একজন লেগ স্পিনারের প্রয়োজন এবং রিশাদের জ্বলে ওঠা

4 months ago 53

‘লেগস্পিন’; ক্রিকেটের সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল, শৈল্পিকতার এক বড় নিদর্শন।  কারো কাছে লেগস্পিন এক শিল্প। একটা লেগির বল যত টার্ন করে বাঁ-হাতি অর্থোডক্স আর অফস্পিনারের বল ততটা ঘোরে না। হোক তা লাল কিংবা সাদা বলে, একজন লেগস্পিন গুগলি বোলার সব সময়ই বড় ম্যাচ উইনার।

কঠিন সত্য হলো বাংলাদেশ কখনোই কোন লেগস্পিনারের দেখা পায়নি। সেই ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৭ দেড়যুগ আইসিসি ট্রফি খেলার সময় এবং টেস্ট অভিষেকের সময়ও টিম বাংলাদেশে কোন লেগস্পিনার ছিল না। 

মোহাম্মদ আশরাফুল ক্যারিয়ারের শুরুর কয়েক বছর ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি লেগস্পিন করলেও সাফল্য পাননি একদমই। মাঝে জুবায়ের হোসেন লিখন হঠাৎ  আলোর ঝলকানি দিলেও দপ করে নিভে গেছেন। অনেকেরই মত, কোয়ালিটি লেগস্পিনার থাকলে বাংলাদেশের সব ফরম্যাটেই বোলিং সাফল্য বেশি থাকতো। টাইগাররা আরও বেশি করে ম্যাচ জিততো।

অবশেষে সে ধারার ব্যতিক্রম ঘটেছে। বাংলাদেশও এক লেগস্পিনার পেয়েছে। শুরুতে তাকে সেভাবে আমলে আনা না হলেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে রিশাদ হোসেন নিজেকে প্রমাণ করছেন। 

একজন দক্ষ লেগস্পিনার কি করতে পারেন, তার হাত ধরে যে আন্তর্জাতিক ম্যাচে সাফল্য আসতে পারে- এ সত্যটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন রিশাদ। ৬ ফুট লম্বা রিশাদ; উচ্চতা কাজে লাগিয়ে জোরের ওপর টার্ন করাতে পারেন। গুগলি ততটা তীক্ষ্ণ না হলেও লেগব্রেকটা মাঝে মধ্যে অফস্ট্যাম্প ও আশপাশে পড়ে সাপের মত টার্ন করে। 

এবারের বিশ্বকাপে সে ধরনের ডেলিভারিতে শ্রীলঙ্কা ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে একটি করে উইকেটের পতন ঘটিয়েছেন রিশাদ। অফস্ট্যাম্পের ঠিক বাইরের ওই ডেলিভারি দুটি বাড়তি গতিতে ব্যাটকে পরাস্ত করে চলে যায় উইকেটের পিছনে হুমড়ি খেয়ে দাঁড়ানো লিটন দাসের গ্লাভসে। লিটন ব্যাট হাতে এখন পর্যন্ত কাজের কাজ করতে না পারলেও দুই ম্যাচে অতি দ্রুত দুটি স্ট্যাম্পিং করে দলের সাফল্যে অবদান রেখেছেন।

এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যে দুটি ম্যাচ জিতেছে, তার দুটিতেই অবদান আছে রিশাদের। শ্রীলঙ্কা আর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ২ ম্যাচেই ৩টি করে উইকেট দখল করে দল জেতাতে বিশেষ অবদান রাখেন লেগি রিশাদ। দুই ম্যাচেই ভাইটাল ব্রেক থ্রু উপহার দিয়ে খেলার চিত্র পাল্টে দেন তিনি।

শুরুর ধাক্কা সামলে লঙ্কানরা এক সময় ইনিংসটা নতুন করে সাজিয়ে ফেলেছিল।  ওই সময় বল করতে এসে প্রথম ২ ওভার সুবিধা করতে পারেননি রিশাদ। ছক্কা হজমসহ ২ ওভারে দিয়ে বসেন ১৬ রান। ১৪ ওভার শেষে লঙ্কানদের স্কোর গিয়ে দাড়ায় ৩ উইকেটে ১০০। 

মনে হচ্ছিল লঙ্কানদের স্কোর দেড়শো ছাড়িয়ে যবে; কিন্তু হতোদ্যম না হয়ে রিশাদ তৃতীয় ওভারে বোলিংয়ে গিয়েই টুঁটি চেপে ধরেন লঙ্কানদের। ঠিক তখন এসে তিনিই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিলেন।  ১৫ ওভার এর প্রথম বলে লেগি রিশাদকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে ডিপ ব্যাকওয়াড স্কোয়ার লেগে সাকিবের হাতে ক্যাচ দেন চারিথ আসালাঙ্কা।

ঠিক পরের বলে আবার আঘাত হানেন রিশাদ। এবার তার লেগব্রেকে লেগসাইডে ঘোরাতে গিয়ে টার্নে পরাস্ত হাসারাঙ্গা ক্যাচ দেন প্রথম স্লিপে। শেষ ওভারে আবার রিশাদ ম্যাজিক। এবার আউট হন একদিক আগলে রাখা ধনঞ্জয়া ডি সিলভা।

একদম আদর্শ লেগব্রেক ডেলিভারি। বল পিচ পড়ে ঠিক অফস্ট্যাম্পের ওপর। ১৬ ওভার পুরো উইকেটে কাটিয়ে দেয়া ধনঞ্জয় ডি সিলভা অফস্ট্যাম্পের ঠিক বাইরে ব্যাট পেতে দেন; কিন্তু টার্নে পরাস্ত হন। উইকেটের ওপর হুমড়ি খেয়ে দাড়িয়ে থাকা লিটন দাস চকিতে বেলস তুলে নেন।  

৩ উইকেটে ১০০ থেকে ১০৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে আবার ব্যাকফুটে চলে যায় শ্রীলঙ্কা। তারপর ১২৪ রানে গিয়ে থামে হাসারাঙ্গার  দল। ২ উইকেটের জয় পায় বাংলাদেশ। রিশাদ হন ম্যাচ সেরা পারফরমার। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তা না পারলেও রিশাদ ঠিক জায়গামত বল ঘূরিয়ে স্পিন ঘূর্ণিতে ডাচ মিডল অর্ডারে ভাঙ্গন ধরিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেন। 

শ্রীলঙ্কার ম্যাচের মত এদিনও প্রথম ২ ওভারে উইকেট পাননি রিশাদ। ১৬০ রান করতে গিয়ে ডাচরা তখন বেশ মজবুত অবস্থানে। ১৪ ওভার শেষে ডাচদের স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ১০৪। ১৫ নম্বর ওভারে তৃতীয় ওভারে বল হাতে নিয়ে ৪ নম্বর ডেলিভারিতে আঘাত হানেন রিশাদ। তার বলে তুলে মারতে গিয়ে সাইব্রান্ড এনগেলব্রেখট মাঝ ব্যাটে আনতে পারেননি। 

লেগস্পিন বল টার্ন করে ব্যাটের বাইরের ওপরের অংশে লেগে আকাশে উঠলে তা ধরে ফেলেন তানজিম সাকিব। ২ বল পরে আবার লেগস্পিন সাপের মত ফনা তুলে ডাচ পেসার টিম ডি লিডের ব্যাট ফাকি দিয়ে চোখের পলকে চলে যায় কিপার লিটনের গ্লাভসে। টার্নে পরাস্ত ডি লিডের বাঁ-পা ক্রিজ থেকে একটু উঠে যাওয়া মাত্র উইকেটের গা ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা লিটন দাস কিরণ মোরের মত অসামান্য ক্ষিপ্রতায় বেলস তুলে ডি লিডিকে স্ট্যাম্পড করে দেন। 

পরের ওভারে আবার রিশাদ ভেলকি। এবার স্লগ করতে গিয়ে আকাশে তুলে রিটার্ন ক্যাচ দেন লোগান ফন বিক।  বদলে যায় খেলার চালচিত্র। বাংলাদেশ পায় ২৫ রানের জয়। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হতে না পারলেও বাংলাদেশের জয়ের অন্যতম রুপকার, স্থপতি হন লেগস্পিনার রিশাদ।

লঙ্কান ও ডাচদের সাথে ম্যাচ উইনিং বোলিং করা লেগি রিশাদ সোমবার ভোরে নেপালের সাথে কী করেন? সেটাই দেখার।  
এআরবি/আইএইচএস

Read Entire Article