কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর সহজ তরিকা!

2 hours ago 4

কয়েক দিন আগের একটি সংবাদ শিরোনাম: রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের প্রধান ফটকে ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখা ব্যানার টানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। খবরে বলা হয়, গত ৭ জানুয়ারি সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। দুপুরের দিকে তারা কলেজের প্রধান ফটকে এই ব্যানার টানিয়ে দেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অবশ্য কেউ কেউ রসিকতা করে লিখেছেন, ব্যানার বা সাইনবোর্ড টানিয়েই যদি প্রতিষ্ঠানের পরিচয় বদলে দেয়া যায়, তাহলে ‘তিতুমীর’ না লিখে ‘অক্সফোর্ড’ লিখলে আরও ভালো হতো!

প্রসঙ্গত, পুরান ঢাকায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়, তখন ওই তালিকায় তিতুমীরের নামও ছিল। ঢাকা শহরকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করলে দেখা যাবে দক্ষিণ অংশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ—এই দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কিন্তু উত্তরাংশে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এই যুক্তিতে তিতুমীরের বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করা হয়তো অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কলেজের ফটকে বিশ্ববিদ্যালয় লেখা ব্যানার টানিয়ে দিলেই সেটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায়? এই ব্যানার টানানোর মধ্য দিয়ে তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা কী বার্তা দেয়ার চেষ্টা করলেন? এটি কি তাদের প্রতিবাদ? বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট আয়তনের দেশে কত শত বিশ্ববিদ্যালয় দরকার? যেসব প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয় বলে মানুষ চেনে, তার কতটি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয় আর কতটি কলেজের উন্নত সংস্করণ—সেই বিতর্কও বেশ পুরোনো। তাছাড়া যে প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তোলা হয়েছে কলেজ হিসেবে, সেটিকে বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে হবে কেন? প্রয়োজনে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। কেননা যখন কোনো একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়, তখন অন্য কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদেরও বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনে নামার রাস্তা খুলে দেয়া হয়।

স্মরণ করা যেতে পারে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার বলা হচ্ছিলো যে, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হবে। সেই লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছিল। অথচ জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা যে কোনো যৌক্তিক বিষয় নয় বরং এটি যে ছিল নিতান্তই একেকটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারি ও দলীয় লোকজনকে মোটা অংকের টাকা কামানোর পথ খুলে দেয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরে সেখানে দলীয় বিবেচনায় প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান—সেটি এখন স্পষ্ট। অর্থাৎ শিক্ষার মানোন্নয়ন বা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণায় দেশকে এগিয়ে নেয়া নয়, বরং প্রকল্প তৈরি করে কিছু লোকের পয়সা উপার্জনের সুযোগ করে দেয়াই ছিল জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য।

যদি সত্যিই প্রতিটি জেলায় এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হতো, তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতো দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির। কারণ একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রচুর জমি অধিগ্রহণ করতে হতো। অবকাঠামো নির্মাণের ফলের শত শত একর ফসলের জমি নষ্ট হতো। প্রচুর জলাভূমি বালু দিয়ে ভরাট করে প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন ধ্বংস করা হতো। পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির বারোটা বাজানো হতো। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় বললেই সাদাচোখে যেমন কিছু সুন্দর ইমারত, কিছু সবুজায়ন, খেলার মাঠ আর তার ভেতরে প্রচুর জ্ঞান অর্জন, অন্বেষণ ও চর্চায় নিযুক্ত প্রচুর মানুষের ছবি দেখা যায়, তেমনি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মানেই হলো জল ও নদীমাতৃক এবং কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের ওপর কিছু অনিবার্য ধ্বংস। ফলে, মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশে যেখানে প্রায় ২০ কোটি মানুষকে বসবাস করতে হয় এবং যে দেশটির প্রাণ হচ্ছে জল, জলাভূমি আর ফসলের ক্ষেত—সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন বাহিনীর নিজস্ব ক্যাম্পাস গড়ে তোলার নামে কত হাজার জমি সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেলো এবং আরও যাবে—সেই হিসাবটাও করা দরকার।

আসা যাক তিতুমীরের প্রসঙ্গে।
তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে গত ১৮ নভেম্বর ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ‘ক্লোজডাউন তিতুমীর’ কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরদিন ১৯ নভেম্বর মহাখালীর আমতলী, কাঁচাবাজার ও রেলক্রসিংয়ে শত শত শিক্ষার্থী জড়ো হন। মহাখালীতে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক ও রেলপথ বন্ধ করে দিয়ে তারা বিক্ষোভ করেন। সেদিন সন্ধ্যায় তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা সম্ভব কি না- তা যাচাইয়ে কমিটি গঠন করার আশ্বাস দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ১৪ দিনের মাথায় এসে ওই কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদেরে অভিযোগ, সেই কমিটি এখনো চূড়ান্ত কোনো বার্তা দেয়নি। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ একটি স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়নে চার সদস্যের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অধিভুক্ত ওই কলেজগুলোর একটি সরকারি তিতুমীর কলেজ। বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফলে তারা ফের আন্দোলনে নামেন।

প্রসঙ্গত, একসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত থাকলেও নানা কারণে সরকার রাজধানী ঢাকার সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। অধিভুক্তির ফলে এসব কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু অনেক দিন ধরেই এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে আসছিলেন যে, তাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিমাতাসুলভ আচরণ করে।

গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনে নামেন। গত ২১ অক্টোবর তারা মিছিল নিয়ে ঢাকা কলেজ থেকে সায়েন্স ল্যাব হয়ে নীলক্ষেত ঘুরে আবার ঢাকা কলেজের সামনে গিয়ে মিলিত হন। এ সময় তারা ‘অধিভুক্ত বাতিল করো, সাত কলেজ স্বাধীন করো’, ‘আর নয় সংস্কার, এবার চাই অধিকার’, ‘দফা এক দাবি এক, অ্যাফিলিয়েটেড নট কাম ব্যাক’, ‘ঢাবি তোমাদের প্রহসন মানবো আমি কতক্ষণ’, ‘শিক্ষা না বাণিজ্য, শিক্ষা শিক্ষা’, ‘টু জিরো টু ফোর, অ্যাফিলিয়েটেড নো মোর’, ‘ঢাবির প্রহসন মানি না মানবো না’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর সাত বছরে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষায় নানা সংকট উত্তরণে সাত কলেজকে নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করছেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত থেকে বেরিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় করতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জোর দাবি জানানা তারা।

সমাধান কী?
সাত কলেজ নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করার ধারণাটি বাস্তবসম্মত নয়। কেননা সাত কলেজের অবস্থান এক জায়গায় নয়। আবার ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় অবস্থিত কলেজগুলোর প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত অন্য একটি ক্যাম্পাস বা ভবন থেকে হবে, সেটিও যৌক্তিক নয়। ঢাকা শহরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (যদিও এর নিজস্ব ক্যাম্পাস হচ্ছে বুড়িগঙ্গার ওপারে) থাকার পরে একই শহরে আরও সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার কী প্রয়োজন—সেটিও বড় প্রশ্ন। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোর অবকাঠামো ঠিক রেখেই যদি এগুলোর নাম পরিবর্তন করে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়, তাতে এর গুণগত কী পরিবর্তন আসবে? আবার যদি ক্যাম্পাস বড় করার প্রয়োজন হয়, সেই জায়গা কি ঢাকা শহরে আছে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, কলেজগুলো কলেজ থাকলে অসুবিধা কী? এখান থেকে পাস করে বের হলে শিক্ষার্থীদের সামাজিক মর্যাদা কমে যায়? যদি তাই হয়, তাহলে দেশে কেনো কলেজই রাখার দরকার নেই। সব কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করে দিলেই হয়।

বছর কয়েক আগে গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন তুলেছিলেন: বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? এই প্রশ্নটি তিনি তুলেছিলেন কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণে অনিয়মের সংবাদ তৈরি করতে গিয়ে ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিশেষ করে তৎকালীন উপাচার্যের রোষানলে পড়েছিলেন। তিনি এমন এক সময়ে প্রশ্নটি তুলেছিলেন যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ থেকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে চাঁদা দেওয়া এবং উপাচার্যের পরিবারের লোকজনের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম ছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী– ২০১৯ সালে উত্থাপিত সেই প্রশ্নের সুরাহা বোধ হয় এখনও হয়নি। হয়নি বলেই তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা কলেজের ফটকে বিশ্ববিদ্যালয় লেখা ব্যানার টানিয়ে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন।

দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে নামার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু এটিও উপলব্ধি করা জরুরি যে, দাবিটি যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত কি না? তার আগে রাষ্ট্রের একটি নীতি থাকা দরকার যে, দেশে সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে? কোন কোন মানদণ্ডে এগুলো গড়ে তোলা হবে এবং নতুন করে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে কি না? বরং যেগুলো আছে সেগুলোই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারলো কি না, না পারলে ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা দরকার। হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মতো পাড়ায় পাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুললেই শিক্ষার মান বাড়ে না। নতুন নতুন গবেষক তৈরি হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ারও বিকল্প নেই। কিন্তু সাত কলেজকে একত্র করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সাতটি আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা কোনো সমাধান নয়। বাস্তবসম্মত নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article