এপার ওপার
পারিজাত রহমান, মনোচিকিৎসক..., তার চেম্বারে বসে আছেন...বাইরে বেশ ঝড় বৃষ্টি..., পারিজাত রহমান খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল পড়ছেন, নতুন ক্লায়েন্ট, বাইশ বছর বয়সী একটা মেয়ে সারিতা খান। এই বয়সের মেয়েরা তার কাছে খুবই কম আসে। বেশিরভাগ আসেন মাঝ বয়সী থেকে বয়স্ক মানুষজন নয়তো টিনএজ কিডস নিয়ে মা-বাবা। এজন্য পারিজাত রহমান একটু বেশি আগ্রহ নিয়ে সারিতার পার্সোনাল ডিটেলস ইনফরমেশন পড়ছেন। সারিতা বাংলাদেশ এ জন্মেছে, অস্ট্রেলিয়া এসেছে প্রায় পনেরো বছর তখন সারিতার বয়স ছিল সাত বছর। বর্তমান এ ইউনিভার্সিটিতে সেভেনথ সেমিস্টার এ, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার এবং আইটিতে ডাবল গ্র্যাজুয়েশন করছে। থাকেন মা-বাবার সঙ্গে একটি ছোট ভাই আছে। জিপি রেফার করেছেন তার কাছে, এতটুকুই তথ্য। ‘পারিজাত রহমান’ মিনিটখানেক সময় নিয়ে কিছু ভাবলেন এরপর উঠে গেলেন ক্লায়েন্টকে ডাকতে। : ‘সারিতা খান’, কাম ইন প্লিজ ‘সারিতা’ একটা উইকলি ম্যাগাজিন দেখছিলো ওয়েটিং রুমে, তার নাম শুনে উঠে দাঁড়ালো, পারিজাত রহমানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলো... ‘পারিজাত রহমান’ সারিতাকে বসতে বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো, বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা মেয়েটার... উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ
পারিজাত রহমান, মনোচিকিৎসক..., তার চেম্বারে বসে আছেন...বাইরে বেশ ঝড় বৃষ্টি..., পারিজাত রহমান খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল পড়ছেন, নতুন ক্লায়েন্ট, বাইশ বছর বয়সী একটা মেয়ে সারিতা খান। এই বয়সের মেয়েরা তার কাছে খুবই কম আসে। বেশিরভাগ আসেন মাঝ বয়সী থেকে বয়স্ক মানুষজন নয়তো টিনএজ কিডস নিয়ে মা-বাবা।
এজন্য পারিজাত রহমান একটু বেশি আগ্রহ নিয়ে সারিতার পার্সোনাল ডিটেলস ইনফরমেশন পড়ছেন। সারিতা বাংলাদেশ এ জন্মেছে, অস্ট্রেলিয়া এসেছে প্রায় পনেরো বছর তখন সারিতার বয়স ছিল সাত বছর। বর্তমান এ ইউনিভার্সিটিতে সেভেনথ সেমিস্টার এ, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার এবং আইটিতে ডাবল গ্র্যাজুয়েশন করছে। থাকেন মা-বাবার সঙ্গে একটি ছোট ভাই আছে। জিপি রেফার করেছেন তার কাছে, এতটুকুই তথ্য।
‘পারিজাত রহমান’ মিনিটখানেক সময় নিয়ে কিছু ভাবলেন এরপর উঠে গেলেন ক্লায়েন্টকে ডাকতে।
: ‘সারিতা খান’, কাম ইন প্লিজ
‘সারিতা’ একটা উইকলি ম্যাগাজিন দেখছিলো ওয়েটিং রুমে, তার নাম শুনে উঠে দাঁড়ালো, পারিজাত রহমানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলো...
‘পারিজাত রহমান’ সারিতাকে বসতে বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো, বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা মেয়েটার... উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের স্লিম, ব্ল্যাকটি শার্টের ওপরে ডার্ক ব্রাউন জ্যাকেট আর ব্ল্যাক জিন্স পরে এসেছে, পায়ে কভার সু।
: কেমন আছেন?
: ঠিক জানি না, জিজ্ঞাসা করার জন্য ধন্যবাদ।
: বলুন, আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
: জি, আমি এখানে এসেছি বেশ কিছু প্রবলেম নিয়ে। কী করবো বুঝতে পারছি না, বা পারছি কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে কি না জানতে চাই।
: আচ্ছা বলুন, আমি শুনছি।
: আমি আমার মা-বাবার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকি। এখন আলাদা ফ্ল্যাটে মুভ করতে চাই, আমার প্যারেন্টের সঙ্গে আর থাকতে চাই না। আমি জানি এতে তারা অনেক হার্ট হবে কিন্তু আমি আর কোনো অপশনস খুঁজে পাচ্ছি না।
: আচ্ছা, ওনাদের সঙ্গে আপনার অ্যাডজাস্টমেন্টে সমস্যা?
: জি, তারা দুজন আমার বা আমাদের লাইফ হেল করে দিয়েছে।
: আপনি বুঝলাম, আপনাদের মানে?
: আমার ছোট ভাই, সায়ান। ওর বয়স সতেরো বছর, ইয়ার ইলেভেনে পড়ে। আমরা অস্ট্রেলিয়ায় পনেরো বছর হলো এসেছি। আমরা দুজনই বাংলা বলতে পারি, ইংরেজি তো অবশ্যই।
: বুঝেছি, বলুন
: সারিতা দু’সেকেন্ড চুপ করে রইলো। বাইরে বৃষ্টির শব্দ যেন আরও জোরে শোনা যাচ্ছিল। মেয়েটা দুই হাত জোড়া করে রাখল, আঙুলগুলো একটু কাঁপছিল। আমি বাংলাদেশি মনো চিকিৎসা খুঁজে বের করেছে যেন আপনি আমার সমস্যাটা বোঝেন কারণ আপনি বাংলাদেশের মানুষদের এবং কালচারটাও জানেন। এখন আপনার সঙ্গে বাংলায় কথা বলবো নাকি ইংরেজিতে?
: যেটা আপনার সুবিধা, আমি দুটো ভাষাতেই ওকে।
আচ্ছা, বাংলা বলছি, আপনি পারমিশন দিলে আমি আপনাকে তুমি করে বলতে চাই, আপনিও আমাকে তুমি করে বলবে প্লিজ...
: আচ্ছা, তুমি করেই বলো, আমিও বলবো...
: অনেক ধন্যবাদ, ওরা দু’জন মানে আমার মা-বাবা সবসময় ঝগড়া করে, সবসময়। ছোটবেলা থেকে দেখছি, ইদানিং অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে গেছে। বাসায় থাকলে মনে হয় আমার মাথার ভেতরেই যেন ঝড় লেগে থাকে। একটুও শান্তি নেই, কোনোদিন নেই। সারাক্ষণ আম্মুর অবজেকশন তোমার আব্বু এটা করেছে, এটা বলেছে আর আব্বুর অবজেকশন দেখো তোমার আম্মু কি বলছে, এটা কী ঠিক বলছে?
পারিজাত রহমান মাথা নেড়ে খুব ধীরে জিজ্ঞেস করলেন, এই ঝগড়াগুলোর বিষয়গুলো কী ধরনের? মানে সাধারণ আর্গুমেন্ট, না কি সিরিয়াস?
: না সিরিয়াস না সাধারণ কিংবা আমি জানি না, আমার তো মনে হয় এরা সময় কাটানোর জন্য ঝগড়া করে। বেশিরভাগ নিজেদের ভাই-বোন, মা-বাবা নিয়ে..., অনেক সময়ে এখানকার পরিচিত মানুষজন, আত্মীদের নিয়ে কিন্তু সব সময় চিৎকার, পরস্পর দোষারোপ, ব্যক্তিগত আক্রমণ… মাঝে মাঝে আমি খুবই ভয় পাই ওরা জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি বা মারামারি শুরু করে দেবে কি না। আমার ভাই, সায়ান। ওর তো আরও খারাপ অবস্থা। ও বলেছে স্কুল থেকে ওর বাড়ি ফিরতেই ইচ্ছে করে না। আমি খুবই ভয়ে থাকি, সায়ান ডিপ্রেশনে থেকে ভুল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ড্রাগে আসক্ত হয়ে যায় কি না কারণ তুমি তো জানোই যে এই বয়সে সবারই অনেক ধরনের বন্ধুবান্ধব থাকে, কখন যে কার পাল্লায় পড়ে যায়। এটুকু বলে সারিতা থামলো।
পারিজাত নোট নিতে থাকলেন আর জিজ্ঞাসা করলেন
: তুমি কী কখনো তোমার প্যারেন্টকে কাউন্সেলিং সাজেস্ট করেছিলে?
সারিতা হালকা হেসে মাথা নেড়ে বললো...অনেক বার, ওদের কাছে এটা বললেই– ‘তোমরা আমাদের অসম্মান করছ’ অথবা ‘আমাদের নিজেদের বিষয়ে বাইরে কেনো বলবো?’ এসব। আর সবচেয়ে বড় কথা, ওরা নিজেদের কোনো ভুল দেখে না। দু’জনই ভাবে, ‘ওরা ঠিক, ও আমরা ভুল।’
পারিজাত রহমান চেয়ারে হেলান দেওয়া ছিলেন, কিছুটা একটু এগিয়ে এসে বললেন
: তাহলে তোমরা দুই ভাইবোন মানসিকভাবে সবসময় স্ট্রেসের মধ্যে থাকো?
: জি … সবসময়।
আমি আর সায়ান দু’জনই মনে করি, ওদের সম্পর্কের ঝামেলা আমাদের জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে। আমি কখনোই একটা ‘নরমাল’ ফ্যামিলির মতো কিছু পাইনি। শান্ত শনিবার সকাল, একসাথে ব্রেকফাস্ট, চারজন মিলে ঘুরতে যাওয়া, রবিবার মুভি বা অপেরা দেখা, পরদিনের প্রস্তুতি.. এমন কিছুই না। শুধু ঝগড়া, অভিযোগ, পরস্পরকে দোষ রাগারাগি চিল্লাচিল্লি। অথচ কোনো দাওয়াত এ গেলে তারা হ্যাপি কাপল, সুন্দর হাসি মাখা ছবি। ওদের পাঁচটা পরিবারের একটা গ্রুপ আছে, ওদের সাথে বিভিন্ন ছুটিতে একসঙ্গে বেড়াতে যায় সেখানেও তারা হাসিখুশি। আম্মু আন্টিদের সাথে সারাক্ষণ আব্বুর নামের কথা বলে আব্বু আঙ্কেলদের সঙ্গে তুলনামূলক কম কিন্তু চান্স পেলেই আন্টিদের সামনে আম্মুকে খোঁচা মেরে কথা বলে।
সারিতা এতদূর বলে শ্বাস নিলো, জিজ্ঞাসা করলো সে পানি পান করতে পারবে কি না?
পারিজাত রহমান চুপচাপ সারিতাকে দেখছিলেন, শুনছিলেন মাথা নেড়ে হ্যাঁ সুযোগ সম্মতি দিলেন।
সারিতা পাশে রাখা পানির বোতল থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে পান করলো, তারপর আস্তে বলল
: আরেকটা ব্যাপার আছে, আমার বয়স মাত্র বাইশ। তারা এখনই আমাকে বলছে, ‘বিয়ের কথা ভাবো’, ‘বাংলাদেশে সম্পর্ক দেখছি’ কিন্তু ওদের নিজেদের দাম্পত্যই তো ভাঙা। ওরা যেভাবে একসাথে আছে এটা কে তো সংসার বলে না। ওদের মতো বিয়ে করে আসলেই কি হবে? তাছাড়া আমি বিয়ে করতে ভয় পাই, এখনই বিয়ের জন্য প্রস্তুত না। আমি লাস্ট সেমিস্টার শেষ করার পর চাকরি করতে চাই। বিয়ে যদি করি, আরো অনেক পরে...আর সমস্যা শুধু এগুলো নয়, তারা নিজেরা যা না সেটাই আমাদের হওয়ার জন্য প্রেশার দেয়।
: সেটা কেমন?
: ধরো আমাদের নামাজ পড়তে, পর্দা করতে, মসজিদে যেতে বলবে এমনকি আমার ভাইকে ইসলামিক স্কুলে দিয়েছে, কিন্তু আম্মু নিজে পর্দা করে না, ঠিকঠাক নামাজ পড়ে না, আব্বুও রেগুলার না নামাজে আর সারাক্ষণ দোষারোপ, ঝগড়া তো আছেই। আম্মুর কাছে আমার নানা-নানু, খালা-মামা নিষ্পাপ, তারা যা বলবে সেটাই ঠিক। নিজস্ব বিচার বিবেচনা ক্ষমতা নেই। কিছু হলেই তার ফ্যামিলিতে শেয়ার করে আর এখানে কিছু আন্টি আছে তাদের। আমাদের কোনো কিছু পার্সোনাল রাখতে পারে না। এই যে আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না সেটাও আম্মু সবাইকে বলে ফেলেছে, ওদের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হলে আমাকে প্রশ্ন করে! আমি খুবই এমবারাস হই, সেদিকে আম্মুর কোনো খেয়াল নেই। আমি আমি যে একজন আলাদা সত্তা ও ব্যক্তিত্ব, আমারও যে ইচ্ছা অনিচ্ছা বিরক্তিবোধ বা ভালোলাগা আছে এগুলো সে আমলেই নেয় না।
: ওদিকে আব্বু তো আরো এককাঠি, তার কথাই শেষ কথা। তার ভাই-বোন অবশ্যই সেরা, তারা যা বলে ঠিক বলে। নানাবাড়ির লোকজন কিছুই জানে না। ওদের কথা শোনার দরকার নেই। সে যা বলবে সেটাই শুনতে হবে এমনকি আব্বুর জন্যই আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হয়েছে আমি পড়তে চাইনি আমি আর্টস নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। সবকিছুতেই নজরদারি, এমনকি আমার ফ্রেন্ডরা কি পড়ছে, কেনো পড়ছে, অন্য কিছু কেন পড়লো না ইত্যাদি অনেক কিছু। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে যে কথা বলা ঠিক নয় এটাও এরা বুঝে না। আচ্ছা এগুলো কি বাংলাদেশের স্কুলে শেখানো হয় না বা পরিবার থেকে? আমি খুব ছোটবেলায় চলে এসেছি তো তখন ক্লাস টুতে পড়তাম ঠিক মনে করতে পারি না।
পারিজাত রহমান মনোযোগ দিয়ে সারিতাকে দেখছেন, মেয়েটার চেহারায় কি করুণ বেদনার ছাপ, দীর্ঘশ্বাস চেপে জিজ্ঞাসা করলেন
: আসলে দেশে একেক পরিবারের মানুষজন একেক রকমের, একেকজনের বেড়ে ওঠাও একেক রকমের। একটি রাষ্ট্র কখনো সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। পরিবারগুলোর প্রধানদের দায়িত্ব অধীনস্থ এবং সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলা সেক্ষেত্রে সেই দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পারিবারিক স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই একা রাষ্ট্র কখনো পুরো জাতির স্বভাব বদলে দিতে পারে না। আচ্ছা, তাহলে এখন তুমি ওনাদের থেকে আলাদা হতে চাও, কেন?
সারিতা মাথা নেড়ে বলল...,
: মানসিক শান্তির জন্য কিন্তু আবার অপরাধবোধও হয়। তারা ভাববে আমি তাদের ছেড়ে যাচ্ছি… কষ্ট পাবে দুজনেই।
আম্মু অনেক কষ্ট পাবেন, আন্টিদের অনেক কিছু বলবেন, তখন তারা হয়তো কমিউনিটিতে আরও অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে বেড়াবে, কারণ ওনারা আসলে ভেতরের খবরটা জানেন না। হয়তো আমার খালা মামা চাচারাও ফোন করবে, আমাকে বুঝবে বা ঝাড়ি দেবে। আমি ঠিক করেছি সবাইকে ব্লক করে রাখবো। শুধু ভয় হয় তারা যদি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বসে বা অসুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু আমি যদি এখনই না বের হই, মনে হচ্ছে আমি ভেঙে পড়ব। আমার বাসায় ঢুকলেই কেমন দম বন্ধ লাগে। এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে সারিতা থামলো।
বাইরের ঝড়টা যেন আরও ভয়ানক শব্দ করছে, আর রুমের ভেতর নিস্তব্ধতায় শুধু সারিতার দমচাপা কণ্ঠ কাঁপছিল।
পারিজাত রহমান নরম স্বরে বললেন—
: আচ্ছা, সারিতা… তুমি কি তোমার অনুভূতিগুলো আরও একটু খুলে বলতে পারবে? বিশেষ করে এই ‘ভেঙে পড়া’র ভয়টা…, এটা কোথা থেকে আসে?
সারিতা চোখ নিচু করে রইলো। কয়েক সেকেন্ড কোনো শব্দ করলো না। তারপর খুব আস্তে বলল
: ম্যাম… এই ‘ভেঙে পড়া’টা আসে… আমার নিজের ভেতর থেকেই। মনে হয় আমি আর নিতে পারছি না। আমি বাসায় ঢুকলেই শরীর ও মনের ভেতর চাপ তৈরি হয়। বুক ধড়ফড় করে। মাথাব্যথা শুরু হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় দৌড়ে বাইরে পালিয়ে যাই। কারণ আমি জানি, আবার ঝগড়া হবে। আবার ঝাড়ি খেতে হবে। আবার আম্মু আমাকে বলবে, ‘তোমার আব্বু এমন, তুমি দেখছো না…’ আর আব্বু বলবে, ‘তোমার আম্মু যা করছে তা ঠিক না।’
আমি কী এগুলো শোনার জন্যই জন্মাইছি ম্যাম? আমি ভীষণ ক্লান্ত।
পারিজাত খুব ধীরে মাথা নেড়ে বললেন—
: তুমি বলছিলে, তোমার ভাই সায়ানও মানসিকভাবে অনেক সমস্যায় আছে?
: জি ম্যাম। ও খুব শান্ত ছেলে, কিন্তু সাইলেন্টলি সব সহ্য করে। ওর বয়স কম, কিন্তু ওর ভেতরে যে কত জিদ, কত রাগ, কত অসহায়ত্ব জমে আছে, তা আমি জানি। অনেক রাতে আমার রুমে এসে বসে থাকে। কিছু বলে না, চুপচাপ মাঝে মাঝে চোখ দিয়ে পানি পরে শুধু। একদিন আমাকে বলল, ‘আমাদের এটা কোনো ফ্যামিলি না, আচ্ছা আপু ওরা কেনো একসাথে থাকে?’
এই কথাটা শোনার পর আমি সেই রাত ঘুমাতে পারিনি। মনে হয় আমি বড় হয়েও আমার ভাইটাকে বাঁচাতেও পারছি না।
পারিজাত রহমান ল্যাপটপে কিছু জিনিস টাইপ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো..
: তুমি কি কখনো ভেবেছ, তুমি আলাদা হয়ে গেলে সায়ানের ওপর আরও বেশি মানসিক চাপ পড়বে?
সারিতা চোখ বন্ধ করল।
: জি… ভেবেছি, এজন্যই এতদিন কাটিয়েছি।
কিন্তু যদি আমি ভেঙে যাই, আমি তো ওকে কোনো সাহায্যই করতে পারব না। আমার নিজের মানসিক স্বাস্থ্যই এখন ভেঙে পড়ার দোরগোড়ায়। সায়ান আমাকে বলেছে, ওর ইয়ার টুয়েলভ ফিনিস হলে ও নিজেও এই বাসা ছেড়ে দিয়ে ইউনিভার্সিটির ডর্ম এ উঠবে। আমাকে বলেছে, ‘তুমি মুভ করো আপু। তুমি ভালো থাকো, এরা আমাদের জীবন ধ্বংস করে দেবে, এরা আমাদের একটুও ভালোবাসে না। এরা ভয়ংকর স্বার্থপর আর নিজেকে ছাড়া কারো কথা ভাবে না।’
সারিতা একটু থেমে গভীর নিঃশ্বাস নিলো, এরপর বলা শুরু করলো...
: ম্যাম, আমি নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকি। কান্না আসে, কিন্তু কাঁদতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কি ঠিক আছি? নাকি কোনো ভুল করছি?
আমার বয়স বাইশ, আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, কিন্তু বাসার ভেতরে আমি কখনোই নিজের মতামতের মূল্য পাইনি। ওরা আমার বাবা-মা, কিন্তু ওদের আচরণে মনে হয় আমি কোনো ব্যক্তি নই, শুধু একটা অবজেক্ট, যার জীবন তাদের কথা মতো চলবে।
পারিজাত রহমান নরম স্বরে বললেন, হুম, তুমি বলতে চাচ্ছো ওনারা দুজন নিজেদের মতো আচরণ করে তোমাদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং তোমাদের জন্য তাদের প্রত্যাশা ভিন্ন যা তোমাদের মত সঙ্গে মিলছে না?
: জি ম্যাম। ওরা আমাদের রিলিজিয়াস হতে বলে কারণ নানা নানু দাদা তো জিজ্ঞাসা করে আমরা নামাজ পড়ি কি না ধর্ম পালন করি কি না, কিন্তু ওদের নিজেদের ধর্মের প্র্যাকটিস নেই। ওরা বলে, ‘নামাজ পড়ো, শালীন পোশাক পরো’ কিন্তু আম্মু নিজেই ঠিকমতো নামাজ, পর্দা করে না।
ওরা বলে আমরা তোমাদের জন্য আমরা এত কষ্ট করছি, তোমরা কেন আমাদের কথা শুনবে না? অথচ ওরা সো কলড কমিউনিটি নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের কোনো সময় ই দেয় না। শুধু ঝগড়ার সময় পক্ষ নেওয়ার জন্য ডাকে।
ওরা বলে, বিয়ে করো, আমরা তোমার ভালো চাই।’ কিন্তু তাদের নিজেদের বিয়ে তো যুদ্ধক্ষেত্র।
: ম্যাম, আমি তাদের দ্বিমুখী জীবন দেখতে দেখতে নিজের ওপরই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। আমি এখন প্রেমে বিশ্বাস করি না, বিয়েতে ভয় পাই, আমি শুধু শান্তি চাই, ভালোভাবে বাঁচতে চাই। চাই এমন একটা জায়গা…, যেখানে আমি ঠিকঠাক নি:শ্বাস নিতে নিতে পারব। এখন একটা পার্ট টাইম জব করি, গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলে ফুলটাইম জব করবো, একসময় আমার ভাইকেও নিয়ে আসবো আমার কাছে।
বাইরে বজ্রপাত হলো, পুরো ঘরটা আলোর ঝলকানিতে ভরে উঠল। সারিতা হালকা কেঁপে উঠল যেন।
পারিজাত রহমান একটু নরম স্বরে বললেন,
: সারিতা, তুমি যা অনুভব করছো তা কি কোনো বিশেষ ঘটনা থেকে শুরু হয়েছে? অর্থাৎ এমন কিছু কি হয়েছে তোমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে, ‘এবার আর না, আমাকে বের হতেই হবে’?
প্রশ্ন শুনে সারিতার দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো, সারিতা পাশে রাখা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ মুছল।
: জি হয়েছে, গত সপ্তাহে… (সারিতার মুখটা শক্ত হয়ে গেল)
আম্মু আর আব্বুর ঝগড়া এতটাই বেড়ে গেছিল যে আমি আমার রুমের ডোর খুলতেই একটা ছুড়ে ফেলা মগ ভেঙে পড়ে আছে একদম আমার সামনে। আমার মনে হলো আমি যদি এক সেকেন্ড আগে দরজা খুলতাম, মগটা এসে আমার মুখে লাগত।
আম্মু তখনও চিৎকার করছে আর আব্বুও চিৎকার করে জবাব দিচ্ছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর মনে হচ্ছিল পালিয়ে যাই কোথাও, আমি আর পারছি না। সায়ান ওর রুম থেকে বের হয়ে এসে বল্লো, ‘তোমরা যদি না থামো, আমি এখনই পুলিশ কল করবো। তোমাদের দুজনেরই কাউন্সেলিং দরকার। প্লিজ হয় তোমরা রিলেশনশিপ কাউন্সেলিং করো নয়তো আলাদা হয়ে যাও, আমাদের বাঁচতে দাও।’
আব্বু আম্মু হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেলো সেদিনের মতো সায়ান এর কথা শুনে কিন্তু পরে সায়ানকে অনেক বকাঝকা করেছে, আব্বু বলেছে ‘আমার ছেলে হয়ে তুমি এমন কথা বললে? তুমি তো মানুষ হওনি, তোমার চেয়ে কুকুর পালা ভালো, কুকুর প্রভুভক্ত হয়।’ আম্মু বলছে, ছিহ, আমি তোকে পেটে ধরেছিলাম, তু্ই আমাকে পুলিশ এ দিতে চাস ইত্যাদি আরও অনেক কটূ কথা।
আমি ঠিক বুঝি নাই, সায়ান ভুল কি বলেছে? বরং এটা আমার আরও আগেই বলা উচিত ছিলো, আমি ভয়ে বলতে পারিনি, ও পেরেছে। আমি সেই রাতেই ঠিক করি, আমি আর এই বাসায় থাকবো না, এখানে থাকলে আমি শেষ হয়ে যাব, সাথে সায়ানও।
রুমে আবার নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
পারিজাত রহমান এবার খুব স্থির, খুব শান্ত স্বরে বললেন—
: ধন্যবাদ, সারিতা, তুমি খুবই ভালো সহনশীল এবং অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ। তোমার ভাই সায়ান সাহসী। তোমার ভয়, তোমার লড়াই, তোমার অভিজ্ঞতা, সবই খুব বাস্তব এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি তোমার পাশে আছি। আজকের সময় শেষ, পরের সেশন এ আমি আরও কিছু কথা শুনবো এবং আমরা আলোচনা করব, কীভাবে তুমি নিরাপদে, আত্মসম্মান বজায় রেখে, একটি পরিকল্পনা করতে পারো সাথে তোমার ভাইকেও সেইফ রাখতে পারো। নেক্সট সপ্তাহে আবার দেখা হবে একই দিনে, একই সময়ে, ঠিক আছে?
সারিতা শুধু মাথা নেড়ে চোখ নামিয়ে বলল,
: জি ম্যাম, আমি আসবো,
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে আমার কষ্টের কথা শোনার জন্য।
অনেক জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও পারিজাত রহমান সিরিজ লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বেশ অনেক অনেক দিন পর আবার লেখা শুরু করলাম। কয়েকটা পর্ব লিখবো হয়তো। জানিনা কেমন লাগবে পাঠকদের! জানালে খুশি হবো, অশেষ কৃতজ্ঞতা।
এমআরএম/এমএস
What's Your Reaction?