উস্কানির উত্তেজনা ও দূরত্ব সৃষ্টির দায়

12 hours ago 6

বেশ কয়েক মাস ধরে দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের মধ্যে নানা বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিতর্ক চলছে। তার রেশ ধরে গুজব ছড়ানো, উস্কানিমূলক বক্তব্য ও পাল্টা বিবৃতি দেয়ার মাধ্যমে টান টান উত্তেজনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এজন্য ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন অফিসে ত্রিপুরার উচ্ছৃঙ্খল জনতা আক্রমণ চালিয়ে সেটার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। দু’দেশের সরকারী পর্যায়ে একধরনের রাজনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে।

এই টানাপোড়েনের ফলে উভয় দেশের মধ্যে যে আর্থ-সামাজিক ও পারিবেশিক ক্ষয়ক্ষতি তৈরি হচ্ছে তার সিংহভাগ গুজব রটানো, উস্কানিদাতা প্রতিবেশী দেশের ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও সেবাপ্রতিষ্ঠানের হতাশাজনক উক্তি থেকে ক্রমাগত প্রকট হয়ে উঠছে। এই নাজুক অবস্থা ও বাংলাদেশী জনগণের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির দণ্ড তাদেরকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে সেজন্য তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।

গত ৫ আগস্ট ২০২৪ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে বেশ দূরত্ব দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের (ইসকন) মুখপাত্র গ্রেপ্তার ও চট্টগ্রামের সরকারী আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের মৃত্যুতে সেই দূরত্ব আরও বেড়েছে।

বর্তমানে দেশে দেশে কল্যাণকামী মানুষের ছায়ায় তরুণ প্রজন্ম নিজেদের চেতনা ও শক্তি দিয়ে আগলে রাখবে তাদের সুন্দর দেশ ও পৃথিবীটাকে। এজন্য সবাইকে সকল উস্কানিমূলক অস্থিরতা ঝেড়ে ফেলে আঞ্চলিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে ধরে রাখা এখন মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা উচিত।

‘হিন্দু নিপীড়নের’ অভিযোগ তুলে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)। তারা ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ দিল্লীতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। তবে ১৬ ডিসেম্বর কোলকাতায় অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কিছু সৈন্য বাংলাদেশের বিজয় দিবস পালন করেছেন।

অন্যদিকে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ভারতীয় দূতাবাস অভিমুখে প্রতিবাদী পদযাত্রা ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ‘সার্বভৌম কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের শামিল।

ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অবজ্ঞাস্বরূপ... পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের প্রধান ফটক ভেঙে বিক্ষোভকারীদের প্রাঙ্গণে আক্রমণ করার সম্মতি দেওয়া হয়েছিল। এটি কূটনৈতিক নিয়ম এবং আন্তর্জাতিক আইনের একটি গুরুতর লঙ্ঘন। একই সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৬১ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’

ভারতে দীর্ঘদিন যাবত যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তারা প্রতিবেশীদেশের বন্ধুবৎসল নয়। নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ কারো সাথে তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বসুলভ নয়। বিজেপি-র আগে যেসব দল ক্ষমতায় ছিলেন তাদের শাসনামলে এত এত অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ দেখা যায়নি। ভারতের সাথে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, চীন, ভুটান মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা সবার সাথে কেমন সম্পর্ক? সবাই ‘ইন্ডিয়া আউট’কেন করে? ভারতের সব প্রতিবেশী দেশ কি খারাপ?

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের তেমন কোনো সমস্যা নেই। হিন্দুরা বাংলাদেশে সম্পূর্ণ নিরাপদে আছেন যেটা তারা নিজেরাই ব্যক্ত করেছেন। অথচ উল্টো সেসব সন্ত্রাসীরাই বাংলাদেশে কথিত হিন্দু নিপীড়নের অভিযোগ এনে বিচার চায়। যা বড়ই হাস্যকর এবং ন্যাক্কারজনক। যেদিন ইসকন কর্তৃক চট্টগ্রামে একজন সরকারী আইনজীবীকে হত্যা করা হলো সেদিন আমি উত্তরবঙ্গের আমার প্রতিবেশী হিন্দু ভাইয়ের গ্রামে বেড়াতে গিয়ে জেনেছি তারাও কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে ঘৃণা করে। তাদের সাথে জন্ম অবধি পাশাপাশি বসবাস করে আসছি, কখনও কোনোপ্রকার সংঘাত দূরে থাক- মনোমালিণ্যও হয়নি। অথচ, বর্তমানে এসব কট্টর কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এসে গ্রামের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে চিরায়ত শান্তি বিনষ্ট করার পাঁয়তারা করছে বলে জানা গেল। তারা বিভিন্ন উসকানিমূলক ধর্মীয় মেসেজ পাঠিয়ে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে চলেছে।

ভারতের অভ্যন্তরে বিজেপির উগ্রবাদীতার বিপক্ষে অনেকেই সোচ্চার। মমতা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের আঁচ যদি এখানে এসে কেউ আগুন লাগায় তাহলে কিন্তু আগুনটা বিহার অবধি বাদ যাবে না। এর কারণটা হচ্ছে যেহেতু আমরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে জড়িত এবং আমাদের বর্ডার সবারই এক। আমি চাইনা এটা হোক।’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশের ছাত্র জনতার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন ‘তখন তাকে আমরা বাংলার অগ্নিকন্যা,বাংলার বাঘিনী বলে অনেক বাহবা দিয়েছি। কিন্তু এত বেশী গুজব ও উস্কানীতে কান দিয়ে উগ্রপন্থিদের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশ বিরোধিতা শুরু করেছেন। এটা তার চরম ভুল হয়েছে। কারণ, মোদি সমর্থিত মিডিয়ার গুজবের সত্যতা যাচাই না করে তিনি যখন জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশন পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন তো এখন তিনি হয়ে গেছেন বাংলাদেশের কট্টর দুশমন!

কতো দ্বিচারী অবস্থান তার ও তার কিছু উগ্রপন্থি সমর্থকদের।’ তারা সবাই সত্য না জেনে বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানিতে কান দিয়েছেন। ফলে ক্ষতি ইতোমধ্যে তাদের দিকে বুমেরাং হয়ে বাঁক নিয়েছে। বাংলাদেশী ভিসা বন্ধ করে দেয়ায় যারা উগ্রপন্থিদের সাথে হাততালি দিচ্ছিলেন তারাসহ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন পশ্চিম বঙ্গের চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীগণ।

বাংলাদেশে তেমন কিছুই হয়নি যা হয়েছে তা হচ্ছে ভারতের মদদপুষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। এই জন্যই তাদের আঁতে ঘা লেগেছে। কারণ বাংলাদেশের তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার তাদেরকে অনেক অন্যায্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছিলো। এবং এই সুযোগ সুবিধা গুলো এখন বন্ধ হয়ে যাবে। এটা তারা মানতেই পারছেন না। এ জন্যই তারা উস্কানিমূলক প্রপাগান্ডা তৈরি করে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলছে।

একটি পত্রিকা লিখেছে, ‘বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী পাঠানো নিয়ে উনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাকে আমি মনে করি কৌশলগত রাজনৈতিক বক্তব্য (যদিও আমরা বাংলাদেশিরা তা আশা করি না), বিজেপি একচেটিয়া ধর্ম বিদ্বেষী অপপ্রচার চালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ফায়েদা লুটবার অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিলো, আর তৃণমূল কংগ্রেস তা বুঝতে পেরে নিজেদের মাঠ ধরে রাখার জন্য হয়তো ঐ বক্তব্য দিয়েছেন, ...জানামতে পুরো ভারতবর্ষে একমাত্র উনার রাজ্যে সংখ্যালঘুরা(মুসলিম) অনেকটাই শান্তিতে আছে, পশ্চিমবঙ্গে কখনো বিজেপি ক্ষমতায় আসলে তা সংখ্যালঘুসহ আমাদের জন্য খুবই খারাপ হবে।’

ভারত কি শুধু বাংলাদেশের একজনের বন্ধু হয়ে থাকবে? এই একজনের সাথে বন্ধুত্ব শুধু রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের নিমিত্তে করা হয়েছে, চিরদিনের নয়। বাংলাদেশের সকল জনগণের সাথে বন্ধুত্ব হলে সেটা চিরদিনের হতে পারতো। শুধু পলাতক শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য ভারত পাগল হয়ে উঠলে চরম ভুল করবে। নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ নীতি কেন একজন কংগ্রেস সমর্থক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে থাকবে তা অনেকের কাছে বোধগম্য নয়।

বাংলাদেশের উপর অন্যায় আচরণ করলে ভারতের মানুষও বসে থাকবে না। বিশ্লেষকগণ মনে করেন, বাংলাদেশের উপর কোন জুলুম চালানো হলে ভারত ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। তামিল, বঙ্গ, পাঞ্জাব, সেভেন সিস্টার, কাশ্মীর ইত্যাদি কেউই বসে থাকবে না। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতীয় শ্রমিকরা দলে দলে দেশে ফিরতে শুরু করবে। এসব শ্রমিকদের বেকারত্ব ও হতাশার ঢেউ সামাল দেয়া খুব সহজ হবে না। এছাড়া পশতু, কুকিচীন, মণিপুরি, মঙ্গোলীয়ানরাও তাদের মাথার উপর প্রতিনিয়ত বোঝা সৃষ্টি করা সুযোগ খোঁজে। সেটা ভারত সরকার ভালোভাবে জানেন। তাই তাঁকে অপতথ্য পরিহার করে প্রতিবেশীবান্ধব সংযমের নীতিতে ফিরে আসা দরকার। এটা যত দ্রুত মোদি সরকারের বৈদেশিক নীতিতে সংযোজিত হবে ততই আঞ্চলিক শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের কাছে শুরু থেকেই অপছন্দের। কারণ, তারা পলাতক শেখ হাসিনাকে আশ্রয়ে রেখেছেন। যা বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ পছন্দ করছেন না। এজন্য বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা বেড়েই চলেছে। এ সময় ভারত বিরোধিতা বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় মোদি সরকারের ভুল নীতি দায়ী। কারণ, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে হলে কোন একক ব্যক্তি নয়- সবার উপরে দেশ ও দেশের মানুষকে প্রাধান্য দেয়া উচিত।

বিশ্লেষকগণ মনে করেন, দায়িত্বশীল জায়গা থেকে বাংলাদেশের মানুষের মনোভাবকে বুঝতে না পেরে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন না করাই উত্তম, তা না হলে তাকেও হাসিনার মতো পরিণতি ভোগ করতে হবে। বর্তমানে কোনো ধরনের আগ্রাসনকে মেনে নেয় না জেন-জি প্রজন্ম। কোন দেশেই নেয় না। কাশ্মির, ফিলিস্তিন, ইউক্রেন, দক্ষিণ সুদান, পূর্ব তিমুর, কেউ না।

ইতোমধ্যে সংবাদে বলা হচ্ছে, ‘মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তাদের 'ডিপ স্টেট'-এর কিছু শক্তি বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে মিলে ভারতকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আর এখানে 'টার্গেট' দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ..গত দুই দশকে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তবে নানা মতপার্থক্য ও বিরক্তি সত্ত্বেও উভয়েই সম্পর্ক আরও জোরদার করার অঙ্গীকার করেছে। এমন সময় বিস্ফোরক এ অভিযোগ তুললো বিজেপি।’এ অবস্থাকে শক্তভাবে সামাল দিতে হলে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার দরকার।

বাংলাদেশে এখন সেই অর্থে রাজনৈতিক সরকার বা রাজনীতির চর্চা নেই। শুধু কথায় কথায় রাস্তায় দাবি আদায়ের মহরত চলায় শুরু হয়েছে চরম রাজনৈতিক সংকট। সেই সুযোগে বাড়ছে অস্থিরতা। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এর চেয়ে বেশি অশান্ত হয়ে উঠলে এই অঞ্চলের উন্নতি ও অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়বে। এটি আবারো হয়ে উঠবে পৃথিবীর অশান্ত ও চরম দরিদ্র অঞ্চল। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের ক্রমাগত অপপ্রচার ও উস্কানির উত্তেজনা ও দূরত্ব সৃষ্টির দায় একদিন খোদ ভারতকেই নিতে হবে। বর্তমান এআই যুগে এটা কোনো সভ্য দেশের মানুষের কাম্য হতে পারে না।

বর্তমানে দেশে দেশে কল্যাণকামী মানুষের ছায়ায় তরুণ প্রজন্ম নিজেদের চেতনা ও শক্তি দিয়ে আগলে রাখবে তাদের সুন্দর দেশ ও পৃথিবীটাকে। এজন্য সবাইকে সকল উস্কানিমূলক অস্থিরতা ঝেড়ে ফেলে আঞ্চলিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে ধরে রাখা এখন মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা উচিত।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article