লোকসানের মুখে ২০১১ সালে বন্ধ ঘোষণার পর থেকে অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে ফেনীর ‘দোস্ত টেক্সটাইল মিলস’। দীর্ঘ ২১ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ কারখানা দেখভালের জন্য নেই পর্যাপ্ত জনবল। একসময় মিলটি সহস্রাধিক ব্যক্তির কর্মের ঠিকানা হলেও বছরের পর বছর সুনসান নীরবতায় এটি এখন ‘ভুতুড়ে বাড়িতে’ পরিণত হয়েছে। ১৮ বছর বন্ধ থাকা মিলটি চালু করা গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হওয়ার পাশাপাশি ফেনীর অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় বেকার সমস্যার সমাধান ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে ১৯৬৫ সালে ফেনী সদর উপজেলার রানীর হাট সংলগ্ন স্থানে ব্যক্তি প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা হয় ‘দোস্ত টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড’। ২১ দশমিক ৪৭ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এ কারখানায় ছয় শতাধিক শ্রমিক নিয়োজিত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় গড়ে ওঠে হাট-বাজার, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রসহ অনেক কিছুই। ১৯৭২ সালে এটি রাজস্ব করা হয়। পরে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক ও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল। এখান থেকে উৎপাদিত সুতা বিদেশে রপ্তানিও হতো।
‘ফেনী জেলায় একসময়ের সবচেয়ে প্রাণ চাঞ্চল্যের কারখানাটিতে একেবারেই সুনসান নীরবতা। বড় বড় দালান ঘর থাকলেও সেগুলোতে নেই কোনো সরঞ্জাম। বছরের পর বছর বন্ধ থাকায় গুদাম ও মেশিন ঘরগুলো ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। আশপাশের আবাসিক ঘরগুলো দীর্ঘদিন মেরামত না করায় আয়ুষ্কাল পুরিয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ছে।’
তবে চাহিদার আলোকে আধুনিকায়ন করতে না পারায় ১৯৯৩ সাল থেকে কারখানাটিতে লোকসান শুরু হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে সার্ভিস চার্জ পদ্ধতিতে উৎপাদন করেও লাভের মুখ না দেখায় ২০১১ সালে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় কারখানাটি। সেই থেকে বছরের পর বছর এটি চালুর প্রহর গুনতে গুনতে মারা গেছেন অনেক শ্রমিক। আবার অনেকেই জীবন-জীবিকার জন্য নিয়োজিত হয়েছেন অন্য পেশায়।
- আরও পড়ুন
- দশ মাসে বন্ধ ৪১ কারখানা, ধস নেমেছে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও বাসা ভাড়ায়
- সীতাকুণ্ডে তৈরি ক্যাবলে লেখা ‘মেড ইন জাপান’,কারখানা সিলগালা
- ভারতের নিষেধাজ্ঞায় বিপন্ন পাবনার হোসিয়ারি শিল্প
- নদীর পর ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি’ অ্যাওয়ার্ডও দখলে এক্স সিরামিকের!
- ভোলায় জীবিকার জন্য ভরসা অন্য জেলা
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জেলায় একসময়ের সবচেয়ে প্রাণ চাঞ্চল্যের কারখানাটিতে একেবারেই সুনসান নীরবতা। বড় বড় দালান ঘর থাকলেও সেগুলোতে নেই কোনো সরঞ্জাম। বছরের পর বছর বন্ধ থাকায় গুদাম ও মেশিন ঘরগুলো ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। আশপাশের আবাসিক ঘরগুলো দীর্ঘদিন মেরামত না করায় আয়ুষ্কাল পুরিয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ছে। নিম্ন আয়ের কিছু পরিবার ও পুরোনো কিছু শ্রমিকের পরিবার-স্বজনেরা নামমাত্র ভাড়ায় এসব ঘরে বসবাস করছেন। তবে বৃহদায়তনের এ কারখানায় দেড় দশক ধরে নেই জনচাঞ্চল্য।
‘চাহিদার আলোকে আধুনিকায়ন করতে না পারায় ১৯৯৩ সাল থেকে কারখানাটিতে লোকসান শুরু হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে সার্ভিস চার্জ পদ্ধতিতে উৎপাদন করেও লাভের মুখ না দেখায় ২০১১ সালে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় কারখানাটি। সেই থেকে বছরের পর বছর এটি চালুর প্রহর গুনতে গুনতে মারা গেছেন অনেক শ্রমিক। আবার অনেকেই জীবন-জীবিকার জন্য নিয়োজিত হয়েছেন অন্য পেশায়।’
কথা হয় কারখানার ব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প করপোরেশনের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান হলেও উৎপাদন বন্ধ থাকায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বে নেই। অন্য অফিসের পাশাপাশি আমাকে এবং হিসাব সহকারীকে দোস্ত টেক্সটাইল মিলের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রয়োজনের আলোকে মাসে ২-৪ দিন এখানে অফিস করি। এর বাইরে বৃহৎ এ শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাহারায় একজন হাবিলদার ও ৯ জন নিরাপত্তা প্রহরী দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি কারখানাটির যাবতীয় মেশিনারিজ স্ক্রেপ হিসেবে দরপত্রের মাধ্যমে চার কোটি ৯ লাখ টাকা মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কারখানার ভূমি এক শিল্প মালিককে লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ২০১৬ সাল থেকে আট লাখ ৩৬ হাজার টাকার ভূমি কর বকেয়া পড়ে আছে। বর্তমানে ৪৫ জন ভাড়াটিয়া ও কয়েকটি পরিবহন পার্কিং ভাড়া থেকে কিছু টাকা আয় হয়। ওই আয় থেকে এখানকার খরচের কিছু অংশ মেটানো যায়।
- আরও পড়ুন
- চাঁপাইনবাবগঞ্জের দড়ির খাটলা নজর কেড়েছে অভিজাতদের
- ঘোষণাতেই থেমে আছে পাবনা চিনিকল চালুর কার্যক্রম
- গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড পেল সুনিভার্স ফুটওয়্যার
- চাকরি ছেড়ে রশিতে স্বপ্ন দুই ভাইয়ের
- পরিত্যক্ত প্লাস্টিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আবুল কাশেম
মিলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘একসময় এই মিলের আওয়াজ শুনে মানুষ নামাজ পড়তো। সময় বুঝতো, ইফতার ও সেহরি খেতো। কারখানা শুরু ও শেষ হওয়ার সময়ে লোকারণ্য হয়ে উঠতো পুরো এলাকা। কিন্তু এখন আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ নেই।’
জীবন চন্দ্র দাস নামের এক তরুণ জানান, একসময় তার বাবা এ কারখানায় চাকরি করতেন। ওই সময়ে এ কারখানায় কাজ করতেন শত শত মানুষ। ফেনীর হাজার মানুষের কাজের ঠিকানা ছিল এ মিল। মিলটি স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণার পর আর চালু হয়নি। এটি চালু হলে আশপাশের মানুষের কর্মসংস্থান হতো। অর্থনীতিতে ভালো ভুমিকা রাখা যেতো।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো কারখানার ভেতরে একটি জরাজীর্ণ বাসায় থাকি। আমরা মনে করি, সরকারি-বেসরকারিভাবে যদি কারখানাটি চালু হয়, তাহলে আমাদের কাজের ব্যবস্থা হবে।’
এ বিষয়ে ফেনী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভাইস চেয়ারম্যান জাফর উদ্দিন বলেন, ‘মিলটি সরকারি বা বেসরকারিভাবে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলে চেম্বার অব কমার্স সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিয়ে পাশে থাকবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে মিলটি জরুরি ভিত্তিতে চালু করার দাবি জানাই।
তবে মিলটি সচল করতে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান ফেনী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুলতানা নাসরিন কান্তা।
তিনি বলেন, এটি সচল করা গেলে ফেনীর অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। আশপাশের এলাকায় অর্থনৈতিক প্রবাহ বাড়বে। এলাকার অনেক উন্নয়ন হবে।
এসআর/জিকেএস