির মানুষ নিয়েই আমাদের সমাজ। আমরা মূলত তাদের নিয়েই কথা বলি, দেশের সরকারও তাদের আকাঙ্ক্ষাকেই কম-বেশি গ্রাহ্য করে। কিন্তু আমাদের দেশে তিনটি শ্রেণি ছাড়াও বিশেষ একটি শ্রেণি রয়েছে, তাদের নিয়ে না দেশের সরকার চিন্তা করে, না সাধারণ মানুষ চিন্তা করে। তারা আমাদের সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই শ্রেণির মানুষদের হয়ে কেউ কথা বলার নেই, তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। আছে শুধু তাদের হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। তবে তা কখনো কর্তাব্যক্তিদের কর্ণে গিয়ে আঘাত হানে না।

আমি বলছি, দেশের হাজার হাজার কিংবা লাখ লাখ ছিন্নমূল মানুষের কথা। জনশুমারি ও গৃহ গণনা-২০২২ এর তথ্যমতে, সারাদেশে ২২,১১৯ জন ছিন্নমূল বা গৃহহীন মানুষ রয়েছে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার তথ্যমতে, শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ৫০ হাজার ছিন্নমূল মানুষের বসবাস। অপরদিকে বিভিন্ন সংস্থার মতে, সারাদেশে শুধু পথশিশুর সংখ্যাই ১০ থেকে ১৫ লাখ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, ছিন্নমূল মানুষের সঠিক সংখ্যাটি আসলে কত, তা আমাদের জানা নেই। সেটা না জানা থাকলেও সংখ্যাটা বেশ বড়, সেটা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

দেশে সরকার আসে সরকার যায়, নতুন বাজেট ঘোষণা করা হয় কিন্তু এসব ছিন্নমূল মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। তাদের রাস্তার ফুটপাতে রোদে পুড়তে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়, শীতে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়। দুবেলা দুমুঠো পেট পুরে খাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করেও কোনো লাভ হয় না।

পথশিশুরা শিক্ষা-দীক্ষা থেকে বহুদূরে, প্রায় সবাই অপুষ্টিতে ভোগে, বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা সঞ্চারিত হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রের যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। রাষ্ট্র শুধু তাদের নিয়েই চিন্তা করে; যাদের ঘরবাড়ি আছে, পরনে পোশাক আছে, দুবেলা দুমুঠো খাবার আছে, যারা অসুস্থ হলে স্বল্পোন্নত বা উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেন; রাষ্ট্র শুধু তাদেরই জীবনমান উন্নয়নের কথা ভাবে। যাদের ইতোমধ্যেই ‘জীবন মান’ রয়েছে।

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। তবে বাংলাদেশেরই এক শ্রেণির মানুষের জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণ (অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা) নেই। পূরণ হচ্ছে না তাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার- সেই নিয়ে কারো কোনো জোরালো আলাপ নেই।

কিন্তু দেশের অন্য মানুষের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে আমরা বেশ সরব, বিষয়টি রীতিমত একচোখা। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে বছরের পর বছর ধরে এই অবহেলিত ছিন্নমূল মানুষগুলোকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা আবশ্যক। কিন্তু হতাশার কথা, তারা সরকারের আলোচনা ও পরিকল্পনা পরিমণ্ডলের বাইরে অবস্থান করে!

কোনো সরকারই ছিন্নমূল মানুষকে নিয়ে চিন্তা করে না। তার কারণ হয়তো তারা জানে, ছিন্নমূল মানুষেরা তাদের গদিতে টিকিয়ে রাখার বা গদি থেকে নামিয়ে ফেলার কেউ নয়। বিগত বছরগুলোতে সরকার শুধু তাদের নিয়েই মত্ত ছিল, যাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারলে গদিতে পাকাপোক্তভাবে থাকা সম্ভব নয়। এখনো আমরা দেখছি, গণমানুষের আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনা সরকার উচ্ছেদের পর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে; এই সরকারও ছিন্নমূল মানুষদের কথা বাদ দিয়ে শুধু গৃহী মানুষের কথাই চিন্তা করছে। পূর্ববর্তী সরকারের চিন্তার জগতের চেয়ে বর্তমান সরকারের চিন্তার জগতে সাধারণ জনগণের উপস্থিতি বেশি। তবে পূর্বের ন্যায় বর্তমান সরকারের চিন্তার জগতে ছিন্নমূল মানুষেরা এখনো অনুপস্থিত। যদিও সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকায় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ভাষণে বাংলাদেশের ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গঠন ও মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা বলেছেন। তবে যেখানে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় মানবেতর জীবনযাপন করছে; সেখানে বাংলাদেশে কী করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে, তা মোটেও বোধগম্য নয়।

ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে অনেকে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র সংগ্রহ, ফুল বিক্রি, হকারি, ভিক্ষা করলেও অনেকে আবার চুরি, পকেটমার, ডাকাতি, মাদক বিক্রিসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িত। অপকর্মের সাথে জড়িত থাকলেই যে তাদের নিয়ে আমাদের সহানুভূতি থাকা উচিত না, তা নয়। তারা অভাবের তাড়নায় এসব অপকর্ম করে। এই অপরাধের আরেকটি কারণ হলো মানবেতর জীবনযাপনের ফলে তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি না হওয়া। তারা কোনো অপরাধ করলে অবশ্যই শাস্তি পাবে কিন্তু আমাদের এই বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে; তারা কেন অপরাধ করছে, তাদের অপরাধ করার পেছনের কারণগুলো আসলে কী।

আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, দেশের সব মানুষের মৌলিক চাহিদা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে বিগত কোনো সরকারই সেটা করেনি, বর্তমান সরকারকেও সেরকম কোনো প্রচেষ্টা নিতে দেখছি না। অন্তবর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমরা জানি, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে হিমালয় পর্বতসম দায়িত্ব এবং সময় অতি সংক্ষেপ। তাদের পক্ষে, দেশের সব বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বিগত কোনো সরকার ছিন্নমূল মানুষের জন্য বিশেষভাবে কখনো চিন্তা করেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, সেই জায়গায় পরিবর্তন আনা এবং ছিন্নমূল মানুষের জন্য অন্ততপক্ষে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করা। যাতে পরবর্তী দলীয় সরকারও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ প্রশমনে অন্তর্বর্তী সরকারের দেখানো পথেই এগোয়। একবার একটি পথ ধরে চলতে শুরু করলে সেই পথ যদি সরাসরি গন্তব্যে না নিয়েও যায়; তবুও সেই পথই গন্তব্যে যাওয়ার পথ বাতলে দেয়।

আপাতত সারাদেশে ছিন্নমূল মানুষের সঠিক সংখ্যা হিসাব করা এবং সে অনুযায়ী বাসস্থানসহ জীবন ধারণের জন্য মৌলিক উপকরণ প্রদানের পাশাপাশি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে কাজ শুরু করা উচিত। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ঢাকাসহ অন্য যে বিভাগীয় শহরগুলোতে এত সংখ্যক মানুষের স্থান সংকুলান হবে না, সে ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক মানুষকে শহরে আবাসন ও কাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে যেসব গ্রাম কম ঘনবসতিপূর্ণ সেখানে তাদের আবাসন নিশ্চিত করতে হবে। জীবিকা হিসেবে সেখানে দিনমজুরের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি তাদের স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। কাজগুলো হতে পারে হাঁস-মুরগির খামার, পুকুরে মাছ ও কাঁকড়া চাষ, দর্জির কাজ ইত্যাদি।

এটি স্বীকার্য যে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণ, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করণ, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নতি ও বিভিন্ন সংস্কারের পাশাপাশি ছিন্নমূল মানুষের জীবন ধারণের জন্য মৌলিক উপকরণ প্রদান ও সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ পুরোপুরি সম্ভব হবে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে এটি লাখ লাখ ছিন্নমূল মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের অনুকূলে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এএসএম

Read Entire Article