উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য চাষে জটিলতা নিরসনে ‘জলবায়ু সহনশীল ফিশারিজ এবং অ্যাকুয়াকালচার বিষয়ক পাইলট কার্যক্রম’ মৎস্য চাষিদের মাঝে সাড়া ফেলেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে মৎস্য চাষিদের প্রশিক্ষণ, চাষে আধুনিকায়ন এবং জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় মৎস্যচাষ এবং মৎস্য ব্যবস্থাপনাকে আরও টেকসই করে তুলতে এ প্রকল্প কাজ করছে। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া ও দাকোপ উপজেলায় এ প্রকল্প বর্তমানে চলমান রয়েছে।
প্রকল্প ও খুলনা জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জাতিসংঘের এফএও তহবিলের জলবায়ু সহনশীল ফিশারিজ এবং অ্যাকোয়াকালচার প্রকল্প উপকূলীয় খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় চলছে। তার মধ্যে খুলনায় ডুমুরিয়া এবং দাকোপ উপজেলায় এ প্রকল্প চলমান রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর যৌথভাবে ‘কমিউনিটি বেইজ ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্প জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় উপজেলায় বিগত পাঁচ বছর যাবৎ বাস্তবায়ন করে আসছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হবে।
আরও জানা যায়, সিবিও (কমিউনিটি বেইজড অরগানাইজেশন) টিম গঠন করে তাদের মাধ্যমে এ প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সম্প্রদায় ভিত্তিক মৎস্য চাষি, স্থানীয় মৎস্যচাষি, জেলে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয় সিবিও টিম। পাইলট কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য এক একটি সিবিও টিমকে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা মূল্যের মাছ চাষের যাবতীয় উপকরণ, মাছের পোনা, খাদ্য, সার, ওষুধ, প্রি-বায়োটিক, প্রোবায়োটিক, মাছ ধরার জাল, পুকুরের লিজ মানি দেওয়া হয়।
ডুমুরিয়া ও দাকোপ উপজলোর বিভিন্ন সিবিও টিমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিবিওতে ১২ জন নারী এবং ১৩ জন পুরুষ রয়েছে। প্রত্যেক সিবিওর সদস্যরা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের মাসিক সঞ্চয় এবং সিবিওর ঘের থেকে উপার্জিত অর্থ জমা রাখেন। মাছ চাষ কিংবা সিবিও কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রেজুলেশনের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করে খরচ করেন। সব বিষয়ে প্রতি মাসে মিটিং করা হয় নিজেদের মধ্যে।
- আরও পড়ুন
- দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় করণীয়
- বর্ষাকালে মাছ ধরার সঙ্গী চাঁই
- অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি
ডুমুরিয়া উপজেলার রুদাঘরা বাগদা চাষি সিবিও সভাপতি মুক্তা বিশ্বাস জানান, আমরা জলবায়ু সহনশীল বাগদার সঙ্গে কার্প জাতীয় মাছ ও লবণ পানির অন্যান্য মাছ একসঙ্গে চাষ করে লাভবান হয়েছি। আমাদের সিবিওর নারী সদস্যরাও অনেক কিছু জেনেছে মাছ চাষ সম্পর্কে। তাদের মধ্যে মাছ চাষের লোকসানের ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়েছে। চেষ্টা করছি আমাদের কার্যক্রম এবং মৎস্য ঘের আরো বড় করব।
ডুমুরিয়া উপজেলার ভান্ডারপাড়া ইউনিয়ন সিবিও সেক্রেটারি বিভাশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ডুমুরিয়ায় মাছ চাষে লোকসানের কারণে অনেক চাষি মাছ চাষ ছেড়ে দিয়েছিল। শুধু লোকসান হতো। কিন্তু একই পানিতে একাধিক মাছ চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে এখন অনেক চাষি আবার মৎস্য চাষে ফিরেছে। তিনি আরও বলেন, মৎস্যচাষে অনেক জটিল বিষয় থাকে। এক একজনকে তা শেখানো যায় না। সবাই মাসিক মিটিং এ এগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করি। পরে প্রয়োজনে প্রশিক্ষককে জানালে তিনি আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যান।
দাকোপ উপজেলার পানখালী ইউনিয়নের বারইখালী-বসুন্দিয়া সিবিও সেক্রেটারি সোমা মণ্ডল বলেন, আমাদের গোত্রের অনেকে মাছ চাষ আবার শুরু করেছে। দাকোপের পানি মাছ চাষের জন্য অনেক উপযোগী। একটা সময় খুলনার বিভিন্ন জায়গায় দাকোপ থেকে মাছ যেতো।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের ঘেরে বাগদা, কার্পজাতীয় মাছ, নোনা ট্যাংরা, পারশে ইত্যাদি মাছ চাষ করছি। আমাদের ঘের দেখতে অনেক মানুষ এখন আসেন।
দাকোপের লক্ষীখোলা সিবিওর জলবায়ু ও দুর্যোগ প্রশমন বিষয়ক সেক্রেটারি সোনিয়া খাতুন বলেন, করোনা মহামারির সময় মৎস্য চাষিদের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। অনেকে মাছ চাষ ছেড়ে শহরে কাজের সন্ধানে ফিরে যান। আর গ্রামে মাছ চাষে ফেরেননি। কিন্তু অনেক নারীরা আবার মাছ চাষের হাল ধরেছেন। অনেকে পরামর্শ নিয়ে পুনরায় মাছ চাষ শুরু করেছেন। অনেক চাষি ভাই প্রশিক্ষণ ও হাতে কলমে শেখার মাধ্যমে মাছ চাষের জটিলতা নিরসন সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ন্যাশনাল কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট (ফিশারি অ্যান্ড লাইভলিহুড) বিশেষজ্ঞ মাছুদুর রহমান জানান, প্রকল্পটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় পাঁচটি উপজেলায় ৫০টি সিবিও গঠন করেছে। যার মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল মাছ চাষ, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ, কমিউনিটি পর্যায়ে মৎস্য খাদ্য উৎপাদন, মৎস্য আহরণোত্তর সেবা অন্যতম। আমরা মৎস্য চাষিদের পুনরায় জাগ্রত করার চেষ্টা করছি।
প্রকল্প পরিচালক মো. সামছু উদ্দিন বলেন, উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং হাওর বেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৯টি উপজেলায় বিগত পাঁচ বছর ধরে প্রকল্পটি চলছে। যার মাধ্যমে মৎস্য চাষি, জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা জলবায়ু সহনশীল মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনার ওপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সিবিওভিত্তিক জলবায়ু সহনশীল মৎস্যখাতে কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ কার্যক্রম, গলদা-বাগদা মিশ্রচাষ, নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদন, পেনফিশ কালচার, উন্নত ব্রুড ফিশ উৎপাদন, পুকুরে জলবায়ু সহনশীল মাছ চাষ করতে চাষিদের প্রশিক্ষণও সহায়তা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে চাষি ভাইদের বহু সাফল্যের গল্প তৈরি হয়েছে। মৎস্য চাষিদের পুনরায় জাগ্রত করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা কার্যক্রম চালাবো।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, খুলনা জেলার দাকোপ এবং ডুমুরিয়া উপজেলায় এফএও ফান্ডের মাধ্যমে এ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হবে। তবে আমরা প্রতিটি সিবিও টিমকে প্রগতিশীল হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।
আরিফুর রহমান/আরএইচ/জিকেএস