নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আমরা কিছুক্ষণ অবস্থান করি। ওই সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও দেখান ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল। ভিডিও দেখিয়ে ইকবাল বলেন, গুলি করি একজন মরে, একজনই আহত হয়। সেই যায়। বাকিরা যায় না।
তৎকালীন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যতে এমন তথ্য জানিয়েছেন সাবেক আইজিপি মামলার রাজসাক্ষী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তিনি বলেন, আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা, কর্মপদ্ধতি ও কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজে জড়িত থেকে তিনি জেনেছেন বলেও তার বক্তব্যে উঠে আসে।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তিনি। এদিন দুপুর পৌনে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তার সাক্ষ্যগ্রহণ চলে।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট গণভবনে বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির একটি বেঠকে হয়। বেঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিজিএফআই-এনএসআই প্রধানসহ কমিটির ২৭ জন অংশ নেন। আমি নিজেও ওই বৈঠকে ছিলাম।
সেখানে আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে বৈঠকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন পেশ করছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এর মধ্যেই চারদিকের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠক মুলতবি করা হয়। মামুন বলেন, ওই রাতেই আমাদের আবার গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে আমি, আনিসুল, কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাব ডিজি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানাও ছিলেন। আর বাইরে অপেক্ষমান ছিলেন ডিজিএফআই ও এসবিপ্রধান।
- আরও পড়ুন:
- জুলাই আন্দোলনে মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতিউৎসাহী ছিলেন হাবিব-হারুন
একাদশ নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট রাতে ভরে রাখতে বলেন জাবেদ পাটোয়ারী
ওই বৈঠকে ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশ-সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে ফোর্স মোতায়েন করে কাঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শেষে রাত সাড়ে ১২টায় আমরা চলে আসি।
জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট সকালে আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আমার দপ্তরে যাই। এর মধ্যে সকালে উত্তরা-যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারি ক্ষমতা ছেড়ে দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন, তা আমরা জানতাম না। এরপর বিকেলে আর্মির হেলিকপ্টার এসে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে নেওয়া হয়।
সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবিপ্রধান মনিরুল, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিব ও ডিআইজি আমেনা ছিলেন। পরের ধাপে হেলিকপ্টারে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, এডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যান্যদেরও সেখানে নিয়ে আসা হয়। এই রাজসাক্ষী বলেন, ৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে আমার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয়। আর ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন ৩ সেপ্টেম্বর আমাকে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি এ সময় বলেন আন্দোলন চলার সময় ২৭ জুলাই আন্দোলন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আমরা নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যাই। যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আমরা কিছুক্ষণ অবস্থান করি। ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও প্রদর্শন করেন ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল। ভিডিও দেখিয়ে ইকবাল বলেন যে, গুলি করি একজন মরে, একজন আহত হয়। সেই যায়। বাকিরা যায় না।
চৌধুরী মামুন বলেন, ১৮ জুলাই আমাকে ফোন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই সময় আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। আমার সঙ্গে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়ও ছিলেন। নির্দেশনার বিষয়টি আমাকে জানানোর পর ডিএমপি কমিশনারসহ সারাদেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেন প্রলয়। এরপর থেকেই আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। তবে মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতিউৎসাহী ছিলেন হাবিব ও ডিবির হারুন। মূলত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল যেকোনোভাবে আন্দোলন দমাতে হবে। এ ছাড়া, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে প্রধানমন্ত্রীকে প্ররোচিত করেন কামাল, আনিসুল, ফজলে নূর তাপস, সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আযম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননসহ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করেন আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও ব্যবসায়ীরা।
এ সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকারের আদেশে ছাত্র-জনতার ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে হতাহতের ঘটনায় পুলিশপ্রধান হিসেবে লজ্জিত-অনুতপ্তবোধ প্রকাশ করেন সাবেক এই পুলিশপ্রধান। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাসহ ব্যাপক নৃশংসতার জন্য অপরাধবোধ করছি। এসবে বিবেকের তাড়নায় আমি রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এমনকি ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানোদের কান্না-আহাজারি শুনে ও ভিডিওতে নৃশংসতা দেখে রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত আরও যৌক্তিক মনে হয়েছে।
এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম