এখনই কেউ বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই প্রত্যাশা কাল্পনিক: গভর্নর

1 month ago 11

এখনই কেউ বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই প্রত্যাশা কারও থাকলে তা কাল্পনিক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

রোববার (১০ আগস্ট) সকালে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক সংলাপে তিনি এ কথা বলেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এই সংলাপ আয়োজন করে।

বিনিয়োগ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, আমাকে তো স্থিতিশীলতা আনতে হবে। আর্থিকখাতে কেবল স্থিতিশীলতা এসেছে, রাজনৈতিকখাতে তো আসেনি। সিকিউরিটি সিচ্যুয়েশন তো এখনো আনস্টেবল। সবকিছু মিলিয়ে এখনই কেউ বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই প্রত্যাশা যদি কারও থাকে, আমি বলবো সেটা কাল্পনিক।

তিনি বলেন, আমাকে বাস্তবসম্মত হতে হবে। বিনিয়োগ পাইপলাইনে আমরা দেখতে পারছি, দেয়ার আর পজিটিভ সাইনস অব দ্যাট। কিন্তু আরেকটু সময় লাগবে। সামনে নির্বাচন, এই মুহূর্তে হয়তো বড় কোনো বিনিয়োগকারী আসতে চাইবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আসতে চাইবে না; পরবর্তী সরকার যদি সব চেঞ্চ করে ফেলে। লেটস টক টু দ্য নেক্সট গভর্নমেন্ট, এটা খুব স্বাভাবিক পলিটিক্যাল প্রসেস।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘প্রতি মাসে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার করে আমদানি করছি। তাতে কি আমদানি কম হচ্ছে? বাজারে কি কোনো শর্টেজ আছে? কোনো পণ্যের অভাব আছে? হয়তো বলতে পারেন ক্যাপিটাল মেশিনারি ইমপোর্ট করেছি না। লেজিটিমেট কোয়েশ্চেন। দ্য আনসার ইজ হু ইজ গোয়িং টু ইনভেস্ট ইন দিস ইনভারনমেন্ট (এখন এখানে কে বিনিয়োগ করবে)।

‘আমরা জানি যে আমরা খাদের কিনারায় ছিলাম সেখান থেকে যদি দ্রুত ফেরত আসতে না পারি তাহলে খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটা (আশঙ্কা) অনেক বেশি।’ যোগ করেন গভর্নর।

গভর্নর আহসান মনসুর বলেন, আমাদের দুটো চ্যালেঞ্জ ছিল। একটা হলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, আর রিফর্ম এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়া যেন ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক তারা যেন এটাকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আরও সুদৃঢ়ভাবে আর্থিকখাতকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর্থিকখাত প্রতিষ্ঠা এক বছর বা দুই বছরে সম্ভব না। এটা চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার শুরুটা যেন আমরা করে দিতে পারি সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

সংলাপে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার যখন শাসনভার গ্রহণ করলো, তার এক সপ্তাহ পর ১৪ আগস্ট আমরা একটা আলোচনা করেছিলাম যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী। তখন আমাদের অর্থনীতি বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন হচ্ছিল। টাকার বিনিময় হারের অবনমন হচ্ছিল খুব দ্রুত। সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল। উচ্চমূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়ছিল, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমছিল। এমন একটা অবস্থায় ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট সিপিডির পক্ষ থেকে এসব চ্যালেঞ্জের কথা বলি।

‘এখন এক বছর পর যখন ফিরে তাকাচ্ছি, তখন মূল্যায়নের একটা সময় এসেছে, প্রয়োজনীয়তা ও দেখা দিয়েছে।’ যোগ করেন তিনি।

নাজুক পরিস্থিতি থেকে ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যাওয়ার চেষ্টা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের তারিখ মোটামুটি ঘোষণা হয়েছে। যত আলোচনা বা সমালোচনা করি না কেনো গোষ্ঠীগতভাবে রাজনীতিবিদরা আমাদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নগুলো ধারণ করেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গঠিত টাস্কফোর্স যেসব সুপারিশ করেছিল, তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। শ্রম খাত, গণমাধ্যম, নারী ও স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি দেখছি না। আর শিক্ষায় তো কমিশন হয়নি।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গভর্নর বলে গেলেন বিপদের সময় জনশক্তি ও গার্মেন্টস খাত তাদের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন গত ৩৬৫ দিনে আমাদের জন্য কী করেছেন? অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে টেক্সটাইল খাতে করপোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। ফিনিসড প্রোডাক্ট আসবে শুল্ক ছাড়া, কিন্তু কাঁচামাল, তুলায় ২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তারওপর চাঁদাবাজ তো আছেই। গ্যাস ও বিদ্যুৎ নেই। গত ৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল আমি কিছু দেখতে পাইনি। আমি গঠনমূলক সমালোচনা করছি, এটাকে তিরস্কার ভাববেন না।

তিনি বলেন, জনশক্তির জন্য কোনো ট্রেনিং সেন্টার করেছেন? মালয়েশিয়া দেখেছি ভারতীয় দক্ষ শ্রমিক যারা নিজের দেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে বেশি বেতনে কাজ করছে। আমাদের শ্রমিক ঘরমোছার কাজ করে নিম্ন বেতনে। বাজেটে ওই সেক্টরের জন্য কিছুই রাখেনি। আমার সেক্টরে ১ হাজার ৮৫০টি কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে ৩৬৫ দিনে ১ হাজার ৮৫১টি হয়নি, বরং কিছু কমেছে। এটাই বাস্তবতা। পলিসি সংস্কার হয়নি।

ব্যাংক লুটপাট প্রসঙ্গে রাসেল বলেন, লুটপাটে যে ব্যাংক নষ্ট হয়ে গেছে, তাকে আবার কেন টাকা দিচ্ছেন? আপনি গ্রাহককে টাকা দিয়ে ওই ব্যাংক বন্ধ করে দেন। চোরগুলোকে কেন টাকা দিচ্ছেন, চোরের মালিকানা কিন্তু কখনই নষ্ট হবে না। আবার ছোবল মারবে। ওই ব্যাংক বন্ধ করে ভালো ব্যাংকের শাখা বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থান ঠিক রাখতে পারেন। তাতে সবাই খুশি হবে। ছোট একটি দেশে এতগুলো ব্যাংক সত্যিই অবাক করার মতো। বাংলাদেশের মতো পরিবারিকভাবে ব্যাংক কোথাও দেওয়া হয় না। ক্রিকেটে ছক্কা মারতে পারলেই তাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়।

শ্রমিক নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আগের সরকারের সমালোচনা করলে বলা হতো স্বাধীনতাবিরোধী। আর এখন বলা হয় ফ্যাসিবাদের দোসর। শুধু দোসর খোঁজেন, ভাসুরকে আড়াল করছেন কেন? একই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে ভিন্ন ফলাফল আশা করেন কীভাবে?

বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে চাঁদাবাজির প্রভাব- এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। সেটা রাজনীতি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে কেমন প্রভাব পড়ে আলোচনা করা দরকার।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া। অর্থনীতি স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে এই সময় কাজ হয়েছে। মানিলন্ডারিং বন্ধ হয়ে গেছে। যারা লন্ডারিং করতো তারা তো পালিয়ে গেছে। মানিলন্ডারিং বন্ধ হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের উচিত ছিল স্বৈরাচারের বাজেট চালিয়ে না যাওয়া। ওই বাজেট বাদ দিয়ে সামাজিক বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে নতুন বাজেট দিতে পারতাম।

এসএম/ইএ/জেআইএম

Read Entire Article