‘এমন জ্বর জীবনেও হয়নি, নামতেই চায় না’

3 weeks ago 14

‘এমন জ্বর জীবনেও হয়নি, নামতেই চায় না। তীব্র ব্যথা, শরীর দুর্বল, হাঁটার শক্তিই পাচ্ছিলাম না। অথচ পরীক্ষা করে সুনির্দিষ্ট কোনো রোগ ধরা পড়েনি।’

পুরান ঢাকার ফাতেমা বেগম জ্বর থেকে সেরে উঠে জানালেন এমন অভিজ্ঞতার কথা।

চিকিৎসক মঈনুল খোকন গত ৮ আগস্ট থেকে চারদিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। জ্বরের মাত্রা কমলেও শরীরে দুর্বলতা ও ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে আরও কদিন লেগেছে। তিনি নিজেই চিকিৎসক। তাই সতর্ক থাকার কথা জানিয়ে বলেন, ‘শুধু প্যারাসিটামল ইনজেকশন নিয়েছি। চেষ্টা করেছি দেশি ফলমূল খেতে, যাতে শরীর কিছুটা স্বাভাবিক থাকে।’

‘এমন জ্বর জীবনেও হয়নি, নামতেই চায় না’

মিরপুরের নাজমুল ইসলামও একই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন। তিন-চার দিন ধরে জ্বর। তারপর দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা। পরীক্ষা করেও কিছু ধরা পড়েনি। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি আমড়া, মাল্টা, পেয়ারা, জাম্বুরা, পেঁপে, লেবুর শরবতের মতো দেশি ফলমূল নিয়মিত খেয়েছেন।

জ্বর নামতেই চায় না, তীব্র ব্যথা, শরীর দুর্বল, হাঁটার শক্তিই পাচ্ছিলাম না। অথচ পরীক্ষা করে সুনির্দিষ্ট কোনো রোগ ধরা পড়েনি। -ভুক্তভোগী

তাদের মতো রাজধানীতে তো বটেই, বিভাগীয় ও জেলা শহরে এখন ঘরে ঘরে জ্বর। প্রকৃতিতে এটি সাধারণ ভাইরাল জ্বর হলেও আক্রান্তদের মতে এ ধরনের জ্বরে ধকল অনেক বেশি।

হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ

রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ভিড় বাড়ছে। শয্যা সংকটের কারণে অনেক হাসপাতালে করিডোর, বারান্দা ও সিঁড়ির জায়গা ব্যবহার করতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও একই পরিবারের একাধিক সদস্য একসঙ্গে ভর্তি হচ্ছেন।

‘এমন জ্বর জীবনেও হয়নি, নামতেই চায় না’

চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীর চাপ শুধু ভাইরাল জ্বর নয়, বরং ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও সর্দি-কাশি রোগীর জন্যও সমানভাবে বাড়ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, এ বছর জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। চার-পাঁচ দিন জ্বর, শরীর ব্যথা, দুর্বলতা ও কাশি, এমন উপসর্গের রোগী প্রতিদিনই আসছেন।

বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা: ভাইরাসের মিশ্র আক্রমণ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়। লক্ষণ দেখে ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরনের জ্বর মনে হলেও বর্তমান সময়ে এটি ছোঁয়াচে এবং একই পরিবারের একাধিক সদস্য কয়েকদিনের ব্যবধানে আক্রান্ত হচ্ছেন। শহরে এর প্রকোপ বেশি, তবে গ্রামীণ অঞ্চলও বাদ যাচ্ছে না।

ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, এমনকি জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ একসঙ্গে চলছে। তার সঙ্গে টাইফয়েড ও প্যারা-টাইফয়েড জ্বরও দেখা দিচ্ছে। ফলে একেকজন রোগীর উপসর্গে ভিন্নতা থাকলেও প্রাথমিক ধাপ একই। -ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ জানান, বর্তমানে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, এমনকি জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ একসঙ্গে চলছে। তার সঙ্গে টাইফয়েড ও প্যারা-টাইফয়েড জ্বরও দেখা দিচ্ছে। ফলে একেকজন রোগীর উপসর্গে ভিন্নতা থাকলেও প্রাথমিক ধাপ প্রায় একই। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি।

‘এমন জ্বর জীবনেও হয়নি, নামতেই চায় না’

তিনি সতর্ক করে বলেন, এক দিনের বেশি জ্বর থাকলে অবশ্যই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা করাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া প্যারাসিটামলের বাইরে কোনো ওষুধ নেওয়া যাবে না। খাবারে প্রচুর পানি, ডাব, ওরস্যালাইন, গ্লুকোজ ও ফলের রস থাকতে হবে। বমি, পাতলা পায়খানা, কিংবা পূর্বের জটিল রোগ (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি বা লিভারের অসুখ) থাকলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত।

ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বাড়ছে শঙ্কা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ এক হাজারেরও বেশি। শুধু আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৪ হাজারের বেশি রোগী। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সেপ্টেম্বরের শেষভাগ পর্যন্ত এ প্রবণতা আরও বাড়বে।

সরকার এরইমধ্যে হাসপাতালগুলোতে ফ্লু/জ্বর কর্নার চালু করেছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা শয্যা, পর্যাপ্ত স্যালাইন, আইভি ফ্লুইড ও মশারি সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছে।

কেন বাড়ছে ভাইরাল জ্বরের প্রকোপ

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েকটি কারণ একত্রে বর্তমান পরিস্থিতিকে তীব্র করছে। এগুলো হলো, অতিরিক্ত গরম ও অনিয়মিত বৃষ্টিতে ভাইরাসের বিস্তার বাড়ছে; ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড সবই একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে; একই পরিবারের সদস্য বা প্রতিবেশীদের মধ্যে দ্রুত সংক্রমণ ঘটছে; জ্বরকে অবহেলা করে দেরিতে চিকিৎসা নেওয়া বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ খাওয়া জটিলতা বাড়াচ্ছে এবং সীমিত শয্যা ও কর্মী, ডেঙ্গুর বাড়তি রোগী সব মিলিয়ে হাসপাতালগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে।

জ্বর হলে করণীয়

  • জ্বর তিন দিনের বেশি থাকলে পরীক্ষা করান।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা শক্তিশালী ওষুধ খাবেন না।
  • নিয়মিত হাত ধোয়া, পরিষ্কার পানি পান, মশারি ব্যবহার ও মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করুন।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও তরল খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করুন।
  • শিশু, গর্ভবতী নারী ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা নিন।

এসইউজে/এসএনআর/এমএমএআর/জেআইএম

Read Entire Article