এক যুগে ভোগান্তি না কাটলেও নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে ১৬০ কোটি টাকা

1 month ago 8

নগরবাসীর গলার কাঁটা ৪ কিলোমিটার রাস্তা
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে তিনবার
কেডিএর দাবি ৭০ শতাংশ কাজ হয়েছে
দীর্ঘ ভোগান্তিতে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী

মানুষের ভোগান্তি কমানোর জন্য শিপইয়ার্ড সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এক যুগেও সে কাজ শেষ হয়নি। দীর্ঘদিন কাজ ফেলে রাখায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। উন্নয়নের নামে শিপইয়ার্ড সড়ক নির্মাণ এখন নগরবাসীর গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় ৪ কিলোমিটারের পুরো সড়কের কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। ইটের খোয়া রাস্তায় ছড়িয়ে। তার মধ্যে বৃষ্টির পানিতে কাদা হয়ে আছে সড়কে। হেলে দুলে ব্রেক চেপে গর্ত এড়িয়ে চলছে সব ধরনের যানবাহন। রাস্তার দুই ধারে জমে আছে পানি। পুরো এলাকা জুড়ে একটা জঞ্জাল অবস্থা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে খুলনা নগরের রূপসা ট্রাফিক মোড় থেকে শিপইয়ার্ডের সামনে দিয়ে খানজাহান আলী সেতু (রূপসা সেতু) পর্যন্ত সড়কটি প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৩ সালের ৭ মে। মেয়াদকাল ধরা হয় ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। পরে তা বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। পরে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এরমধ্যে ২০২০ সালের ২১ জুলাই ‘খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্প আবার একনেকে অনুমোদন হয়। তখন প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫৯ কোটি ২১ লাখ টাকা।

অনুমোদনের পর ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আতাউর রহমান লিমিটেড এবং মাহাবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড’কে (জয়েন্ট ভেঞ্চার) কার্যাদেশ দেয় কেডিএ। একই বছরের ২০ জানুয়ারি কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

‘শিপইয়ার্ডের কাজের মূল ঠিকাদার মাহাবুব ব্রাদার্স। মাহাবুব ব্রাদার্সের হাজার কোটি কালো টাকার সম্পদ। কেডিএর কেউ কাজ নিয়ে চাপ দিলে টাকার বান্ডেল চলে আসে। মাহাবুব ব্রাদার্সের লোকজন প্রভাবশালী।’

প্রকল্পের আওতায় রয়েছে, ৩ দশমিক ৭৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটি চার লেনে নির্মাণ। দুই পাশে নতুন ড্রেন ও ড্রেনের ওপর পথচারীদের হাঁটার জন্য প্রশস্ত ফুটপাত, সড়কের মাঝখানে শূন্য দশমিক ৯২ মিটার ডিভাইডার নির্মাণ। মূল রাস্তা, ডিভাইডার, ড্রেন ও ফুটপাত মিলিয়ে সড়কটি ৬০ ফুট চওড়া হবে। নির্মাণ করা হবে ৪৮ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু, একটি স্লুইসগেট ও একটি কালভার্ট। এছাড়া রাস্তাটি আগের চেয়ে প্রায় তিন ফুট উঁচু হবে। দুটি মনুমেন্ট স্থাপন এবং ৪২০টি বৃক্ষ রোপণ করা হবে।

এক যুগে ভোগান্তি না কাটলেও নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে ১৬০ কোটি টাকা

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা চাকরি করি। অনেক কারণে মুখ খুলতে পারি না, আবার প্রতিবাদও করতে পারছি না। প্রতিবাদ করলে অসাদাচরণের মামলায় ভোগাবে। বিগত দিনে আওয়ামী লীগের লোকজন কেডিএ দখল করে ছিল। ৫ আগস্টের পর তারা বিতাড়িত হলেও তাদের ঘনিষ্ঠজনরা বিতাড়িত হননি।

আরও পড়ুন-

তিনি আরও বলেন, শিপইয়ার্ডের কাজের মূল ঠিকাদার মাহাবুব ব্রাদার্স। মাহাবুব ব্রাদার্সের হাজার কোটি কালো টাকার সম্পদ। কেডিএর কেউ কাজ নিয়ে চাপ দিলে টাকার বান্ডেল চলে আসে। মাহাবুব ব্রাদার্সের লোকজন প্রভাবশালী।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, শিপইয়ার্ডের কাজ নিয়ে কারো পেট থেকে কথা বের করতে পারবেন না। তথ্য চাইলে দিবে কিন্তু তা কাগজ কলমের তথ্য। বাস্তবটা রাস্তায় গেলে বুঝবেন। রাস্তা নিয়ে কোনো কথা উঠলে ঠিকাদার কিছু শ্রমিক নিয়ে গিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করেন। আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসে রিপোর্ট দেন কাজ তো চলছে।

এই রাস্তা দ্রুত সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধনও করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।

‘রাস্তা সংস্কার কচ্ছপের গতিতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যে দেখি কিছু জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি করছে। আসলে কেডিএ যে কঅ করছে তা কেডিএ ভালো জানে। এক যুগ আগে কাজ শুরু হলেও আজ পর্যন্ত চলছে। এক যুগেও শেষ হয়নি রাস্তার কাজ।’

জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত মানববন্ধনে জামায়াতে ইসলামীর নগর সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল বলেন, রূপসা ট্রাফিক মোড় থেকে খানজাহান আলী সেতু পর্যন্ত চার কিলোমিটার সড়কটি নগরবাসীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলাচলের পথ। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বড় বড় গর্তের কারণে যানবাহন চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে সড়কটি। এক সময়ের ব্যস্ততম এই সড়কে এখন ইজিবাইক চালকরাও চলতে চান না।

এক যুগে ভোগান্তি না কাটলেও নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে ১৬০ কোটি টাকা

তিনি আরও বলেন, সড়কের উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বছরের পর বছর ধরে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে রাখা হচ্ছে। অবিলম্বে সংস্কার কাজ শুরু না হলে বৃহৎ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন-

খুলনা মহানগর বিএনপি আয়োজিত মানববন্ধনে নগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা বলেন, খুলনার অন্যতম ব্যস্ত সড়ক রূপসা ট্রাফিক মোড় থেকে খানজাহান আলী (রূপসা) সেতু পর্যন্ত প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ ১২ বছরেও সংস্কার না হওয়ায় বড় বড় গর্ত, উঁচু-নিচু ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উদাসিনতায় দীর্ঘ এক যুগ ধরে রাস্তা মেরামতের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে না।

২০১৩ সালে একনেক সভায় অনুমোদিত এই প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালে। বারবার মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৫ সালেও কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫৯ কোটি ২১ লাখ টাকায়। কিন্তু এখনও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দা তৌফিকুল ইসলাম বলেন, সড়ক নির্মাণের নামে রসিকতা আমাদের সঙ্গে বন্ধ করা উচিত। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে এমন দশা করছে যে বলতে হয়, কেডিএ হাটেও না, আবার পথও ছাড়ে না। দীর্ঘ দশ বছর আমরা ভুগছি। চলাচলের সময় আমাদের প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এই সড়কটির বেহাল দশায় তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে রুপসা এলাকায়। এ থেকে আমরা পরিত্রাণ পেতে চাই।

‘সড়ক নির্মাণের নামে রসিকতা আমাদের সঙ্গে বন্ধ করা উচিত। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে এমন দশা করছে যে বলতে হয়, কেডিএ হাটেও না, আবার পথও ছাড়ে না। দীর্ঘ দশ বছর আমরা ভুগছি। চলাচলের সময় আমাদের প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’

বান্দা বাজার এলাকার ব্যবসায়ী ইয়াসিন আরাফাত বলেন, রাস্তা সংস্কার কচ্ছপের গতিতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে দেখি কিছু জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি করছে। আসলে কেডিএ যে কঅ করছে তা কেডিএ ভালো জানে। এক যুগ আগে কাজ শুরু হলেও আজ পর্যন্ত চলছে। এক যুগেও শেষ হয়নি রাস্তার কাজ। সড়কের অনেক জায়গায় হয়েছে গর্ত। গর্তে জমেছে বৃষ্টির পানি। চলাচল করতে খুব সমস্যা হয়। কিন্তু কেডিএ কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক শিপইয়ার্ড সড়ক। চার লেনের সড়ক নির্মাণের কাজ দীর্ঘ এক যুগেও শেষ হয়নি। কারণ অনেক আগেই প্রকল্পের টাকার একটা অংশ লোপাট হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ শেষ না হওয়ায় এখন শিপইয়ার্ড সড়ক নগরবাসীর গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন সড়ক নির্মাণ কাজ ফেলে রাখায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু সড়কটি নির্মাণে সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসা সমন্বয় করলে কাজটি জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে দ্রুত শেষ হতো।

তিনি আরও বলেন, সড়কটি সঠিক সময়ে সংস্কার হলে নগরীর যানজট সমস্যা অনেকটা কমে যাবে। সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন। এজন্য দ্রুত কাজ সম্পন্নের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। একইসঙ্গে দুর্নীতির বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

এ বিষয়ে ঠিাকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মাহাবুবুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী (পূর্ত) ও শিপইয়ার্ড সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. আরমান হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কেডিএ দপ্তরে যাওয়া হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের তথ্য দেওয়ায় কিছুটা বাধা রয়েছে। তবে জনসংযোগে যোগাযোগ করলে তথ্য পাবেন।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কাজ ৭০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। আপনি অফিসে আসেন। অফিসে এলে আপনার জন্য ভালো হবে।

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব মো. বদিউজ্জামান বলেন, তথ্য দেওয়ায় কারো কোনো বাধা নেই। হয়তো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আপনাকে বোঝাতে সক্ষম হননি।

এফএ/এমএস

Read Entire Article