ঐতিহ্যের টানে ৪০০ বছরের পুরোনো সানোড়ার মেলায়

4 hours ago 5

সানজিদা জান্নাত পিংকি
সানোড়ার মেলা! শুধু মেলা নয়, যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক জীবন্ত কাব্য। ধামরাইয়ের সানোড়া ইউনিয়নের বটতলা যেন জেগে উঠেছে এক রঙিন স্বপ্নে। এই স্বপ্ন পৌষ সংক্রান্তির, এই স্বপ্ন মেলার। মকর সংক্রান্তির প্রাচীন আয়োজনের অংশ হিসেবে বটতলার এই মেলা বহু বছর ধরে বয়ে আনে বাঙালির ঐতিহ্যের সুর। এদিন আশেপাশের দু'চার গ্রামের মানুষ বের হয় যেন শুধু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে নয়-বের হয় মাটির গন্ধ মাখা এক চিরায়ত ঐতিহ্যের টানে।

প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মেলার প্রস্তুতি শুরু হয়। সকাল থেকেই বটতলার বিশাল বটগাছগুলোর ছায়ায় জমে ওঠে মেলা। মেলার প্রধান আকর্ষণ গ্রামীণ হস্তশিল্পের পসরা। কামার-কুমারদের তৈরি দা, বটি, মাটির পাত্র, বাঁশ-বেতের সামগ্রী-সবকিছুই পাওয়া যায় এখানে। এছাড়া খই, বিন্নি, বাতাসা, চিনির খেলনা, ভাজা পেঁয়াজু, চানাচুর, বাদামসহ নানা পিঠা-পুলির স্টল মেলায় ভোজনরসিকদের তৃপ্ত করে।

বটতলার এই মেলা এক দিনের হলেও, এর প্রস্তুতি যেন সপ্তাহব্যাপী। সকালের প্রথম আলো ফোটার আগে থেকেই আশপাশের গ্রামগুলো থেকে মানুষ এসে ভরে তোলে মেলার চৌহদ্দি। কেউ আসে হেঁটে, কেউ আসে ভ্যানগাড়িতে, আর কেউবা সাইকেলের পেছনে ঝোলায় নতুন কেনা মাটির হাঁড়ি। বটতলার গাছের ছায়ায় বসতে শুরু করে দোকান। একপাশে মাটির খেলনার সারি, অন্যপাশে হরেক রকমের মিষ্টি। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে খাবারের ঘ্রাণ, যা শীতের সকালটাকে আরও সজীব করে তোলে। সকালবেলা অনেকেই মেলার মিষ্টি আর গরম রুটি দিয়ে নাস্তা সারেন।

jagonews24

এই মেলার ঐতিহ্য বেশ পুরোনো। কথিত আছে, প্রায় চারশো বছর আগে এই মেলার সূচনা। প্রাচীন এই বটগাছের তলায় শুরু হওয়া এই মেলা কালের বিবর্তনে আজও তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিন এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যা স্থানীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৌষ সংক্রান্তির সঙ্গে বাঙালির যে মাটির টান, এই মেলা তারই উদাহরণ।

মেলার দিন এই বটের ছায়া যেন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে নানা আয়োজন। নাগরদোলার কড়কড় শব্দ, ঢাক ঢোলের বাজনা-সব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শিশুদের জন্য থাকে মাটির খেলনা, বাঁশের বাঁশি, রঙিন বেলুনের দোকান।

মেলার মূল আকর্ষণ হলো গ্রামীণ শিল্প ও হস্তশিল্পের সম্ভার। কামারের তৈরি দা-বটি থেকে শুরু করে কুমারের মাটির হাঁড়ি কিংবা বাঁশ-বেতের ঝুড়ি-সবকিছুই এখানে পাওয়া যায়। নারীরা মাটির পাত্র ও বেতের চালুনি কেনার ব্যস্ততায় মগ্ন থাকেন, আর পুরুষরা খোঁজেন কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম।

সানোড়ার বটতলার এই পৌষ সংক্রান্তির মেলা কেবল একটি উৎসব নয়; এটি বাংলার গ্রামীণ জীবনের আনন্দ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। নাগরদোলার শব্দ, ঢোলের তালে তালে মানুষের স্রোত, আর খাবারের ঘ্রাণ মিলে সৃষ্টি করে এক অনন্য পরিবেশ। প্রতি বছর এই মেলা নতুন করে মনে করিয়ে দেয় আমাদের শিকড়ের কথা, ঐক্যের কথা, আমাদের সংস্কৃতির গভীরতা। এমন উৎসব আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে, সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও মজবুত করে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ

কেএসকে/জেআইএম

Read Entire Article