স্বপ্ন মানে শুধু কল্পনা নয়। স্বপ্ন মানে না কোনো বিলাসিতা বা সহজ পথ। বরং স্বপ্ন এমন একটি দীর্ঘ যাত্রা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে থাকে পরিশ্রম, ত্যাগ আর ধৈর্য। শত শত নির্ঘুম রাত, অজস্র চ্যালেঞ্জ আর দৃঢ় মনোবল; তবেই রঙিন হয়ে ওঠে সেই স্বপ্ন। আজ এমনই এক স্বপ্নবাজ তরুণের গল্প বলবো যিনি নিজের হাতে লিখেছেন নিজের ভাগ্য। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে তিনি গড়েছেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বলছি ২৪ বছরের এক যুবক মেহেদি হাসান রাফির কথা। যিনি আজ দেশের হাজারো তরুণের অনুপ্রেরণা।
শুরুটা ছোট্ট স্বপ্ন থেকে
২০০১ সালের ৭ মার্চ কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্ম রাফির। সেনা সদস্য বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে যশোর, খুলনা আর খাগড়াছড়িতে। এরপর ২০০৬ সালে পরিবার নিয়ে কুমিল্লায় ফেরেন তিনি। নতুন পরিবেশে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। ২০০৮ সালে ভর্তি হলেন ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেই ভর্তি হওয়ার গল্পও বেশ মজার।
বাবা শর্ত দিয়েছিলেন, ‘যদি ইস্পাহানীতে চান্স পেতে পারো, তোমাকে সাইকেল কিনে দেব।’ ফলাফল বের হওয়ার দিন বাবার কোলে চড়ে গেলেন সাইকেলের দোকানে। সেদিনই শুরু হয় তার স্কুল জীবন, যা শেষ হয় উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে। কিন্তু পড়াশোনায় রাফির মন বসতো না। বইয়ের পাতার চেয়ে কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ানোই ছিল তার নেশা। তবে বাবা-মায়ের হাসি দেখার জন্যই চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সেই চেষ্টা বৃথা যায়নি। পঞ্চম, অষ্টম, দশম আর দ্বাদশ সব গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাতেই পেয়েছেন জিপিএ-৫।
গেমের নেশা থেকে বাস্তবের প্রশ্নে
শৈশবে খেলাধুলার মাঠ ছিল না তার প্রিয় জায়গা। বরং মোবাইল আর কম্পিউটার গেমেই ডুবে থাকতেন। অষ্টম শ্রেণিতে বাবার কাছে শর্ত রাখলেন, জিপিএ-৫ পেলে ল্যাপটপ চাই। শর্ত পূরণ করলেন, পেলেন ল্যাপটপও। কিন্তু শুরু হলো গেমের নেশা। বাস্তব জীবনের জন্য কোনো পরিকল্পনা তখনও ছিল না।
পরিবারের ইচ্ছে ছিল রাফি একদিন বড় ডাক্তার হবেন। কিন্তু কলেজে উঠে বুঝলেন, চিকিৎসকের পথ তার জন্য নয়। তখনই শুরু হলো আত্মজিজ্ঞাসা,‘আমি কী হতে চাই? আমার লক্ষ্য কী?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইউটিউবে ঝুঁকলেন। সেখানে পেলেন নতুন এক জগৎ। একের পর এক ভিডিও দেখে শিখলেন সাফল্য, ক্যারিয়ার আর আত্মউন্নয়নের পাঠ।
এরপর পরিচয় হলো কিছু বইয়ের সঙ্গে- ‘থিঙ্ক অ্যান্ড গ্রো রিচ’, ‘দ্য সাইকোলজি অব মানি’, ‘রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড’, ‘অ্যাটমিক হ্যাবিটস’। বিশেষ করে রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড বইটি পাল্টে দেয় তার চিন্তার দিগন্ত। তিনি বুঝলেন, চাকরি পাওয়ার জন্য নয়, চাকরি তৈরি করার জন্য শিখতে হবে।
লকডাউনের আশীর্বাদ
রাফির জীবনের মোড় ঘুরে যায় ২০২০ সালের লকডাউনে। হাতে তখন প্রচুর সময়। ইউটিউব হলো তার বিশ্ববিদ্যালয়। শিখতে থাকলেন একের পর এক নতুন স্কিল- ব্লগিং, এসইও, ওয়েব ডিজাইন, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, এফিলিয়েট মার্কেটিং, গ্রাফিক ডিজাইন। তারপর তৈরি করলেন ইউটিউব চ্যানেল, বানাতে শুরু করলেন ওয়েব ডিজাইন টিউটোরিয়াল। ছোট্ট রুম, সীমিত রিসোর্স তবু তিনি থামেননি। সেই সময়ই উপলব্ধি করলেন, স্কিল আর সার্টিফিকেটের মধ্যে বিশাল পার্থক্য।
স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার গল্প
একদিন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশে কেউ যদি মাল্টি-স্কিল শিখতে চায়, তার জন্য ভালো প্ল্যাটফর্ম কোথায়? কেউ উত্তর দিতে পারল না। তখনই রাফির সিদ্ধান্ত ‘আমরাই শুরু করি’।
পকেটে টাকা ছিল না, কিন্তু ছিল দক্ষতা আর ইচ্ছাশক্তি। মিরাজ নামের এক বন্ধুকে বলেন, তুই মার্কেটিং কর, বাকি সব আমি সামলাব। এভাবেই জন্ম নেয় মিক্সেমি ডট কম (Mexemy.com) দেশের অন্যতম এডটেক প্ল্যাটফর্ম। প্রথম কোর্স ছিল ওয়েব ডিজাইন। মাত্র চার মাসে যুক্ত হলো পাঁচশো এর শিক্ষার্থী। রাফি নিজেই ছিলেন প্রথম মেন্টর। প্রথম দুই বছর কোনো বেতন নেননি। যতটুকু আয় হতো, সব ইনভেস্ট হতো প্ল্যাটফর্মের উন্নয়নে।
বর্তমানে এই প্ল্যাটফর্মের শিক্ষার্থী সংখ্যা বিশ হাজারের বেশি, রয়েছে ২০ জন মেন্টর, ২৩টিরও বেশি কোর্স আর গুগলে ৪.৮ স্টার রেটিং। শুরু হয়েছিল মাত্র ৬০ হাজার টাকা দিয়ে, আর এখন এটি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম।
অর্জন আর অনুপ্রেরণা
এ পর্যন্ত রাফি তিনটি কোর্সে প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থীকে সরাসরি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যৌথভাবে আরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থীকে শিখিয়েছেন। ইউটিউবের দুইটি চ্যানেলে গড়ে তুলেছেন পনেরো হাজারেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার কমিউনিটি, যেখানে পাঁচ লাখ মানুষ ভ্যালু পেয়েছে। তার অধীনে শেখা শিক্ষার্থীদের কেউ আজ সফল ফ্রিল্যান্সার, কেউ উদ্যোক্তা, কেউ বা চাকরিজীবী।
তার বিশ্বাস, ‘সার্টিফিকেট নয়, স্কিলে বিশ্বাসী হও।’ রাফি বলেন, ‘যেটা করতে চাই, সেটা সময় থাকতে করবো। ব্যর্থ হলেও শিখবো, কারণ শেখার মূল্য যেকোনো ডিগ্রির চেয়ে বেশি।’
অদম্য যাত্রা, অদূর স্বপ্ন
২৪ বছর বয়সে রাফির অর্জন অনেক, কিন্তু তিনি এখনো থামেননি। তার লক্ষ্য আগামী ১০ বছরে দেশের প্রতিটি মানুষকে বোঝানো যে সাফল্য ডিগ্রির গণ্ডিতে আটকে নেই। তার অনুপ্রেরণাদায়ী বার্তা, ‘বাধা কখনো টাকা বা রিসোর্স নয়, বাধা কেবল তোমার কমফোর্ট জোন। আমি যদি পারি, তুমি কেন পারবে না?’
এই গল্প শুধু মেহেদির নয়। এটি প্রমাণ করে ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। স্বপ্ন দেখার সাহস করলেই তার পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
জেএস/জেআইএম