একই ক্যাডারে দুইবার সুপারিশ, স্বপ্ন ভেঙেছে অনেকের

2 months ago 7

৪৩তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার পদে নিয়োগ পান মো. শাহদুদুজ্জামান। তিনি বর্তমানে জয়পুরহাট সরকারি কলেজে কর্মরত। ৪৪তম বিসিএসেও তিনি একই ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিসিএসে একই ক্যাডারে দুইবার সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে হতাশ শাহদুদুজ্জামান। যে ক্যাডারে রয়েছেন, তারচেয়েও ভালো ক্যাডারে সুপারিশ না পাওয়ায় স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তার।

মো. শাহদুদুজ্জামানের ভাষ্য, ‘পুনরায় একই ক্যাডারে সুপারিশ করার অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। এর চেয়ে বরং আমার জায়গায় অন্য কাউকে সুপারিশ করলেই বেশি খুশি হতাম। এজন্যই পুনরায় ক্যাডার চয়েজ দেওয়ার সুযোগ রাখা উচিত ছিল। আধুনিকায়নের এ যুগে এমন কিছু প্রত্যাশিত না।’

৪৪তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে ৩৫-৪০ শতাংশের বেশি রিপিট ক্যাডার। লাইভস্টকে রিপিট ক্যাডার অন্তত ৫০ শতাংশ। এসব পদে কেউই যোগদান করবেন না। গেজেটের পর পদগুলো শূন্য থেকে যাবে।- দাবি চাকরিপ্রার্থীদের

একইভাবে দুইবার লাইভস্টক ক্যাডারে সুপারিশ জুটেছে রাজধানীর শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মশিউর রহমান সবুজের ভাগ্যেও। ৪১তম বিসিএসে লাইভস্টক ক্যাডারে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পেয়ে তিনি এখন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

অথচ ৪৪তম বিসিএসেও তিনি একই ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। দুইবার একই ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া মশিউর রহমান সবুজের প্রশ্ন ‘এ কোন পিএসসি?’ তিনি তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, ‘আমাকে আবারও লাইভস্টক ক্যাডারে সুপারিশ করা হইছে! আমাদের সকল তথ্য পিএসসির কাছে আছে। তাও এমন কেন?’

বিসিএসে কে, কোন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে চাকরি করছেন, সে তথ্য আমাদের কাছে থাকে না। প্রার্থীরা কোন ক্যাডারে সুপারিশ চান না, সে বিষয়েও কেউ আবেদন করেন না। ফলে এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পিএসসির হাতে থাকে না।- এস এম মতিউর রহমান

শুধু শাহদুদুজ্জামান ও মশিউর রহমান নন, ৪৪তম বিসিএসে এমন রিপিট ক্যাডার বা একই ক্যাডারে দুইবার সুপারিশের ছড়াছড়ি। শিক্ষা, প্রশাসন, পুলিশ, লাইভস্টকসহ বেশকিছু ক্যাডারে এ সংখ্যা বেশি। চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, ৪৪তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে ৩৫-৪০ শতাংশের বেশি রিপিট ক্যাডার। আর লাইভস্টকে রিপিট ক্যাডার হতে পারে অন্তত ৫০ শতাংশ। ফলে এসব পদে কেউই যোগদান করবেন না। গেজেটের পর পদগুলো শূন্য থেকে যাবে।

আরও পড়ুন

পরিস্থিতি এমন যে ৪৪তম বিসিএসে যারা একই ক্যাডারে দুইবার সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন, তারাও যেমন হতাশ; তেমনই প্রিলি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও যারা পদ ফাঁকা না থাকায় ক্যাডার পদে সুপারিশ পাননি, তাদেরও বিসিএসের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা। তারা পিএসসির সামনে অবস্থান কর্মসূচি করার ঘোষণাও দিয়েছেন।

১৬৯০ ক্যাডার পদে নিয়োগে চূড়ান্ত সুপারিশ

গত ৩০ জুন রাত সাড়ে ১১টার দিকে ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ১ হাজার ৭১০টি পদ থাকলেও ১ হাজার ৬৯০টি পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। বাকি ২০টি কারিগরি বা পেশাগত পদে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় সুপারিশ করতে পারেনি পিএসসি।

সরকার বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যদি মনে করে রিপিট ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তদের পদগুলো শূন্য হলে সেখানে নন-ক্যাডার থেকে সুপারিশ করা সম্ভব, তবে পিএসসিকে অনুমোদন দিলে এ কাজ করতে খুব বেশি সময়ও লাগবে না।- পিএসসি সদস্য

এ বিসিএসে সবচেয়ে বেশি ৭৭৬টি পদ ছিল সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে। এছাড়া প্রশাসন ক্যাডারে ২৫০ জন, পুলিশে ৫০ জন, পররাষ্ট্রে ১০ জন, আনসারে ১৪ জন, নিরীক্ষা ও হিসাবে ৩০ জন, পরিবার পরিকল্পনায় ২৭ জন নিয়োগের কথা ছিল।

পাঁচ শতাধিক পদে ‘রিপিট ক্যাডার’ সুপারিশ

ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, খুলনা বিএল কলেজ থেকে ৪৪তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন- এমন ২৮ জনের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। তাদের মধ্যে ১১ জন রিপিট ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন। অর্থাৎ, এর আগেও ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসে তারা শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ এবং গেজেট পেয়ে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। হিসাব অনুযায়ী- ৩৯ দশমিক ২৮ শতাংশ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তরা রিপিট ক্যাডার।

এদিকে, রিপিট ক্যাডার বিষয়টি সামনে আসায় এ নিয়ে আন্দোলন করতে প্রার্থীদের সংগঠিত করছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী। তাদের মধ্যে দুজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে জানান, তারা মোবাইল ফোনে কথা বলে এবং ফেসবুকে যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে অন্তত পাঁচ শতাধিক প্রার্থীকে একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশ করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন। তাদের শতভাগ ৪৪তম বিসিএসের সুপারিশে চাকরিতে যোগ দেবেন না।

একই ক্যাডারে দুইবার সুপারিশ, স্বপ্ন ভেঙেছে অনেকের

ফলে ১ হাজার ৬৯০ জন সুপারিশপ্রাপ্তের মধ্যে গেজেটের আগেই ৫০০-এর বেশি প্রার্থী নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবেন। এতে যারা মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেও ক্যাডার হতে পারেননি, তাদের নিয়োগ দেওয়া উচিত হবে বলে মনে করছেন সুপারিশ না পাওয়া ভুক্তভোগী প্রার্থীরা।

রিপিট ক্যাডার বিড়ম্বনার নেপথ্যে?

একটি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তির পর তা শেষ করতে সাড়ে তিন থেকে চার বছর লেগে যায়। এতে যে প্রার্থী ৪১তম বিসিএসে আবেদন করেছেন, তিনি চূড়ান্ত ফল পাওয়ার আগেই আবার ৪৩তম বিসিএসে আবেদন করেছেন। কেউ কেউ আবার ৪৪তম বিসিএসেও ওই সময়ের মধ্যে আবেদন করেছেন। ফলে তারা কেউই তখন কোনো ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত নন। এজন্য তারা সব বিসিএসেই প্রায় একই রকম চয়েজ (পছন্দ) দিয়েছেন।

কীভাবে রিপিট ক্যাডার সুপারিশ এড়ানো যায়, তা নিয়ে বিভিন্নজন নানান মতামত দিচ্ছেন। তবে প্রার্থীদের দাবি, বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগে যারা মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন, তখন তাদের চয়েজ ফরম পুনরায় সংশোধন বা পরিমার্জন করার সুযোগ দেওয়া উচিত। তাহলে এ বিড়ম্বনা কমবে।

শিক্ষা ক্যাডারে ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত মো. শাহদুদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ৪৩তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই ৪৪তম বিসিএসে আবেদন করেছি, চয়েজ ফরম পূরণ করেছি। ফলে ৪৩তম বিসিএসে যেমন শিক্ষা ক্যাডার আমার পছন্দের তালিকায় ছিল, তেমনই ৪৪তম বিসিএসেও শিক্ষা ক্যাডার রেখেছি। যদি ৪৪তম বিসিএসের ভাইভার সময়ে আমাকে চয়েজ ফরম সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে আমি শিক্ষা ক্যাডার আর রাখতাম না।’

‘কারণ আমি তখন অলরেডি শিক্ষা ক্যাডারে জয়েন করেছি। তাহলে হয় আমার ভিন্ন ক্যাডার আসতো অথবা আসতো না। আমার জায়গায় অন্য কেউ সুযোগ পেতেন’- যোগ করেন শাহদুদুজ্জামান।

একই ক্যাডারে দুইবার সুপারিশ, স্বপ্ন ভেঙেছে অনেকের

‘তথ্য ঘাটতিতে’ রিপিট ক্যাডার সুপারিশ

রিপিট ক্যাডারের ছড়াছড়ি হলেও বিষয়টিতে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কোনো দায় নেই বলে দাবি করেছেন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, তারা প্রার্থীদের পছন্দক্রম এবং প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী চূড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ করেছেন। ফল প্রকাশের আগে কে কোন ক্যাডারে চাকরিরত, সে বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য থাকে না। ফলে এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যায় না।

আরও পড়ুন

জানতে চাইলে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) মাসুমা আফরীন বিষয়টি নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এস এম মতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘৪৩তম বিসিএসে কে, কোন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে চাকরি করছেন, সে তথ্য আমাদের কাছে থাকে না। এমনকি প্রার্থীরা কোন ক্যাডারে সুপারিশ চান না, সে বিষয়েও কেউ আবেদন করেন না। ফলে এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পিএসসির হাতে থাকে না।’

রিপিট ক্যাডারে নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগের দাবি

রিপিট ক্যাডারের ছড়াছড়ির ঘটনায় ক্ষুব্ধ মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ না পাওয়া প্রার্থীরা। তাদের দাবি, রিপিট ক্যাডার প্রত্যাখ্যান করায় যেসব পদ শূন্য হবে, সেখানে নন-ক্যাডার থেকে মেধাক্রম অনুযায়ী সুযোগ দিতে হবে। এ দাবি আদায়ে তারা প্রয়োজনে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে ৪৪তম বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন রকিবুল ইসলাম সুমন। তিনি বলেন, ‘যারা প্রিলি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ক্যাডার পদে সুপারিশ পাননি, তাদের কোনো অযোগ্যতা নেই। অযোগ্যতা হলো- পদ নেই। কিন্তু একই ক্যাডারে দুইবার করে সুপারিশ করা হয়েছে। এ পদগুলো ফাঁকা হয়ে যাবে। সেখানে নন-ক্যাডারের তালিকা থেকে নিয়োগের সুপারিশের ব্যবস্থা করতে হবে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আবু জাফর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি নন-ক্যাডারে আছি। বয়স শেষ দিকে। ৪৭তম বিসিএস আমার শেষ বিসিএস। ফলে এখন নন-ক্যাডারে ঝুলে থাকার চেয়ে আমি চাইবো আমাকে ক্যাডারে সুপারিশ করা হোক। যেহেতু রিপিট ক্যাডার প্রচুর তাই শূন্যপদে অবশ্যই পুনরায় নিয়োগ সুপারিশের দাবি করছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, যিনি এখন পিএসসির সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, এটি জনপ্রশাসনের দায়িত্ব। তারা যদি মনে করে রিপিট ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তদের পদগুলো শূন্য হলে সেখানে নন-ক্যাডার থেকে সুপারিশ করা সম্ভব, তবে পিএসসিকে অনুমোদন দিলে এ কাজ করতে খুব বেশি সময়ও লাগবে না।’

এএএইচ/এমকেআর/জিকেএস

Read Entire Article