সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে সৃষ্টি হওয়া পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, এতগুলো মানুষের প্রাণ নিয়ে নেওয়া হবে, এটাকে আমরা কীভাবে ক্ষমা করবো? এটা তো আসলে ক্ষমা করারও কোনো সুযোগ নেই। এবার যদি আমরা বিচার না পাই, তাহলে বাংলাদেশ থেকে বিচার শব্দটা হয়তো একদম উঠে যাবে।
বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনের দাবিতে’ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংগঠনটির এই সদস্য, পরিবেশ আইনবিদ।
তিনি বলেন, সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই বলেন বা প্রশাসনিক অবস্থান থেকেই বলেন, সংকট নিরসনে কোনো আন্তরিক বা কার্যকর অবস্থান আমরা দেখছি না। সরকার যেটা করছে সেটা কোনো রকমে একটা প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা। কিন্তু যে ক্ষতটা আমাদের হৃদয়ে দিয়ে গেছে, এটাকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো কেবল শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করেনি, গোটা সমাজের সবাইকে প্রভাবিত করেছে।
তিনি বলেন, আমরা কেউই আর মানসিকভাবে ভালো থাকতে পারছি না। এ অবস্থা থেকে জনগণকে একটা স্বস্তির জায়গায় নিতে তো আর আপনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন না। আপনাকে ভিন্ন কৌশল নিতে হবে।
তিন আরও বলেন, এটা আসলে ক্ষমা করার কোনো সুযোগ নেই। এতগুলো মানুষের প্রাণ নিয়ে নেওয়া হবে, এটাকে আমরা কীভাবে ক্ষমা করবো? এটা তো আসলে ক্ষমা করারও কোনো সুযোগ নেই।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এবার যদি আমরা বিচার না পাই, তাহলে বাংলাদেশ থেকে বিচার শব্দটা হয়তো একদম উঠে যাবে। কাজেই এবার যার যার অবস্থানে থেকে আমাদের বিচারের দাবি জানাতে থাকতে হবে এবং বিচার না হওয়া পর্যন্ত, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মহলের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে, জাতিসংঘের ইনভলভমেন্ট (সম্পৃক্ত) নিশ্চিত করে বিচার না হওয়া অবদি আমাদের চুপ হয়ে যাওয়ার বা শান্তনা পাওয়ার বা শান্ত হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ আমি দেখতে পারছি না।
এসময় তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য আমরা দেখলাম নিরাপত্তার নামে ছয়জন সমন্বয়ককে আটকে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তা যদি দিতেই হয়, তাহলে বাসায় রেখে নিরাপত্তা দেওয়া হোক। আপনি নিরাপদ বোধ করবেন আপনার মা-বাবার কাছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০০৮ সালে তরুণদের ভোটেই আওয়ামী লীগ ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেছিল। এখন এই তরুণরাই আওয়ামী লীগের বিপক্ষে চলে গেছে। সরকারি দলের কর্মী না হলে সরকারি বা বেসরকারি চাকরি পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। এমনকি ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরারকে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের ভোটাধিকার, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ সরকার জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় না আসায় তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এ কারণে তারা বল প্রয়োগ করছে।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, কোটা বৈষম্য দূরকরণের এ আন্দোলন এখন আর শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রীর শিক্ষিকা পুত্রবধূ, সিলেটের শ্রমিক লীগের নেতার সন্তান এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। এটাকে যদি আমরা গণঅভূত্থান না বলি, তাহলে গণঅভূত্থান কাকে বলবো? এ আন্দোলন রুখতে সরকার হেলিকপ্টার পর্যন্ত ব্যবহার করেছে। ঘরের মধ্যে থাকা শিশুকে, নারীকে হত্যা করেছে। যার ফলে এ সরকারের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে।
তিনি বলেন, এরশাদের সময়ও একসঙ্গে এত মানুষ হত্যা হয়নি। আমরা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় বলতাম, তার হাতে ছাত্র রক্ত। এখন আওয়ামী লীগের হাতেও ছাত্রদের রক্ত। ছাত্রদের কোনো আন্দোলন কখনো বৃথা যায়নি। এ আন্দোলনও বৃথা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বুধবার সাবেক ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠকে তির্যক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। কারণ, তিনি মতবিনিময় সভা ডেকে কারো সঙ্গে কোন কথা না বলে সংবাদ সম্মেলন করেন। যিনি নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংলাপে বসে ডিজঅনেস্টি করেন, তিনি বিরোধী পক্ষের সঙ্গে কীভাবে সংলাপ করবেন।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, কোটা সংস্কারের বিষয়টি আদালতের কাজ নয়। এটি নির্বাহী বিভাগের কাজ। আইনমন্ত্রী জোর করে এটাকে আদালতে নিয়ে গেছেন এবং কালক্ষেপণ করেছেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি দিয়ে না, আমরা একটা নতুন সংবিধান রচনা করতে চাই এবং এই নতুন শিক্ষার্থী, নতুন ছাত্র আন্দোলন দিয়ে নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে সত্যিকারের চেতনা- একটা বৈষ্যমবিরোধী, একটা গণতান্ত্রিক, একটা মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন ধর্ম নিরোপেক্ষ রাষ্ট্র নির্মাণের যে সদন আমরা লিখেছিলাম, সেটি আমরা আবারও আমাদের বুকের রক্ত দিয়ে লিখতে চায়।
এমএএস/এমএইচআর/জিকেএস