• আদালতের আদেশের ৬ মাসেও এনার বাস জব্দ করেনি দুদক
• বিআরটিসিতে দিলে যে কেউ নির্দিষ্ট ফি দিয়ে লিজ নিতে পারবে
• সরকারের সহায়তা চায় এনা কর্তৃপক্ষ
দেশে পরিবহন খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এনা ট্রান্সপোর্ট (প্রা.) লিমিটেড। ঢাকা থেকে ময়মনসিং, সিলেট, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন রুটে সেবা দেয় এনা। গত বছরের ৫ আগস্টের পর দখল হয়ে যায় এনার বড় কাউন্টারগুলো। ভেঙে পড়ে যাত্রীসেবা কার্যক্রম। এর মধ্যেই আদালত কোম্পানির প্রায় দুইশ বাস জব্দ করার আদেশ দেন দুদককে। সুষ্ঠু সমাধানে সরকারের হস্তক্ষেপ চাইছে প্রতিষ্ঠানটি।
এনা পরিবহনের স্বত্বাধিকারী আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক সহ-সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বালাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
৫ আগস্টের আগে-পরে যা ঘটেছে
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সূত্র জানায়, এনা পরিবহন প্রায় ৪০ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন রুটে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) এবং নন-এসি বাসে যাত্রী পরিষেবা দিয়ে আসছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রতিষ্ঠানটির মালিক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ আত্মগোপনে চলে যান। এরপর থেকে এ পরিবহন বন্ধে একের পর এক রাজনৈতিক চাপ আসতে থাকে। এক পর্যায়ে ঢাকার মহাখালী, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, সায়েদাবাদসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৫টি কাউন্টার দখল করে নেন অন্য পরিবহন মালিকরা। ফলে ঢাকা থেকে এনা পরিবহনের সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট-মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল, রংপুর, বুড়িমারী, পঞ্চগরসহ অন্যান্য দূরপাল্লার রুটে যাত্রী কমতে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সময়ে দেশে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে এনা পরিবহন। তাদের জন্য দেশের সব বাস টার্মিনালে বিশেষ টিকিট কাউন্টার (সবচেয়ে বড় ও সামনে) ছিল। তাদের বাস পার্কিং ও যাত্রী ওঠা-নামার জন্যও ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। এর মধ্যে মহাখালী টার্মিনালে এনা পরিবহন সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। এখন এগুলো দখলে নিয়েছেন পরিবহন মালিক সমিতির অন্য নেতারা। আর এনা পরিবহনকে টার্মিনালের ভেতরে ছোট্ট একটি জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আগের তুলনায় পরিবহনটিতে এক-তৃতীয়াংশ যাত্রী নেই।’
এনা পরিবহনের কাউন্টার দখলে পরিবহন মালিক সমিতির কোনো নেতা সম্পৃক্ত নন। কে বা কারা তা দখল করেছে, এ বিষয়ে সমিতির অফিসে কিছুই জানায়নি তারা।- বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. জোবায়ের মাসুদ
দুদকের জালে এনা পরিবহন
দুদক সূত্র জানায়, এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এনায়েত উল্যাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া এবং অর্থপাচারের অভিযোগের বিপরীতে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে দুদক। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তদন্তকাজ বেশিদূর যায়নি। যদিও দুদকের অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক সত্যতা মেলে। যে কারণে ২০২১ সালের ১৪ জুন সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ পাঠায় দুদক।
আরও পড়ুন
এনা পরিবহনের সব বাস জব্দের দাবি
এনায়েত উল্লাহর এনাসহ দুই পরিবহনের ১৯০ বাস জব্দের আদেশ
যেসব কারণে এত আলোচনায় এনা পরিবহন
ওই বছরের অক্টোবরে সম্পদের হিসাব জমা দেন এনায়েত উল্যাহ। যেখানে তিনি ২১৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন। সম্পদ অর্জনের উৎস হিসেবে এনা ট্রান্সপোর্ট (প্রা.) লিমিটেড, সোলার এন্টারপ্রাইজ, এনা শিপিং, এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির নাম উল্লেখ করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ওই তদন্তকাজ আর তেমন এগোয়নি।
পরে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ফের তদন্ত শুরু করে দুদক। এর মধ্যে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক আবেদনে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ, তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয় ও মেয়ে চাশমে জাহান নিশির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞায় আদালতে আবেদন করেন দুদকের সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম। ওই আবেদনে বলা হয়, খন্দকার এনায়েত উল্যাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস থেকে দৈনিক এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এখন তারা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ অবস্থায় তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।
ওই নিষেধাজ্ঞার পর গত ৪ মে মামলার শুনানি শেষে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির ১৯০টি বাস জব্দের আদেশ দেন আদালত। আদালতে দুদকের পক্ষ থেকে দেওয়া তালিকায় দেখা যায়, জব্দের আদেশ চাওয়া ১৯০টি গাড়ির মধ্যে ১৭৯টি এনা পরিবহনের নামে নিবন্ধিত। বাকি ১১টি নিবন্ধিত স্টারলাইন স্পেশাল লিমিটেডের নামে। কিন্তু আদালতের ওই আদেশের পর এখন পর্যন্ত বাসগুলো জব্দ করা হয়নি।
গাড়িগুলো জব্দের বিষয়ে জানতে চাইলে বিস্তারিত জানাতে পারেননি দুদকের সহকারী পরিচালক তানজির আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারছি না। এ বিষয়ে জানতে আদালতে যোগাযোগ করতে পারেন।’
এনা পরিবহনের সব বাস জব্দের দাবি নিসআর
গত ৫ নভেম্বর ঢাকার সেগুনবাগিচায় এক সংবাদ সম্মেলনে এনা পরিবহনের সব বাস জব্দের দাবি জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ) নামে একটি সংগঠন। ওই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, পতিত স্বৈরাচার সরকারের মদতে এনায়েতুল্লাহ প্রায় ১১শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পত্তি গড়ে তুলেছিলেন। ২০২৫ সালের ৪ মে আদালত এনা পরিবহন ও স্টার লাইন পরিবহনের ১৯০টি বাস জব্দের নির্দেশ দেন।
এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারছি না। এ বিষয়ে জানতে আদালতে যোগাযোগ করতে পারেন।- দুদকের সহকারী পরিচালক তানজির আহমেদ
পরবর্তীসময়ে বাসগুলো বিআরটিসিকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আরও একটি নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশের প্রায় ছয় মাস পার হলেও তা কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি দুদকের পক্ষ থেকে। বর্তমানে এনায়েত উল্যাহর মালিকানাধীন ১০০টির বেশি বাস বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে বাসগুলো জব্দ করে বিআরটিসিকে বুঝিয়ে দেওয়া হোক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, ‘এনার বাসগুলো জব্দ করে বিআরটিসিতে দেওয়া হলে তা লিজ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। অর্থাৎ, বাস কেনার চেয়ে কম টাকায় বিআরটিসি থেকে কেউ বাস লিজ নিলে অনেক টাকা লাভ করার সুযোগ থাকে। এ সুযোগটি কাজে লাগাতে চান তারা। এজন্যই নিসআকে সামনে রেখে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছেন তারা।’
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে নিসআর সভাপতি আব্দুল্লাহ মেহেদী দীপ্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা পুরো পরিবহন খাতের সিন্ডিকেট নিয়ে কাজ করছি। পরিবহন খাতে যেখানেই অনিয়ম হচ্ছে, আমরা প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এর মধ্যে এনা পরিবহনের বাসগুলো জব্দ নিয়ে আদালতের আদেশ রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, এ আদেশ বাস্তবায়নে কাজ করছে না সরকার। তাই আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। এ বিষয়ে আরও কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা আছে।’
সরকারের সহায়তা চায় এনা ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষ
দখল থেকে বাঁচতে গত ৬ নভেম্বর সরকারের সহায়তা চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় এনা ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষ। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘একটি স্বার্থান্বেষী মহল এনা ট্রান্সপোর্ট (প্রা.) লিমিটেডের রুট, কাউন্টার দখল করে নিয়েছে। এখন এই প্রতিষ্ঠানটির গাড়িগুলো দখল করার জন্য নানাভাবে খন্দকার এনায়েত উল্যাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অপপ্রচারের কোনো ভিত্তি নেই এবং এসবের সঙ্গে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ কিংবা তার কোম্পানির কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গত কয়েক মাসে এনা ট্রান্সপোর্টের অনেক রুট ও অনেক নিজস্ব কাউন্টার ওই স্বার্থান্বেষী মহল দখল করে নিয়েছে। রাস্তায় চলাচল করা প্রায় ৮০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। চিহ্নিত ওই দখলদার মহলটি এতেই ক্ষান্ত হয়নি। পুরো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য প্রতিদিন নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য এনা ট্রান্সপোর্টের সবগুলো গাড়ি দখল করা। এসব দখল-অপকর্মে ওই মহলটি সফল হলে হাজার হাজার কর্মচারীর কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ব্যাংক লোন পরিশোধে বিঘ্ন ঘটবে। প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে যাবে। আমরা এ ব্যাপারে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. জোবায়ের মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এনা পরিবহনের কাউন্টার দখলে পরিবহন মালিক সমিতির কোনো নেতা সম্পৃক্ত নয়। কে বা কারা তা দখল করেছে, এ বিষয়ে সমিতির অফিসে কিছুই জানায়নি তারা।’
এমএমএ/এএসএ/এমএফএ/এমএস

4 hours ago
8








English (US) ·