লালমনিরহাটের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন নিদাড়িয়া মসজিদ। প্রাচীন এ মসজিদের দেওয়ালের শিলালিপি অনুযায়ী, ১১৭৬ হিজরি সনে মুঘল সুবেদার মাসুদ খাঁ ও তাঁর ছেলে মনছুর খাঁর তত্ত্বাবধানে মসজিদটি নির্মিত। নির্মাণসামগ্রী ও স্থাপত্য রীতিতে মুঘল স্থাপত্য শিল্পের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। তবে মসজিদে দেখা দিয়েছে ফাটল। ধসে পরারও সম্ভাবনা আছে। তাই দ্রুত সংস্কার চেয়েছেন স্থানীয়রা।
নিদাড়িয়া মসজিদটি প্রাচীন এক কক্ষের মসজিদ। দৈর্ঘ ৪২ ফুট এবং প্রস্থ ১৬ ফুট। উপরিভাগে তিনটি গম্বুজ, চার কোণায় চারটি পিলার, সম্মুখে একটি প্রবেশদ্বার ও প্রবেশদ্বারের পাশেই হাতের বাম দিকে দোচালা ঘর। ঘরটিকে অনেকেই মনে করেন স্টোর রুম বা ইমামের আবাসস্থল। সামনেই বিরাট ঈদগাহ। মসজিদ সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব কোণে একটি কবরস্থান। উত্তর দিকে ২০১৯ সালে হাফিজিয়া মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়।
মসজিদের বাম পাশে একটি কবর আছে। কবরটি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া না গেলেও অনেকেই মনে করেন, কবরটি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সুবেদার মনছুর খাঁর। তাঁর দাঁড়িহীনতার কারণে ফারসি ভাষায় মসজিদটির নামকরণ করা হয় ‘নিদাড়িয়া মসজিদ’। মসজিদের নামে আরও ১০ একর ৫৬ শতক জমি দান করেন তিনি। এই জমি থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে প্রতি বছর ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
নিদাড়িয়া মসজিদের খতিব হাফেজ মোহাম্মদ ফজলুল করিম বলেন, ‘জনশ্রুতি আছে, দাঁড়িকে কেন্দ্র করেই মূলত মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। বাবার কাছে শুনেছি, সুবেদার মনছুর খাঁর দাঁড়ি ছিল না। তিনি আল্লাহর কাছে মানত করেছিলেন তাঁর দাঁড়ি গজালে তিনি মসজিদ নির্মাণ করবেন। মানত করার কিছুদিন পর তার মুখে আল্লাহর রহমতে কয়েকটি দাঁড়ি গজায়। মনছুর খাঁ আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ১১৭৬ হিজরি সনে তিনটি দাঁড়ি গজানোর চেতনায় তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন।’
মসজিদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মো. হোসেন আলী বলেন, ‘মনছুর খাঁ আল্লাহর কাছে মানত করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে দাঁড়ি দিয়েছিলেন একটি। সেই ওয়াদা রাখতে মসজিদটি নির্মাণ করেন। অজু করতে গিয়ে সেই দাঁড়িটি ঝরে পড়ে যায়। তারপর থেকেই মসজিদের নাম হয় নিদাড়িয়া মসজিদ।’
তিনি আরও বলেন, ‘মসজিদটি অনেক পুরাতন। ছাদে ফাটল ধরেছে। জায়গা স্বল্পতার কারণেও সমস্যা হচ্ছে। আমরা সংস্কার করতে পারছি না। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সাইনবোর্ড দেওয়া আছে। নোটিশে বলা আছে, যে কোনো ধরনের দাগ বা সংস্কার আদেশ ছাড়া করা যাবে না। অধিকাংশ জমি অন্যরা দখল করেছেন। মামলা চলছে। সরকার উদ্যোগ নিয়ে জায়গা ফিরিয়ে দিলে স্থানীয়রা উপকৃত হবেন।’
স্থানীয় আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি দাদার কাছে শুনেছি, তাঁর দাদার আমলের আগে মসজিদটি নির্মাণ হয়েছে। প্রায় ৪০০ বছরের পুরাতন এই মসজিদ। দুর্যোগ বা পুরাতন হয়ে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। এর আগে সরকারি উদ্যোগে দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর থেকে খোঁজ-খবর একটু কম নেওয়া হয়।’
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, মসজিদের পাশে থাকা বাঁধানো কবরটি সুবেদার মনছুর খাঁর। সেখানে স্থানীয় মুসল্লিরা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। মুঘল আমলে নির্মিত মসজিদটি রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের বড়বাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের কিশামত নগরবন্দ মৌজায় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রাচীন স্থাপনা।
প্রাচীন মসজিদটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ছুটে আসেন। তারা এসে নামাজ পড়েন ও দোয়া করেন। কালের বিবর্তনে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে এই নিদর্শন অনেকটাই নষ্ট হওয়ার পথে। মসজিদটির প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জমিজমাসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, ‘ঐতিহাসিক নিদাড়িয়া মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তালিকাভুক্ত। প্রাচীন এ মসজিদের সংস্কার ও বিরাজমান সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মসজিদের ছাদ ফাটলের জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে আবেদন করা হয়েছে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
মহসীন ইসলাম শাওন/এসইউ/জিকেএস