ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ সুপার (এসপি) ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) পদায়ন লটারির মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন সামনে এসেছে মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে পদায়ন করা হবে কীভাবে? স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ডিসি পদেও পদায়নে লটারি পদ্ধতি অনুসরণের অনুরোধ জানিয়েছেন।
তবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসি পদে লটারি নাকি যাচাই-বাছাই করে উপযুক্ত বিবেচনা করে ডিসি পদে পদায়ন করা হবে, সেই বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে লটারির মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়নের বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কেউ লটারি ব্যবস্থাকে ইতিবাচক বলছেন। কারণ এর মাধ্যমে অর্থের লেনদেন, তদবির ঠেকানো সম্ভব হবে। যা ভোটে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে কেউ কেউ লটারির বিরোধিতা করে বলছেন, সঠিক কর্মকর্তাকে সঠিক জায়গায় বসাতে হবে। সেটা লটারির মাধ্যমে সম্ভব নয়। কারণ ভোটের ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে ভিন্নতা আছে। যোগ্যতা, দক্ষতা, সাহস- এসব গুণ বিবেচনা করে সঠিক জায়গায় সঠিক কর্মকর্তাকে পদায়ন করতে হবে।
গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে চায় সরকার। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হবে। যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন বিষয়ক সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা/ ছবি: জাগো নিউজ
এর পরের দিন (৬ আগস্ট) নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নবিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়ে আয়োজিত সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, এবার আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এটা স্যারের (প্রধান উপদেষ্টা) নির্দেশনা থেকে। সিদ্ধান্তটা হলো- আমরা বিশেষ করে পুলিশ বিভাগের এসপি এবং ওসিদের সবার সামনে লটারির মাধ্যমে পোস্টিংটা (পদায়ন) করবো। এখন যারা যেখানে আছে, তাদের আমরা বিভিন্ন জায়গায় পদায়ন করবো। সেটা আমরা লটারির মাধ্যমে করে দেবো। যেন কারো কোনো ধরনের সন্দেহ না থাকে যে, সে অমুকের সাপোর্টার।’
- আরও পড়ুন
ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন
১২ মাসে সরকারের ১২ সাফল্য তুলে ধরলেন প্রেস সচিব
তফসিলের আগে লটারির মাধ্যমে এসপি-ওসিদের পদায়ন
এসপিদের লটারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েই হবে। ওসিদের বিভাগভিত্তিক পোস্টিং করে লটারি হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কিছুদিন আগে এটা হবে বলেও জানান উপদেষ্টা।
উপদেষ্টা বলেন, ‘তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (ডিসিদের পদায়ন) কীভাবে করবে সেটা তারা সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা আশা করি তারাও এটা (লটারি) করবে।’
সারাদেশে ৬৪ জেলায় ৬৪ জন পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসন দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া প্রতিটি থানায় একজন করে ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) থাকেন। দেশে মোট থানার সংখ্যা ৬৩৯টি। নির্বাচনের সময় ডিসিরা সাধারণত রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
ভোটের আগে ডিসি পদে পদায়নের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিসি পদে পদায়নের জন্য আমরা সবকিছু ঠিক করে রেখেছি। সময় মতো সবকিছু হবে। তবে ডিসি পদায়নের বিষয়টি তফসিলের আগেই হবে। কীভাবে হবে, কী পরিসরে হবে- সেটি এখনো ঠিক হয়নি।’
এসপি ও ওসিদের লটারির মাধ্যমে পদায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি অভিনব ব্যবস্থা। এতে যদি লাভ হয়, তবে তাই হতে পারে।’
নির্বাচনের বিতর্ক এড়াতে এসপি-ওসিদের পদায়নে লটারি হবে। সেক্ষেত্রে ডিসি (জেলা প্রশাসক) নিয়োগে বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে- জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। অতি শিগগির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে পারবেন।’
সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসপি-ওসিদের লটারির মাধ্যমে পদায়নের যে সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়েছে এটি ভালো। ডিসি ও ইউএনওদের ক্ষেত্রেও এটা করা উচিত।’
- আরও পড়ুন
তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত বয়স ১৮ হলে ভোটার হওয়া যাবে
ভোটের মাস দুয়েক আগে তফসিল: সিইসি
‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে: প্রধান উপদেষ্টা
তিনি বলেন, ‘লটারিতে পোস্টিং হলে টাকা-পয়সার লেনদেন কিংবা তদবির- এগুলো এড়ানো যাবে। ডিসি ও এসপিদের মোরালি যদি বুস্টআপ (নৈতিক শক্ত অবস্থান) করে দিতে পারেন। তবে যে কেউ যে কোনো জায়গায় তার ভূমিকাটা রাখতে পারবে।’
‘একটু আগে আগে পদায়নটা করতে পারলে ভালো। কারণ জায়গাটাও তার বুঝতে সুবিধা হবে। সার্বিকভাবে লটারিটা ভালো চিন্তা। এটা খারাপ চিন্তা না। কেউ হয়তো বলবে আমি তো আপনাকে এনেছি। লটারি হলে এটা বলে কাউকে মানসিকভাবে দুর্বল করার সুযোগ থাকবে না’ বলেন সাবেক আমলা আবদুল আউয়াল মজুমদার।
তবে লটারির মাধ্যমে পদায়নের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অযোগ্যতার প্রমাণ। তারা যে অদক্ষ এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তারা সেটাই বুঝাচ্ছে।’
ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে এটা কীভাবে হবে? মনে করেন লটারিতে দিলেন, সব জেলা কিন্তু এক রকম নয়। কোনো জেলায় চৌকস, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এমন কর্মকর্তা দরকার- লটারি মাধ্যমে তো সেটা হবে না। লটারির মাধ্যমে সবচেয়ে দক্ষ কর্মকর্তাকে এমন জেলায় দিলেন যেভাবে কোনো ধরনের প্রতিকূল অবস্থা নেই। এ কর্মকর্তাকে তো আপনি উপযুক্ত জায়গায় ব্যবহার করতে পারলেন না।’
সাবেক এ আমলা বলেন, ‘যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী, যে অফিসার যে জেলার জন্য উপযুক্ত তাকে সেখানেই দিতে হবে। জেলার অবস্থা, গোয়েন্দা রিপোর্ট, পারফরমেন্স সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা করার যোগ্যতা যাদের না থাকবে তারাই তো লটারি করবেন। সঠিক লোকটাকে সঠিক জায়গায় বসালে কারো আপত্তি থাকারও কথা নয়। ডিসি হিসেবে সাহসী, দক্ষ, যোগ্য ও অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। সঠিক কর্মকর্তাকে সঠিক জেলায় ডিসি হিসেবে পদায়ন করতে হবে। লটারির মাধ্যমে ডিসি নিয়োগ দেওয়া সঠিক হবে না।’
আরএমএম/এমএএইচ/জেআইএম