বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে বর্তমানে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে যাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ ক্ষেত্রিভিত্তিক পদ নির্ধারিত এবং সেই পদ সোপান ধরে তাদের পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে। সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যে কর্মকর্তা আজ যোগদান করেন, তিনি জানেন একদিন তার পুলিশের শীর্ষ পদ আইজিপি পর্যন্ত হবার সুযোগ রয়েছে। তেমনি একজন সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী নবীন কর্মকর্তার লক্ষ্য থাকে তিনি একদিন নিজ বিভাগের শীর্ষ পদ অর্থাৎ প্রধান প্রকৌশলী হবেন। প্রশাসন ক্যাডারও তার ব্যতিক্রম নয়। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে যে নবীন কর্মকর্তা প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন তিনিও একদিন একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব হবার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সম্প্রতি প্রশাসনের ৫ গ্রেডের পদ উপসচিব নিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরোধ পরিষদের ব্যানারে প্রশাসন বাদে বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন উপসচিব পদটি সকল ক্যাডারের সদস্যদের জন্য উন্মুক্ত করে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের জন্য আন্দোলন করছেন। কাগজে-কলমে ২৫ ক্যাডারের সংগঠন বলা হলেও বাস্তবে ৩/৪ টি ক্যাডারের সদস্যবৃন্দ এই ফোরামে অধিক সক্রিয়। তাদের যুক্তি হলো উপসচিব কোন নির্দিষ্ট ক্যাডারের পদ নয়, এটি সরকারের পদ তাই সিভিল সার্ভিসের যে কোন ক্যাডারের কর্মকর্তা এই পদে নিয়োগ লাভের সমান অধিকার রাখেন। তবে কিসের ভিত্তিতে তারা এই দাবি করেন সে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।
উপমহাদেশে সিভিল সার্ভিসের জন্ম ব্রিটিশদের হাত ধরে ১৮৫৮ সালে যাকে বলা হতো ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা আইসিএস। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তদানীন্তন পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিসকে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের নাম হয় সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান যাদেরকে আমরা সিএসপি হিসেবে জানি; আর পূর্বপাকিস্তানের প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের নামকরণ করা হয় ইস্ট পাকিস্থান সিভিল সার্ভিস বা ইপিসিএস। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে এই প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সার্ভিসে থাকা বাঙালি অফিসারদেরকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী কর্মবিভাগ নির্মানের জন্য ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এবং পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রী প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দ্যা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এন্ড সার্ভিসেস রিঅর্গানাইজেশন কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে সার্ভিসেস (রিঅর্গানাইজেশন এন্ড কন্ডিশন্স) অ্যাক্ট, ১৯৭৫ পাশ করা হয় যার মাধ্যমে সরকার কর্মবিভাগ গঠনের ক্ষমতা পায়।
অভিযোগ রয়েছে যে প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ চৌধুরির নেতৃত্বাধীন কমিটি অনেকটা বিদ্বেষপ্রসূত আর অনেকটা জনতুষ্টিবাদিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিভিল সার্ভিসের মূলধারার (অর্থাৎ ভূতপূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) অভিজাততা খর্ব করার নামে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সিভিল সার্ভিসকে অবদমিত করতে কৌশলে অন্য অনেকগুলো সার্ভিসকে একই কাতারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন বিভাগ ভিত্তিক পেশাগত সার্ভিসগুলো পাবলিক সার্ভিস হিসেবে গণ্য হবার কথা থাকলেও সবাইকে সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত করা ছিল বাংলাদেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থার একটি ঐতিহাসিক ভুল। আজকের দিনে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নামে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে আমরা যে অসন্তোষ দেখি মূলতঃ তার সূত্রপাত হয় এই কাজের মাধ্যমে। পে এন্ড সার্ভিসেস কমিশন, ১৯৭৭ এর প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে সামরিক বাহিনীর বাইরের সকল সার্ভিসকে সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়। এক পর্যায়ে বেসামরিক প্রায় সকল বিদ্যমান সার্ভিসকে সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশে ৩০ টি পর্যন্ত ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করা।
অভিযোগ আছে, সত্তোরের দশকে বিভিন্ন কমিটি/কমিশন সংস্কারের নামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সিভিল সার্ভিসের মূল ধারাকে অবমূল্যায়ন করার লক্ষ্যে অত্যন্ত সুকৌশলে এই কাজটি করা হয়। পে এন্ড সার্ভিসেস কমিশন, ১৯৭৭ এর সুপারিশের আলোকে ১৯৭৯ সালে যথাযথ গবেষণা বা পরিকল্পনা ছাড়াই সিনিয়র সার্ভিসেস পুল (এসএসপি) আদেশ জারি হয়। সেই আদেশ আনুযায়ী সকল ক্যাডারের মধ্যে সরকারী কর্মকমিশনের মাধ্যমে উন্মুক্ত পরীক্ষা এবং পরিকল্পিত অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে উপসচিব পদে নিয়োগ দানের বিধান রাখা হয়। আর এর মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় উপসচিব পদ সংক্রান্ত আজকের এই বিতর্ক।
এসএসপি আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব এই সবগুলো পদকে পুলভুক্ত করা হয়; অর্থাৎ এই পদগুলো কোনো নির্দিষ্ট ক্যাডারের পদ হিসেবে বিবেচিত হবে না বরং সিনিয়র সার্ভিস পুলভুক্ত সরকারের পদ হিসেবে গণ্য হবে যেখানে সকল প্রথম শ্রেণির সার্ভিস থেকে কর্মকর্তাগণ পরীক্ষার মাধ্যমে পুলভুক্ত হয়ে নিয়োগ লাভের সুযোগ পাবেন। কিন্তু ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এই পুলভুক্তকরণ পরীক্ষার সিলেবাস নির্ধারণ এবং অন্যান্য পদক্ষেপ কী হবে সে সংক্রান্ত কোন নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভুতভাবে কোনো প্রকার পরীক্ষা ছাড়াই প্রশাসন ক্যাডারের বাইরের অনেককে উপসচিব পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিতর্কিত এই আদেশের মাধ্যমে ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রশাসন সার্ভিসের বাইরের কর্মকর্তারা উপসচিব হবার সুযোগ পান। বৃটিশ শাসন আমল থেকে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) এর কর্মকর্তাগণ মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সচিব পদগুলোতে দায়িত্ব পালন করতেন। পাকিস্তান আমলে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) এর কর্মকর্তাগণ মাঠ পর্যায়ে সহকারি কমিশনার থেকে সচিব পর্যন্ত সকল পদের ৬৬% পদন্নোতি প্রাপ্ত হতেন। অবশিষ্ট ৩৪% পদে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (ইপিসিএস) এবং ওয়েস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (ডব্লিউপিসিএস) এর প্রাদেশিক সার্ভিসের কর্মকর্তাগণ পদোন্নতি লাভ করতেন। এই তিনটি সার্ভিসের বাইরে অন্য কোন সার্ভিসের কেউ কখনোই উপসচিব বা তদুর্ধ্ব পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হতেন না।
পরবর্তীতে এসএসপি আদেশের আলোকে সরকার কম্পোজিশন এন্ড ক্যাডার রুলস অব ১৯৮০ প্রণয়ন করে যেখানে উপসচিব, যুগ্মসচিব এবং তদুর্ধ্ব পদগুলোকে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে রাখা হয়। এই রুলস এর উপর ভিত্তি করেই আজ ২৫ ক্যাডারের নেতৃবৃন্দ দাবি করেন যে উপসচিব প্রশাসন ক্যাডারের পদ নয়। কিন্তু বাস্তবে ১৯৮৯ সালে এসএসপি আদেশ বাতিল হবার সাথে সাথেই কম্পোজিশন এন্ড ক্যাডার রুলস অব ১৯৮০ এর সংশ্লিষ্ট অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার কার্যকারিতা হারায় যার ফলে সরকার পরবর্তীতে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) গঠন ও ক্যাডার আদেশ, ২০২৪ জারি করে। জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেই এই কাজটি আরও আগে করা গেলে আজকের এই অহেতুক বিতর্ক অনেকাংশে এড়ানো যেত। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে এসএসপি আদেশের মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারের ৫ম গ্রেডের পদ উপসচিব কে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলেও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা কোন পদ সোপান ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়নি। কম্পোজিশন এন্ড ক্যাডার রুলস অব ১৯৮০ তে ডেপুটি কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার এই পদগুলোকে প্রশাসন ক্যাডারের পদ দেখানো হলেও বাস্তবে ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক হিসেবে একজন কর্মকর্তার পদায়ন লাভের পূর্বশর্ত হলো উপসচিব পদ মর্যাদা এবং একইভাবে বিভাগীয় কমিশনার হতে গেলে একজন কর্মকর্তাকে কমপক্ষে যুগ্মসচিব হতে হয়।
প্রকৃতপক্ষে এসএসপি আদেশ, ১৯৭৯ বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন ছিল প্রশাসন ক্যাডার বিলুপ্ত করা! কারণ প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলোকে পুলভুক্ত করার ফলে ৬ষ্ঠ গ্রেডের উপর তাদের জন্য আর কোন পদ অবশিষ্ট ছিল না। একটি ক্যাডারের নিজস্ব শীর্ষ পদ যদি ৬ গ্রেডের (সিনিয়র সহকারী সচিব) হয় এবং এর উপরে আর কোন লাইন পোস্ট না থাকে তাহলে সেটি আর ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে না। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডার বিলুপ্ত করা হলে মাঠ প্রশাসন ছাড়া সরকার পরিচালনা একটি অসম্ভব বিষয় হয়ে দাঁড়াবে বিবেচনায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। চলমান ২৫ ক্যাডারের আন্দোলনকারীদের অনেকে আবার নতুন করে প্রশাসন ক্যাডার বিলুপ্তির করে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে ডিসি, ইউএনও এসব পদে নিয়োগ দেয়ার দাবি করছেন। মূলতঃ এমন বাস্তবতা বিবর্জিত দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জনপ্রশাসন তথা মাঠ প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকার ফসল। প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা চাকরির শুরু থেকেই বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে আইন ও প্রশাসন কোর্সসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারি কমিশনার (ভূমি) এসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে নিজেকে মাঠ প্রশাসনের আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সুযোগ পান। বিশেষ করে জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা এবং ইতোপূর্বে মাঠ প্রশাসনে কাজ করে সুনাম অর্জনের বিষয়গুলো অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পর্যালোচনা করা হয়। শুধুমাত্র কিছু প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পড়াশোনা করিয়েই একজন কর্মকর্তাকে এসব পদে দায়িত্বপালনের উপযুক্ত করে ফেলা অসম্ভব। একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন দক্ষ প্রশাসক তৈরি হন যিনি রাষ্ট্র পরিচালনার সার্বিক আইন-কানুন এবং বিধি-বিধান সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা রাখেন।
সিনিয়র সার্ভিস পুল (এসএসপি) আদেশের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জটিলতা এবং এর কার্যকারিতা ব্যর্থ প্রমাণিত হলে ১৯৮৯ সালে এসআরও-২৬১ আদেশবলে সরকার তা বাতিল করে। সিনিয়র সার্ভিস পুল বাতিল হবার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশিত ছিল পূর্বের ন্যায় সকল উপসচিব পদ প্রশাসন ক্যাডারের পদ হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে নিয়ম বহির্ভুতভাবে বিভিন্ন ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বৈধতা দিতে এখানে অন্যদের জন্য একটি সুযোগ রাখা হয়। এসআরও-২৬১ অনুযায়ী ওই সময়ের ৩৭৭ টি উপসচিব পদের মধ্যে প্রশাসন এবং সচিবালয় ক্যাডারের জন্য ৩০২ টি এবং অন্যান্য সকল ক্যডারের জন্য ৭৫টি উপসচিব পদ সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৯২ সালে প্রশাসন ক্যাডার এবং সচিবালয় ক্যাডার একীভূত হয় যার ফলে ৩০২ টি উপসচিব পদের সবগুলো প্রশাসন সার্ভিসের পদ হিসেবে স্বীকৃত হয়। বিতর্কিত এবং অযৌক্তিক এসএসপি আদেশ বাতিল হলেও এর দ্বারা যে বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছিল তার পরিণাম আমরা আজও ভোগ করছি। আমাদের আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরোধ পরিষদের নামে কয়েকটি ক্যাডারের নেতৃবৃন্দ উপসচিব পদ কে সকল ক্যাডারের পদ হিসেবে যে দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছেন তার প্রধান ভিত্তি এই বিতর্কিত এবং বাতিল হয়ে যাওয়া এসএসপি আদেশ।
১১.০২ ১৯৯৮ তারিখে তৎকালীন সরকার এসএসপি আদেশ বাতিল সংক্রান্ত এসআরও-২৬১ প্রজ্ঞাপনের ৬ দফা অনুসারে উপসচিব পদে সাবেক সচিবালয় ক্যাডারসহ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭৫% এবং অন্যান্য সকল ক্যাডারের জন্য ২৫% কোটা সংরক্ষণ করে পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এই নীতিমালার মাধ্যমে শতবছর ধরে প্রচলিত প্রশাসন ক্যাডারের পদে প্রশাসন সার্ভিসের ২৫% অফিসারকে বঞ্চিত করে তাদের জায়গায় অন্যদের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়। এই ব্যবস্থা প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বৈষম্যমূলক হলেও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ পেশাদারিত্বের খাতিরে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। অপরদিকে অন্যান্য ক্যাডারের ৫ জন কর্মকর্তা ইতোপূর্বে বাতিল হয়ে যাওয়া এসএসপি আদেশের আলোকে শতভাগ উপসচিব পদে সবার মধ্য থেকে পদোন্নতি প্রদানের দাবি করে ১৯৯৮ সালে সরকার কতৃক প্রণীত নীতিমালাকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০১০ সালে মাননীয় সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ বেশ কিছু চমৎকার পর্যবেক্ষণ দিয়ে সরকার প্রনীত প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৭৫% এবং অন্যান্যদের জন্য ২৫% নীতিমালাকে বৈধ ঘোষণা করে মামলাটি নিষ্পত্তি করে। আপীল বিভাগ তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন ঐতিহাসিকভাবে সচিবালয়ের উপসচিব এবং উর্ধতন পদগুলো প্রশাসন সার্ভিসের পদ। আদালত আরও বলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো এসএসপি আদেশের মাধ্যমে সকল সার্ভিস থেকে পিএসসির পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব এবং উর্ধতন পদে নিয়োগের বিধান করা হলেও বাস্তবে পিএসসির মাধ্যমে কোনদিনই নিয়োগ হয়নি এবং এসএসপি এর মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়; ফলে ১৯৮৯ সালে এসএসপি অর্ডার বাতিল হয়। উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিবগণ মাঠ প্রশাসন এবং নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে বলেও আদালত তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে বর্তমানে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
বর্তমানে স্যোশাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে উপসচিব পদ এবং ৭৫%-২৫% কোটা নিয়ে নানান বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কৌশলে এই কাজটি করছেন আবার অনেকে এর ইতিহাস এবং আইনি বিষয়গুলো না জেনে নানান অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। অনেক জায়গায় বলা হচ্ছে উপসচিব পদে শুধুমাত্র একটি ক্যাডারের জন্য ৭৫% এবং বাকি ২৫ ক্যাডারের জন্য ২৫% কোটার বিধান রাখা বৈষম্যমূলক। বাস্তবে এখানে প্রশাসন ক্যাডারই বৈষম্যের শিকার, কারণ তাদের ২৫% কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে অন্যায্যভাবে অন্যদের উপসচিব পদে পদোন্নতির সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। অন্য ২৫ ক্যাডারের সবার কিন্তু নিজ নিজ ক্ষেত্রভিত্তিক পদ সোপান অক্ষত রয়েছে। অর্থাৎ তাদের সবার হাতে দুটি করে বিকল্প রয়েছে- ডিএস পুলে উপসচিব হওয়া এবং নিজ সার্ভিসের ৫ গ্রেডের পদ থেকে পদ সোপান ধরে উপরের দিকে যাওয়া। অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার পদোন্নতি নিয়ে উপরে উঠার একমাত্র উপায় উপসচিব হওয়া যার আবার ২৫% ইতোমধ্যে অন্যদের জন্য নির্ধারিত। প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা কিন্তু চাইলেই বাকি ২৫ ক্যাডারের সদস্যদের মতো নিজ পদ সোপানের বাইরের কোন পদে গিয়ে পদোন্নতি নিতে পারবেন না। সুতরাং এই ৭৫% কোটা শব্দটি প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে না, বরং তা বিভ্রান্তিকর। উপরন্তু, উপসচিব পদে সকল কোটা বাতিল করে প্রশাসন ক্যাডারের পদ তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। ২০১৮ সালে সরকার সার্ভিসেস (রিঅর্গানাইজেশন এন্ড কন্ডিশন্স) অ্যাক্ট, ১৯৭৫ বাতিল করে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করে। উক্ত আইনের ৫ ধারা অনুসারে সরকারি কর্ম কমিশনের সাথে পরামর্শক্রমে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে সরকার বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) গঠন ও ক্যাডার আদেশ, ২০২৪ জারি করে যেখানে ৮৭৬ উপসচিব পদ বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের পদ হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়। সুতরাং উপসচিব পদটি প্রশাসন ক্যাডারের পদ নয় এমন দাবি আইনগতভাবে সঠিক নয়।
সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ লাভের সময় নিজের পছন্দের ক্রম এবং মেধা তালিকায় মোট প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতে কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন ক্যাডারে ভাগ হয়ে যান। এখানে উল্লেখ্য যে সরকারী কর্ম কমিশন কতৃক সকল সাধারণ ক্যাডারের জন্য একটি এবং প্রতিটি টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য আলাদা আলাদা মেধা তালিকা প্রনয়ণ করা হয়। কারণ সাধারণ ক্যাডার এবং টেকনিক্যাল ক্যাডারের চাকরি প্রার্থীরা অভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নেন না। উদাহরন হিসেবে দেখা যায়- পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক পদের জন্য শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের চাকরি প্রার্থীরাই প্রতিযোগিতা করেন। তাই টেকনিক্যাল ক্যাডারের একটি পদের জন্য প্রতিযোগিতা সাধারণ ক্যাডারের পদের তুলনায় অনেক সীমিত থাকে। সে বিবেচনায় একজন টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তা যাকে একটি সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্ট হিসেবে সীমিত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়; চাকরির মাঝামাঝিতে এসে তাকে ভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী একটি সাধারণ ক্যাডারের পদে বসার সুযোগ করে দেয়া ন্যায় বিচারের পরিপন্থি। তাই, ২৫% ডিএস পুলে অন্য ক্যাডার থেকে প্রশাসন সার্ভিসে প্রবেশের সুযোগ থাকতে পারে কেবলমাত্র সাধারণ ক্যাডারের (পররাষ্ট্র, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্স, আনসার, সমবায়, খাদ্য, পরিবার পরিকল্পনা, নিরীক্ষা ও হিসাব ইত্যাদি) কর্মকর্তাদের যারা সরকারি কর্ম কমিশনের অভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আদেশের পর্যবেক্ষণে এই বিষয়টি উল্লেখ আছে।
তাছাড়া সরকারি জনবল ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বা কাজের গুনাগুণ বিবেচনায় ২৫% কোটায় অন্যান্য ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি প্রদানের যথার্থতা রয়েছে কিনা তা পর্যালোচনা করা দরকার। সাধারণত ১২-১৪ বছর কাজ করার পর প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন। এই সময়ের মধ্যে একজন কর্মকর্তা বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনের নানান বৈচিত্রময় প্রশাসনিক এবং সমন্বয়মূলক কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ লাভ করেন। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় তারা সেই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নীতি প্রণয়নে অবদান রাখেন। কেবলমাত্র প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই মাঠ পর্যায়ে সরকারের প্রায় সকল নীতি বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত থাকেন যা অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসের থেকে আলাদা। কারণ, অন্যান্য সার্ভিসের কর্মকর্তাগণ শুধুমাত্র নিজ বিভাগের কাজের উপর বিশেষায়িত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। যেমন ধরুণ, একজন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা যিনি ১৪/১৫ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র রসায়ন পড়িয়েছেন অথবা একজন চিকিৎসক যিনি সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সেবা দিয়েছেন হঠাৎ করে তাকে উপসচিব বানিয়ে দেয়া হলো। এমন কাজের উভমুখী নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। একদিকে তিনি যে টেকনিক্যাল পদ ছেড়ে যাচ্ছেন সেই সার্ভিস তার এতোদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে, অন্যদিকে উপসচিব হয়ে উনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার কাজ সম্পর্কে তার তেমন কোন ধারণা বা অভিজ্ঞতা নেই। এই ব্যবস্থা দুই দিক থেকেই সরকারের জন্য মেধা এবং অভিজ্ঞতার অপচয়। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ২৫% কোটায় যে কয়জন কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি পাবেন তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা এখানে আসার জন্য প্রতিযোগিতা করেন। ফলে টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ নিজেদের পেশাগত উন্নয়নের ভাবনা বাদ দিয়ে কিভাবে চাকরির মাঝামাঝি সময়ে গিয়ে উপসচিব হওয়া যায় সেই চিন্তায় মগ্ন থাকবেন। তাই সরকারি কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কারিগরি পেশাসমূহসহ সকল পেশার উৎকর্ষ সাধনের জন্য এই ২৫% ডিএস পুল প্রথা একটি অন্তরায়।
বর্তমান সময়ের আরেকটি আলোচিত বিষয় ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য’ প্রসঙ্গ। এই শব্দদ্বয়ের মধ্যে একটি ধারণাগত ত্রুটি রয়েছে। মূলত বৈষম্যের বিষয়টি বিবেচনা করতে হয় একই শ্রেণিভুক্তদের মধ্যে। দুটি ভিন্ন শেণিভুক্ত দলের সদস্যদের মধ্যে 'বৈষম্য' শব্দটি প্রযোজ্য হয় না। পিএসসি’র পরীক্ষার সময় নিজের পছন্দ এবং প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতে প্রতিটি ক্যাডার সার্ভিসের সদস্যরা আলাদা আলাদা শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যান। সাধারণত বিসিএস পরীক্ষায় মেধাতালিকায় সামনের দিকে থাকা চাকরি প্রার্থীরাই প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র এসব সাধারণ ক্যাডারে যোগদান করে থাকে। চাকরি জীবনের মাঝখানে এসে শিক্ষার্থীদের মতো পরীক্ষা নিয়ে পদোন্নতির বিধান করা অযৌক্তিক। এই ব্যবস্থা চালু করা হলে একদিকে যেমন একজন কর্মকর্তার দীর্ঘ চাকরি জীবনে সম্পাদিত কাজ এবং অর্জিত সুনামকে অবমূল্যায়ন করা হবে, অন্যদিকে কাজ বাদ দিয়ে সবাই পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করলে জনসেবা বিঘ্নিত হবে। পৃথিবীর কোন দেশে সিভিল সার্ভিসের সিনিয়র পদে এভাবে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ বা পদোন্নতি প্রদানের বিধান নেই। তাই, বৈষম্য দূর করার নামে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে উন্মুক্ত পরীক্ষা গ্রহণের যে দাবি করা হচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। যিনি বিসিএস পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়ে নিজের প্রথম পছন্দের ক্যাডার প্রাপ্ত হন, তার সাথে কম নম্বর পেয়ে নিজ ১৩ তম পছন্দের ক্যাডার প্রাপ্ত কর্মকর্তার মধ্যে সরাসরি তুলনা চলতে পারে না। ২০১০ সালে ডিএস পুল সংক্রান্ত আপীল বিভাগের রায়ে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।
সিভিল সার্ভিসের মূলধারা প্রশাসন সার্ভিসকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অবদমিত করার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যেসকল ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, তারই পরিণতি আজকের এই অসন্তোষ। এই বিশাল সংখ্যক সার্ভিসের সবাইকে সিভিল সার্ভিসভুক্ত করে সবাইকে একই কাতারে এনে এই বিসিএস (ৃ) ব্র্যাকেট ক্যাডার ব্যবস্থা চালু করার ফলে এখন সবাই নিজেদের সমান মনে করে একে অপরের সাথে তুলনায় ব্যস্ত। অন্যদিকে একসময়ের বিচার ক্যাডার বর্তমান জুডিশিয়াল সার্ভিসের প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ আলাদা বেতন কাঠামো নিয়ে কোথাও কোন আলোচনা বা তুলনা নেই কারণ তারা এই ব্র্যাকেট ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে তুলনা করার ধরণগুলোও মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। বাস্তবে প্রতিটি ক্যাডার সার্ভিস স্বতন্ত্র ও ভিন্ন, এবং কাজের ধরণের জন্য প্রতিটি ক্যাডারের চাকরির আলাদা সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। প্রায়শই আমরা একজনের সুবিধার সাথে নিজের অসুবিধার বিষয় তুলনা করে মানসিক অশান্তিতে ভোগী। নিজের কী কী সুবিধা আছে যা অন্যদের নেই সেটা খুব একটা ভাবি না। যেমন একজন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা চাইলে যেভাবে নিজ এলাকায় থেকে পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন উপভোগ করতে পারেন, প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে সেই সুযোগ অনেকটাই সীমিত। অন্যদিকে পদোন্নতি, গাড়ি ব্যবহার, বিদেশ ভ্রমণ এসব সুযোগ প্রশাসন-পুলিশ ক্যাডারের ক্ষেত্রে শিক্ষা ক্যাডারের চেয়ে বেশি। আবার একজন চিকিৎসক সরকারি চাকরির পাশাপাশি বৈধভাবেই প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। সাধারণত এসব জেনেই একজন চাকরি প্রার্থী বিসিএস পরীক্ষায় ক্যাডার পছন্দক্রম দিয়ে থাকে। সকল ক্যাডার সার্ভিসের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা বাস্তবিক অর্থেই সম্ভব নয় এবং সেই নিশ্চয়তা চাকরিতে প্রবেশের সময় কাউকে দেয়া হয় না।
আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিস্কার করার চেষ্টা করি। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রশাসন ক্যাডারের তুলনামূলক নবীন কর্মকর্তা হলেও নিজ কর্মক্ষেত্রে একটি বাংলো বাড়ি এবং কোটি টাকা দামের গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পান। সেই একই কর্মকর্তা যখন মাঠ থেকে উঠে ঢাকায় কোন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে সিনিয়র সহকারি সচিব হিসেবে কাজ করেন তখন এসবের কিছুই প্রাপ্ত হন না। এখন অন্য ক্যাডারের একই গ্রেডের একজন কর্মকর্তা ইউএনও সাহেবের এই বাড়ি-গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ দেখে এটিকে বৈষম্য আখ্যা দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাজের ধরণের জন্যেই তাকে এই সুবিধাগুলো প্রদান করা হয়। প্রশাসন ক্যাডারের তার চেয়ে অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা ঐ পদে না থাকলে এই সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হন না। প্রত্যেক ক্যাডার সার্ভিসের সদস্যদের নিজস্ব পেশাগত মান উন্নয়নের সুযোগ যেমন থাকা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন পেশাদার আচরণ। সরকারি চাকরি বিধির প্রতি সকলেরই শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। দেশের অত্যন্ত সম্মানজনক পেশা সিভিল সার্ভিসের অংশ হয়ে যদি আমরা স্যোশাল মিডিয়াতে বা সভা-সমাবেশ করে একে অপরকে আক্রমন করতে থাকি তাতে সাধারণ মানুষের কাছে কারো সম্মান বৃদ্ধি পাবে না। নিজেদের চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কিংবা যৌক্তিক দাবি আদায়ে আমাদের সকলেরই আরও পেশাদার আচরণ করা উচিত।
লেখক : হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী, সিনিয়র সহকারী সচিব। মাস্টার অব ইকনোমিকস এন্ড পাবলিক পলিসি (ডিস্টিংশন), দ্যা ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।