এই সরকার দীর্ঘদিন থাকবে না, তাই অনেক কিছু করা সম্ভব না

3 months ago 19

এই সরকারের স্থায়ী কোনো ‘ম্যান্ডেট’ নেই। এই সরকার দীর্ঘদিন থাকবে না। তাই তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব না। তবে সরকার বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছু কিছু পরিবর্তনের গতিমুখ তৈরি করতে পারে। এমন মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

শুক্রবার (২৩ মে) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের মওলানা আকরম খাঁ হলে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি আয়োজিত ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ: কেমন বাজেট চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

আনু মুহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে সরকারকে জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও উদ্ভাবন, প্রশাসনিক দক্ষতা, শিক্ষা ও গবেষণা খাতের উন্নয়নে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। এটি করলে সরকারি হাসপাতালগুলোর আবহাওয়া জাদুর বাক্সের মতো পাল্টে যেতো। যদি তারা সিদ্ধান্ত নিতেন, তাদের সবার সন্তানেরা দেশের সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, তাহলে এসবের চেহারা পাল্টে যেতো। এই সূচনা সরকার খুব সহজে করতে পারতো। গত নয় মাসে সেটি আমরা দেখিনি।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করা। সরকার সেই কাজের দিকে না গিয়ে, অন্যদিকে গিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে তারপর মান-অভিমান করে। এটা তো কোনো গ্রহণযোগ্য কাজ না।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে এরইমধ্যে অনেক দুর্নীতি, অপচয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প আছে। এসব থেকে এই দুই খাতকে মুক্ত করতে হবে। আমরা যে বিদেশি বিনিয়োগ করি, সেটি না করে দেশের বিভিন্ন খাতে জনগণকে প্রশিক্ষিত করতে পারি। তাতে দেশের সম্পদে জনগণের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এছাড়া কয়লা ও পারমাণবিক ধ্বংসাত্মক বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত শুল্ক দিয়ে সৌরশক্তিতে শুল্ক কমাতে হবে। বিদেশি ঋণ বা শর্তাধীন উন্নয়ন নয়, নিজস্ব পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন করতে হবে। শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্বালানি ও সংস্কৃতি খাতে বাজেট বাড়াতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন করতে হবে। কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি কৌশলগত কারণ, যাতে বেসরকারি হাসপাতালে বাণিজ্যটা ভালো হয়। শিক্ষা ও গবেষণা খাতের উন্নয়নে লোকবল সংকট নিরসন করতে হবে। জাতীয় সক্ষমতা না থাকার কারণেই স্যাটেলাইট, মানবিক করিডোর, স্টারলিংক, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের দেশে প্রচুর সম্পদ রয়েছে, কিন্তু সম্পদ নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা নেই।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, বৈদেশিক ঋণের চাপ, প্রযুক্তিনির্ভরতা, খাদ্য নিরাপত্তা ও শ্রমশক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রভাবের মুখোমুখি। দেশকে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের পথে এগোতে হলে কেবল অবকাঠামো নয়, নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নেও স্বনির্ভর হতে হবে।

অর্থবছরের সময় পরিবর্তনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, জুন থেকে জুলাই পর্যন্ত অর্থবছরের কারণে অনেক অপচয় হয়। তাই অর্থবছরকে বাংলা সন হিসেবে এপ্রিল মে অথবা ইংরেজি জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর করার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।

আলোচনা সভায় বাজেটের বিভিন্ন খাত নিয়ে অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, কৃষি বাজেট নিয়ে মাহা মির্জা, সংস্কৃতিক বাজেট নিয়ে সজীব তানভীর, জ্বালানি বাজেট নিয়ে মোশাহিদা সুলতানা ঋতু, শিক্ষা বাজেট নিয়ে সালমান সিদ্দিকী, চিকিংসা বাজেট নিয়ে হরুন উর রশীদ, বৈষম্য ও সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ে কল্লোল মোস্তফা, জেন্ডার বাজেট নিয়ে মারজিয়া প্রভা ও কৌশিক আহমেদ।

বক্তারা বলেন, সরকার সবসময় বাজেট প্রণয়নে রাজনৈতিক স্বার্থ দেখেছে, জনগণের স্বার্থ দেখেনি। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত উপেক্ষা করে নিজেদের রক্ষায় জনপ্রশাসনের বাজেট বেশি দেওয়া হয়েছে। ২০১৮-২৪ ফ্যাসিজমের চূড়ান্তে সবচেয়ে বেশি বাজেট ব্যয় করেছে জনশৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষাতে। ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি ব্যবহার করে লুটপাট-দুর্নীতি করেছে।

তারা বলেন, কৃষিখাতের বাজেটে কোনো সরকারের মনোযোগ নেই। প্রায় ৭ কোটি মানুষ কৃষিতে কর্মসংস্থান করেছেন। অথচ তাদের যথাযথ দাম নেই। বরং কৃষি উপকরণে বহুগুণে দাম বাড়ানো হয়। ফলে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত ও ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। বীজে কম মূল্য, মজুত সক্ষমতা ৫০ লাখ টনে উন্নীত করার কথা জানানো হয়। আওয়ামী আমলে শিক্ষা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কর ও সামাজিক নিরাপত্তা খাত নিয়ে কল্লোল মোস্তফা বলেন, বৈষম্য হ্রাস করার মতো ক্ষমতা থাকা আমাদের দরকার। দেশে প্রবল অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে, রয়েছে বৈষম্য কর। সমান হারে ধনী ও গরীবদের থেকে সমপরিমাণ কর আদায় করছে, যা বৈষম্য। কাঠামোগত রূপ দিয়ে এগুলোর পরিবর্তন করা দরকার। আয় যতই হোক, আগের সরকারের মতো ৬৫-৬৭ শতাংশ মানুষ থেকে কর নেওয়া হয়। আর সামাজিক নিরাপত্তার যে বিভিন্ন বাজেট দেখানো হয়, তা ভুয়া। যে খাতগুলোতে টাকা দেওয়া হয়, সেটা তো নিরাপত্তা খাত না।

সত্যিকার অর্থে খাদ্য কর্মসূচিসহ প্রান্তিক বা দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথাও জানান তিনি।

আরএএস/এএমএ/এএসএম

Read Entire Article