তাহসিন আব্দুল্লাহ, মাইলস্টোন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২১ জুলাই ২০২৫ সালে স্কুলছুটির পর রিকশায় করে বাড়ি ফিরছিল সে। হঠাৎ অস্বাভাবিক শব্দ শুনে রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে ফিরে আসে স্কুলের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখে, একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে আগুন লেগেছে। হন্য হয়ে বোনকে খুঁজতে থাকে তাহসিন। কিছুক্ষণ পর দেখে— পোড়া দেহ নিয়ে বোনটি বেরিয়ে আসছে, তার শরীরের মাংস পুড়ে ঝুলছে। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় তাহসিন এবং বাবা-মাকে খবর দেয়। কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর না ফেরার দেশে পাড়ি জমায় বোনটি।
চোখের পানি মুছতে মুছতে তাহসিন বলে, ‘আমাদের দুজনের বয়সের পার্থক্য তেমন ছিল না। সবকিছুর সঙ্গী ছিল বোন। এখন মনে হয়, আমি আমার এক খেলার সাথীকে হারিয়েছি।’
সূর্য সময়, সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সেদিনের আগুনের বিভীষিকা তাকেও ছুঁয়ে যায়। নিজেকে রক্ষা করার পাশাপাশি বন্ধুদের বাঁচাতেও সাহায্য করে সে। সূর্যের ভাষায়, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। নিজের জামা দিয়ে মুখ ঢেকে জানালার পাশে গিয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করি। গ্রিল কেটে দেওয়ার পর বারান্দায় গিয়ে কিছুটা স্বস্তি পাই। তারপর দেখি বন্ধুরা পড়ে আছে— একে একে তাদের নামিয়ে নিজেও নেমে আসি।’
তাহসিন ও সূর্যের মতো মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির বেদনা বয়ে বেড়ানো ৪০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে ‘হিলিং টুগেদার উইথ মাইলস্টোনস ব্রেভ হার্টস’ শীর্ষক আয়োজন করেছে রোটারি ক্লাব বনানী ও ছুটি রিসোর্ট পূর্বাচল। ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি’— এ স্লোগানে দিনব্যাপী আয়োজনে শিশুদের মুখে ফুটে উঠেছিল হাসি, খেলাধুলার উচ্ছ্বাস আর মনের গভীরে জমে থাকা কষ্টের উন্মোচন।
বেদনা ভুলে থাকার প্রয়াসে দিনব্যাপী কর্মসূচিতে ছিল মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সেশন, ছবি আঁকা, ট্রেজার হান্ট প্রতিযোগিতা এবং সবশেষে নিজেদের কষ্ট ও স্মৃতি কাগজে লিখে তা দিয়ে নৌকা বানিয়ে নীল জলে ভাসিয়ে দেওয়ার অনন্য আয়োজন। এছাড়া ছিল ইচ্ছেমতো খেলাধুলার ব্যবস্থাও।

নীল জলে কষ্টগুলো ভাসিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থী আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘সারাদিন ইভেন্টে ব্যস্ত ছিলাম, আনন্দ করেছি। ভালো লেগেছে, বেদনাগুলো কিছুটা ভুলে থাকতে পেরেছি।’
আরও পড়ুন
৯৯ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেল দগ্ধ শিক্ষার্থী নাভিদ
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: তদন্ত কমিশনের মেয়াদ এক মাস বাড়লো
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে নিহতদের পরিবারের পাশে থাকবেন তারেক রহমান
আরেক শিক্ষার্থী আফিফ জানায়, ‘খেলেছি, অংশ নিয়েছি— খুব ভালো লেগেছে। কষ্টটা মনে ছিল না।’
মাইলস্টোন স্কুলের সিনিয়র লেকচারার অভিজিত অধিকারী বলেন, ‘ট্র্যাজেডির পর থেকে আমরা প্রতিদিনই চেষ্টা করছি যেন ওদের ট্রমা ধীরে ধীরে হালকা হয়, ওরা আবার হাসতে পারে, স্বপ্ন দেখতে পারে। আজকের এ আয়োজন সেই প্রচেষ্টাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিল। সত্যিই অসাধারণ একটি দিন ছিল।’
আয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অংশটি পরিচালনা করেন মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি লিড মনিরা রহমান। তিনি বলেন, ‘এমন আয়োজন শিশুদের মানসিক পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানে তারা আবারও বন্ধুর মুখে হাসি দেখে সাহস পায়, বিশ্বাস করে— জীবন থেমে থাকে না। এমন আরও উদ্যোগ দরকার, কারণ মানসিক ক্ষত এখনো রয়ে গেছে।’
চিত্রশিল্পী তাহমিনা হাফিজ লিসা বলেন, ‘আমি বাচ্চাদের ছবি আঁকার অংশে গাইড করেছি। দেখেছি— কারো ছবিতে চোখের জল, কারো ছবিতে দুর্ঘটনার স্মৃতি। তাদের আঁকা ছবিগুলো যেন সাক্ষ্য দিচ্ছিল, স্মৃতির রং কখনো পুরোপুরি মুছে যায় না। এমন সৃজনশীল কাজে তাদের আরও যুক্ত করা উচিত।’
আরও পড়ুন
মাইলস্টোন কলেজে পাসের হার ৯৯.৮৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭৯১ জন
হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেল আরও দুই দগ্ধ শিক্ষার্থী
আয়োজনের পেছনের গল্প জানাতে গিয়ে সমাজকর্মী ও সিনিয়র সাংবাদিক শাহনাজ শারমীন বলেন, ‘মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার খবর কাভার করতে গিয়ে দেখি, সবাই কাউন্সেলিংয়ের কথা বলছে। বুঝলাম, বাচ্চারা আঁকতে ও খেলাধুলা করতে ভালোবাসে— সেটাই হতে পারে তাদের থেরাপি। এরপর বিষয়টি রোটারি ক্লাব বনানীর সঙ্গে আলোচনা করি, তারাও রাজি হয়। প্রথমে স্কুলে আয়োজনের কথা ভাবছিলাম, পরে ছুটি রিসোর্টের ফেরদৌস ভাই প্রস্তাব দেন বাইরে আয়োজন করার। যেন ওরা একদিনের জন্য হলেও ছুটির মতো সময় কাটাতে পারে। সবার সহযোগিতায় সেটা সম্ভব হয়েছে।’

রোটারি ক্লাব বনানীর প্রেসিডেন্ট খন্দকার আব্দুল মুবিন বলেন, ‘এটা শুধু বিনোদনের আয়োজন নয়, শিশুদের মনের ভয়, দুঃখ আর মানসিক চাপ দূর করার আন্তরিক প্রয়াস। এমন উদ্যোগ আমরা আরও করতে চাই।’
ছুটি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর ফেরদৌস বলেন, ‘২১ জুলাইয়ের মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। তাদের সঙ্গে এমন এক আয়োজনের অংশ হতে পেরে আমরা আনন্দিত। ওদের সঙ্গে আমাদেরও এক সুন্দর, আনন্দঘন দিন কেটেছে। ভবিষ্যতেও এমন উদ্যোগে পাশে থাকতে চাই।’
গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি দোতলা ভবনের ওপর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীসহ অন্তত ৩৫ জন নিহত এবং ১৫০ জন আহত হন।
এসইউজে/এমএএইচ/এএসএম

8 hours ago
7









English (US) ·