কাগজের ঘর থেকে সেমিপাকা, দুঃখ ঘুচেছে হোসনে আরার

3 months ago 31

এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে
এই তো নদীর খেলা।
সকাল বেলা আমির, রে ভাই
ফকির, সন্ধ্যাবেলা॥

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গীতি উপকূল জীবনে প্রাসঙ্গিক। নদীর ভাঙন আর চর জেগে ওঠা চিরন্তন। এতে সর্বস্বান্ত হয় অনেকে, আবার ঘুরে দাঁড়ানোর অবলম্বনও খুঁজে পায়। নদীর ভয়াল রূপের সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলে উপকূলের জীবন। ব্যতিক্রম নয়, দ্বীপজেলা ভোলার উপকূলবাসীর জীবনও।

দুকূল হারাদের একজন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার পশ্চিম এওয়াজপুরের আদর্শ গ্রামের হোসনে আরা। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় হোসনে আরার বিয়ে হয় হাবিবউল্লাহ মাঝির সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গে মাছ ধরে জীবন কাটতো তার। এখানে সেখানে নৌকায় বা নদীর পাড়ে কাগজের অস্থায়ী ঘরে কাটতো দিনরাত। ঠিকমতো খাবার পাননি। জামাকাপড় বলতে ছিল অন্যের ফেলে দেওয়া বা ব্যবহৃত কাপড়। বৃদ্ধ স্বামী এখন কাজ করতে পারেন না। অথচ ছয় সদস্যের সংসার। তাই, একাই মাছ ধরে হাঁটে বিক্রি করে নয়তো কৃষি শ্রমিকের কাজ করে সংগ্রামী জীবন চালান হোসনে আরা।

কাগজের ঘর থেকে সেমিপাকা, দুঃখ ঘুচেছে হোসনে আরার

উপকূলে হাবুডুবু খাওয়া হোসনে আরা জীবন সায়াহ্নে এসে ঠাঁই পেয়েছেন সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে। পশ্চিম এওয়াজপুরে তার মতো ১২৬ জনকে দুই শতক জমিসহ সেমিপাকা ঘর দেওয়া হয়েছে।

হোসনে আরা বলেন, ‘ঘর নাই বলে তৃতীয় মেয়েটার বিয়ে হচ্ছিল না। বছর খানেক আগে এখানে এসে মেয়ে বিয়ে দেই।’

কাগজের ঘর থেকে সেমিপাকা, দুঃখ ঘুচেছে হোসনে আরারভোলার চরফ্যাশন উপজেলার পশ্চিম এওয়াজপুরের আদর্শ গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্প। ছবি : সংগৃহীত

কষ্টের কথা বলতে গিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে হোসনে আরা বলেন, ‘আমাদের ঘর বলতে কিছু ছিল না। শামরাজের ঘাটে (নদীর পাড়) কাগজ দিয়ে ঘেরাও করে ছিলাম৷ বৃষ্টিতে ভিজেছি, রোদে শুকাইছি। নদীতে মাছ ধরে খাইতাম। বহুদিন গেছে না খেয়ে ছিলাম। সন্তানদের খানা দিতে পারিনি। তাদের জামা-কাপড়ও দিতে পারিনি। পোলাপান ভাত খুঁজছে, চোখের পানি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না। এখানে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাইছি। ভাগ্যের জোটে ঘরকান পাইছি, অনেক খুশি। গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা সিলিয়ে দিলেও সরকারের দাবি হুত (পূরণ) দিতে পারবো না।’

‘ছোট মেয়ে আমার কাছে। বড় মেয়েটাকে জামাই ছেড়ে গেছে। তার ঘরে দুইটা নাতি-নাতনিকে পালতে হয়। অসুস্থ ও অচল স্বামী ঘরে। এখন অন্যের ক্ষেতে মরিচ তুলে খাবার জুটে। তিনদিন ধরে ঘরে খাবার ছিল না৷ ওদের খাবার দিতে পারিনি। ওরা তো ছোট, কান্না করে। আমিও কাঁদি।’

কাগজের ঘর থেকে সেমিপাকা, দুঃখ ঘুচেছে হোসনে আরারভোলার চরফ্যাশন উপজেলার পশ্চিম এওয়াজপুরের আদর্শ গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্প। ছবি : সংগৃহীত 

হোসনে আরার এ কথা বলার সময় পাশ থেকে নাতনি মীমও চোখের পানি মুছছিল।

হোসনে আরার মতো বঙ্গোপসাগরের তীরে মেঘনা, ইলিশা ও তেঁতুলিয়া নদীঘেরা জেলা ভোলায় গৃহহীন ও চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা মানুষের সংখ্যা অনেক। পিছিয়ে পড়া এসব মানুষের জীবনমান উন্নত করতে দুই শতক জমিসহ সেমিপাকা ঘর দিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে ভোলাসহ সারাদেশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ৫ লাখ ৮২ হাজার ৫৩ ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের ২৯ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আশ্রয়ণের পাশাপাশি অন্যান্য প্রকল্প মিলে ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯০৪ ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের প্রায় ৪৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

এসইউজে/এসএনআর/এমএমএআর/জিকেএস

Read Entire Article