ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো আজ জাদুঘরে তুলে রাখার মতো অবস্থা

2 months ago 6

গ্রামীণ খেলাধুলা বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। লাঠিখেলা, কাবাডি, দড়ি টানা, বলী খেলাসহ নানা খেলা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে আনন্দ ও সাহসিকতার প্রতীক হয়ে রয়েছে।

এই খেলাগুলো শুধু শরীরচর্চার নয় বরং পারস্পরিক সম্প্রীতি সহনশীলতা ও নেতৃত্বগুণ বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। অনেক খেলায় স্থানীয় লোককাহিনী, ধর্মীয় উৎসব ও কৃষিভিত্তিক জীবনচিত্র মিশে আছে যা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে। গ্রামীণ খেলাধুলার ভেতর দিয়েই বাংলার প্রাণবন্ত গ্রামীণ সমাজের আত্মা খুঁজে পাওয়া যায়।

তবে দুঃখজনকভাবে, আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব ও নগরায়ণের কারণে বাংলাদেশের প্রাচীন গ্রামীণ খেলাধুলা আজ বিলুপ্তির পথে। তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ হারিয়ে যাওয়া ও পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। সমাজ ও সংস্কৃতির মূল্যবান এই অংশকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগ।

‘আগে ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে পাশের বাসার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উঠানে কিংবা মাঠে খেলতে যেতো। প্রতিদিন এসব খেলাধুলা করার জন্য তাদের নির্দিষ্ট একটা সময় থাকতো। সমাজের মধ্যে পিস অ্যান্ড সলিডারিটি বজায় রাখতে এই খেলাধুলাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে গ্রামে কিংবা শহরে পাশের ফ্লাটে কে থাকে তাকেও ভালোভাবে চেনে না।’

গ্রামীণ খেলাধুলার অতীত কেমন ছিল, বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ কী? এসব প্রসঙ্গে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. এন. এম. সাজ্জাদুল হক

জাগো নিউজ: গ্রামীণ খেলাধুলার ইতিহাস বা শিকড় নিয়ে কিছু বলবেন? আমাদের সমাজে এই খেলাগুলোর গুরুত্ব কতটুকু ছিল?

সাজ্জাদুল হক: গ্রামীণ খেলাগুলো দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তথ্য প্রযুক্তি, মোবাইল গেমস এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যে স্থান করে নিতে পারছে না। এই খেলাধুলাকে জাদুঘরে রাখার মতো অবস্থা হয়েছে। পহেলা বৈশাখে এসব খেলাধুলাকে প্রদর্শনিকভাবে দেখানো হয় যা আদৌতে ঠিক নয়। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের পূর্ব থেকেই এই খেলাগুলো মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে তবে সরকারের কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা পুরোপুরিভাবে এই খেলাধুলাকে সংরক্ষণ কিংবা আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত না।

ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো আজ জাদুঘরে তুলে রাখার মতো অবস্থা

জাগো নিউজ: আগে গ্রামের প্রতিটি অঞ্চলে নানা রকম খেলাধুলার আয়োজন হতো। কোন খেলাগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল বলে আপনি মনে করেন?

সাজ্জাদুল হক: কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট এবং মার্বেল খেলাগুলো আগে ঈদের মতো আনন্দের বিষয় ছিল। প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ভালোভাবে গড়ে উঠতো। দড়িলাফ নারীদের মধ্যে একটি বহুল প্রচলিত খেলা। তাদের কৈশর থেকে যৌবনে উত্তরণে এই খেলাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জাগো নিউজ: আপনার অভিজ্ঞতায় হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, গুলতি বা মার্বেল খেলার সামাজিক ভূমিকা কী?

সাজ্জাদুল হক: আগে ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে পাশের বাসার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উঠানে কিংবা মাঠে খেলতে যেতো। প্রতিদিন এসব খেলাধুলা করার জন্য তাদের নির্দিষ্ট একটা সময় থাকতো। সমাজের মধ্যে পিস অ্যান্ড সলিডারিটি বজায় রাখতে এই খেলাধুলাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে গ্রামে কিংবা শহরে পাশের ফ্লাটে কে থাকে তাকেও ভালোভাবে চেনে না। এই বিষয়গুলো আমাদের সমাজের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়।

আরও পড়ুন-

জাগো নিউজ: বর্তমানে গ্রামীণ খেলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, এর পেছনে মূল কারণগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?

সাজ্জাদুল হক: তথ্য প্রযুক্তি কিংবা আধুনিকায়নের ফলে গ্রামীণ খেলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে মোবাইল গেমসে আসক্তির ফলে। এই খেলাধুলাকে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু জাতীয় শিক্ষাক্রম বা টেক্সট বই এই খেলাগুলো সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমে এই বিষয়গুলো পাঠদানের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ খেলাগুলোকে আরও পুনরুজ্জীবিত করতে পারি। পাশাপাশি জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টগুলোতে কোর্সের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে।

‘গ্রামীণ খেলাগুলো দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তথ্য প্রযুক্তি, মোবাইল গেমস এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যে স্থান করে নিতে পারছে না। এই খেলাধুলাকে জাদুঘরে রাখার মতো অবস্থা হয়েছে। পহেলা বৈশাখে এসব খেলাধুলাকে প্রদর্শনিকভাবে দেখানো হয় যা আদৌতে ঠিক না।’

জাগো নিউজ: আধুনিক প্রযুক্তি, মোবাইল গেমস ও শহুরে জীবনের প্রভাব এই খেলাগুলোর ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে?

সাজ্জাদুল হক: মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের খেলাধুলাগুলো ঘরে বসে এই প্রজন্ম দেখছে। নিজেরাই ঘরে বসে ভিডিও গেমস খেলছে। আধুনিক প্রযুক্তি এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খেলাধুলা জুয়ায় পরিণত হয়েছে। শহরের মানুষ দেশের খেলাগুলো দিনকে দিন ভুলে যাচ্ছে। নিজেদের শত শত বছর ধরে চলে আসা খেলাধুলা আজ বিলুপ্তির পথে।

জাগো নিউজ: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা ক্রীড়া নীতিতে গ্রামীণ খেলাধুলোগুলোর জন্য কি কোনো পদক্ষেপ রাখা প্রয়োজন?

ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো আজ জাদুঘরে তুলে রাখার মতো অবস্থা

সাজ্জাদুল হক: এই গ্রামীণ খেলাগুলোকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই প্রয়োজন। এসব খেলাধুলার ওপর হায়ার স্টাডি এবং রিসার্চ হওয়া উচিত। বর্তমান উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট সকল সেক্টরকে এ বিষয়ে কাজ করা প্রয়োজন।

জাগো নিউজ: গ্রামীণ খেলাগুলোর ভবিষ্যৎ আপনি কীভাবে দেখেন? এগুলো কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, নাকি পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে?

সাজ্জাদুল হক: বর্তমানে খেলাধুলাগুলো বিলুপ্তর পথে। কোর্স কারিকুলাম ও জাতীয় শিক্ষাক্রমে এসব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি, গ্রাজুয়েট শেষ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা এই খেলাধুলাগুলো নিয়ে রিসার্চ করলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারবে। উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে এগুলোকে পুনরুজ্জীবিত হওয়া সম্ভব।

জাগো নিউজ: যদি সংরক্ষণ করতে হয় তাহলে কী কী উদ্যোগ নেওয়া দরকার? মিডিয়া কীভবে ভূমিকা রাখতে পারে?

সাজ্জাদুল হক: উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে ক্রীড়ার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের কাছে এসব তুলে ধরতে হবে। এই খেলাগুলোর ওপর বিভিন্ন ধরনের সিম্পোজিয়াম সেমিনার হওয়া প্রয়োজন। জাতীয় পর্যায়ে বিত্তশালীরা স্পন্সরের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে পারে। গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো রাষ্ট্র এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এগুলো মিডিয়ার প্রতিবেদনের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে পারে।

‘মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের খেলাধুলাগুলো ঘরে বসে এই প্রজন্ম দেখছে। নিজেরাই ঘরে বসে ভিডিও গেমস খেলছে। আধুনিক প্রযুক্তি এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খেলাধুলা জুয়ায় পরিণত হয়েছে। শহরের মানুষ দেশের খেলাগুলো দিনকে দিন ভুলে যাচ্ছে।’

জাগো নিউজ: নতুন প্রজন্মের এই ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাগুলো চর্চার ক্ষেত্রে আপনি পরামর্শ কী?

সাজ্জাদুল হক: অভিভাবকদের অবশ্যই তাদের সন্তানকে এই খেলাধুলার সঙ্গে পরিচয় করে দিতে হবে। পাশাপাশি এসব খেলায় সন্তানদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। প্রশাসনিক দায়িত্বে যারা আছে, বিশ্ব পরিবেশ দিবস যেরকম পালিত হয় সেরকম বাংলাদেশের খেলাধুলাগুলোর ওপরও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

জাগো নিউজ: গ্রামীণ খেলাধুলার পুনর্জাগরণের জন্য প্রথম পদক্ষেপ কী হতে পারে?

সাজ্জাদুল হক: জাতীয় পর্যায়ে গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোর ওপর প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যেতে পারে। মিডিয়ার মাধ্যমে সেগুলো দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে করে মানুষের মাঝে উদ্দীপনা আগ্রহ তৈরি হবে।

জাগো নিউজ: ছোটবেলায় গ্রামীণ খেলা নিয়ে আপনার কোনো স্মরণীয় অভিজ্ঞতা থাকলে বলবেন।

সাজ্জাদুল হক: ছোটবেলায় ধানক্ষেতে আমরা দাড়িয়াবান্ধার মতো খেলাধুলা করতাম। আমার কাজিনরা অপেক্ষায় থাকতো কখন খেলাধুলার জন্য বের হবো। দাদাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সেখানে আমরা খেলাধুলা করতাম। সেই সময়ের খেলাধুলাগুলো পরিবারের মাঝে স্মৃতিচারণ করলে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে।

এফএ/এমএস

Read Entire Article