এখনো পানিবন্দি হাজারো মানুষ, বাড়ছে খাদ্য সংকট-রোগবালাই

1 month ago 24

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গেল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। এরমধ্যে ফেনীতে পানি নেমে গেলেও নোয়াখালীতে এখনো কাটেনি বন্যার রেশ। গত ১০ দিন ধরে পানিবন্দি নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। ফলে সেখানকার বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। বন্যা-পরবর্তী খাদ্য সংকটের পাশাপাশি প্রাদুর্ভাব বেড়েছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের। তাদের ঘরগুলোও এখনো বসবাস অনুপযোগী। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন নারী-শিশু ও বৃদ্ধরা।

সরেজমিনে গত ৫ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ৯ নম্বর দেউটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ আর অসহায়তার চিত্র। সেখানকার অধিকাংশ রাস্তাঘাটে এখনো হাঁটু সমান পানি। কোথাওবা তার একটু নিচে।

এখনো পানিবন্দি হাজারো মানুষ, বাড়ছে খাদ্য সংকট-রোগবালাই

ইউনিয়নের নবগ্রামের ব্যাপারী বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির সাতটি পরিবারই পানিবন্দি৷ সবার রান্নাঘরে পানি এখনো থৈ থৈ করছে। বসতঘর থেকে পানি নেমে গেলেও কাদামাটির মধ্যেই বসবাস করছেন সাতটি পরিবারের প্রায় ৪০ জন মানুষ। কোনো ঘরেই নেই মাটির চুলায় রান্নার ব্যবস্থা। শিশু, বৃদ্ধ আর অসুস্থ মানুষদের নিয়ে এই পরিবারগুলো পানিবন্দি দিন কাটাচ্ছেন।

এক সপ্তাহ ঘরে বাজার ছিল না, কোনো রকম শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করেছি। পানি আর কাদামাটিতে চলাচল করতে করতে পায়ে ক্ষত হয়ে গেছে। পানি নামছেই না। ঘরের ভেতর ইট, কাঠ আর পাটের বস্তা বিছিয়ে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে। আশপাশের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও একই অবস্থা।- স্থানীয় বাসিন্দা নুরনবী

বাড়ির বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা অনেক কষ্টে আছেন। এখানকার কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন। বাকিরা হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল রেখে যেতে পারছেন না। এমন অবস্থায় ঘরেও থাকতে পারছেন না, আশ্রয়কেন্দ্রেও যেতে পারছেন না। সবার ঘরের মেঝে ভেঙে গেছে। পানি নামলে তাদের যেন দ্রুত পুনর্বাসন করা হয়। অন্যথায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

বাড়ির ষাটোর্ধ্ব বয়সী নুরনবী জাগো নিউজকে বলেন, গত এক সপ্তাহ ঘরে বাজার ছিল না, কোনো রকম শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করেছি। পানি আর কাদামাটিতে চলাচল করতে করতে পায়ে ক্ষত হয়ে গেছে। পানি নামছেই না। প্রতিদিন আধা ইঞ্চি করে নামলেও এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতাম। আমার ঘরে সাতজন মানুষ। ঘরের ভেতর ইট, কাঠ আর পাটের বস্তা বিছিয়ে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে। আশপাশের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও এক অবস্থা। আপাতত অন্য কোথাও গিয়ে থাকার ব্যবস্থা নেই।

এখনো পানিবন্দি হাজারো মানুষ, বাড়ছে খাদ্য সংকট-রোগবালাই

আরেক বাসিন্দা মো. হারুন বলেন, আমার রান্নাঘর ডুবে চুলা ভেঙে গেছে। পানি ওঠার তিনদিন পর টয়লেটও ভেঙে গেছে। এমন দুর্দশায় কোনোদিন পড়িনি। পিচ্ছিল কাদামাটি, আর খাটের ওপর আরেকটা চৌকি দিয়ে রাতে কোনো রকম ঘুমাই। পুরো ঘরে কাদামাটি জমে থাকায় ইট-কাঠ বিছিন্ন কোনোরকম চলাচল করতে হচ্ছে। এভাবে আজ ১৫ দিন পানিবন্দি। আমরা যেভাবে আছি, এভাবে মানুষ বসবাস করতে পারে না।

আমরা কিছু খাল পরিষ্কার করেছি। পানি ধীরে ধীরে নামছে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টিও হচ্ছে, তাতে পানি বেড়ে যাচ্ছে। তবে সব জায়গায় এখনো আশ্রয়কেন্দ্র চালু আছে। পানি নেমে গেলে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।- জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর

‘খাবার জোগাড় করতে এখন অনেক কষ্ট। টাকা তো নাই, ঘর ঠিক করবো কীভাবে। ঘর ঠিক করতে দু-তিন লাখ টাকা লাগবে। আমাদের শিগগির পুনর্বাসনে সরকারের সহযোগিতা দরকার।’

শুধু সোনাইমুড়ী নয়, বন্যায় একই পরিস্থিতি জেলার চাটখিল ও সেনবাগ উপজেলায়ও। পানি না নামায় গত কয়েকদিনের দুর্ভোগে নাকাল বানভাসিদের জীবন। চাটখিল উপজেলার রাজারামঘোষ গ্রামের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন বলেন, কবে ভালো করে রান্না করেছি জানি না। খাটের ওপর আরেকটি চৌকি দিয়ে ঘুমাইছি সাতদিন। এখন ঘরের মেঝে থেকে পানি নামছে। কাদামাটিতে হাঁটায় বাচ্চাদের পায়ে ক্ষত হয়ে গেছে। পানিবাহিত রোগবালাইও বাড়ছে।

স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা বলছেন, ফেনীতে পানি দ্রুত এসে দ্রুত নেমে গেছে। নোয়াখালীতে পানি এসেছে ধীরে, ধীরে। এখন যাচ্ছেও ধীরে। একটা ইউনিয়নে পানিবন্দি প্রায় হাজার পরিবার থাকলেও পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা নেই।

সোনাইমুড়ী উপজেলায় ত্রাণ বিতরণের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী আশরাফুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, মানুষ দু-তিনদিন পানিবন্দি থাকলে শুকনো খাবার বা আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে সহায়তা করা যায়। কিন্তু দিনের পর দিন সহযোগিতা করা কঠিন। এখনো বন্যার পানি নামছে না। অনেকের বসতঘরে এখনো পানি, রান্নার চুলাও জ্বলছে না। কেউ কেউ এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন।

এখনো পানিবন্দি হাজারো মানুষ, বাড়ছে খাদ্য সংকট-রোগবালাই

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেনবাগ উপজেলার শিক্ষার্থীদের সংগঠন (পুসাস)-এর সদস্য হাসান সজীব জাগো নিউজকে বলেন, বন্যার শুরু থেকে আমরা ত্রাণ বিতরণ করছি। এলাকার পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে না। অনেকের চুলায় আগুন জ্বলছে না। বন্যায় সব তলিয়ে যাওয়ায় অনেক সামর্থ্যবান ও মধ্যবিত্ত পরিবারও সহায়তা চাইছে। কেউ কেউ ঘরের মায়া কিংবা চোর-ডাকাতের ভয়ে আশ্র‍য়কেন্দ্রে যাচ্ছেন না। পানি না নামা পর্যন্ত আমাদের এই অঞ্চলের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে।

নোয়াখালী জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এখনো প্রায় ১৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি। আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ৷

জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা কিছু খাল পরিষ্কার করেছি। পানি ধীরে ধীরে নামছে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টিও হচ্ছে, তাতে পানি বেড়ে যাচ্ছে। তবে সব জায়গায় এখনো আশ্রয়কেন্দ্র চালু আছে। পানি নেমে গেলে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।

সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা জাগো নিউজকে বলেন, শুরুতে উপজেলায় পানিবন্দি ছিল ৫০ হাজার, এখন সেটি ২০ হাজারে নেমেছে। আশ্রয়কেন্দ্র ছিল প্রায় ২০০টি, এখন তা কমে ১০০-এর নিচে। আমরা এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের জন্য উপর মহল থেকে সহায়তা পাইনি। তবে পুনর্বাসনের তালিকা তৈরি হচ্ছে, চিঠি এলে পাঠিয়ে দেবো।

এখনো পানিবন্দি হাজারো মানুষ, বাড়ছে খাদ্য সংকট-রোগবালাই

পানিবন্দি অবস্থার জন্য বিভিন্ন খাল ও নদী দখলকে দায়ী করছেন জেলার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। বন্যার পানি নিয়ে নোয়াখালী জেলা শহরে মানববন্ধন করেছেন তারা।

এক্স-মল্লিকা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সভাপতি সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, নোয়াখালীর দু-একটি জায়গা ছাড়া প্রধান সড়কে পানি নেই। তবে সড়কের দুপাশেই পানিবন্দি হাজারো মানুষ। গত কয়েকদিন বৃষ্টিও নেই, তবুও পানি নামছে না। আমাদের নদী ও খালগুলো অবৈধভাবে ভরাট এবং দখল হয়ে গেছে। যা পানিপ্রবাহে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

আরএএস/এমকেআর/জিকেএস

Read Entire Article