কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছি: শাম্মি

3 hours ago 5

পুরান ঢাকার মেয়ে শামীম আরা আজিজ শাম্মি। অনার্সে পড়ার সময় থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। মাস্টার্সে অধ্যায়নরত অবস্থায় মাত্র চার হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে কাজ শুরু করেন। অনলাইনের মাধ্যমে উদ্যোগ শুরু হলেও স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইল নামে গড়ে তুলেছেন পোশাকের ব্র্যান্ড। বর্তমানে অনলাইন থেকেই মাসে আয় করছেন ৬০-৭০ হাজার টাকা।

শামীম আরা আজিজ শাম্মির এগিয়ে চলা, প্রতিবন্ধকতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত—

জাগো নিউজ: উদ্যোক্তা জীবনের শুরুর গল্প শুনতে চাই—
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: ছোটবেলা থেকেই আমি স্বাধীনভাবে চলতে পছন্দ করতাম। যে সময় বাচ্চারা পরিবারের কাছ থেকে পকেট মানি চাইতো; সে সময়টাতে আমি চেষ্টা করতাম টিফিন কিংবা যাতায়াতের ভাড়া বাঁচিয়ে নিজের পকেট মানি বের করার কথা। যখন একটু বড় হলাম, বোঝার মত বয়স হলো এবং নিজে কিছু করার অনুমতি পেলাম; তখন বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখানোর কাজ শুরু করলাম। একটু একটু করে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করার স্বপ্ন বুনতে থাকলাম। ২০০২-২০০৩ সালের দিকে যখন আমি অনার্সে পড়ি; তখনই শুরু করলাম শখের কাজ। সুচিকর্ম খুব ভালোই করতে জানতাম। তাই সেটা দিয়েই শুরু হলো উদ্যোগের যাত্রা। মার্কেট থেকে কাপড় কিনে নানারকম নকশা এঁকে সুতার কাজ করতাম। আশেপাশের মানুষের কাছে বিক্রি করতে শুরু করলাম। যখন দেখলাম সবাই খুব প্রশংসা করছে; তখন আরও অনুপ্রাণিত হলাম। তখন সুচিকর্মের পাশাপাশি ব্লক প্রিন্টের কাজও শুরু করে দিলাম। যথারীতি এটাও আমার আশেপাশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলো। এভাবেই আমার স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়ে গেল।

 শাম্মি

জাগো নিউজ: এর পরের গল্পটি কেমন ছিল?
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: ‘স্বপ্নছোঁয়া’ নামে যদিও শুরু করেছিলাম। এখন তা ‘স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইল’ নামে পরিচিত। আমার এ স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছাটা আরও প্রখর হলো। যখন আমি মাস্টার্সে পড়ি; তখন আমার শিক্ষকের একটা লেকচার অনেক অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন, ‘মার্কেটিং করে যদি তোমরা ন্যূনতম একটা চায়ের দোকান খুলতে না পারো, তাহলে তো সেই পড়া বৃথা। তখনই বুঝলাম যে, চাকরি-বাকরি হয়তো করব কিছুটা সময় কিন্তু নিজের একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে হবেই। যেহেতু অল্প পুঁজি তাই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ঢুকে গেলাম। চাকরির পাশাপাশি ছোট পরিসরে উদ্যোগের কাজও তখন চলছে। কিন্তু মাথায় ছিল চাকরি করে টাকা সেভ করতে হবে। সেই টাকা দিয়ে ভালোভাবে ব্যবসায় নামতে হবে। পরে বিয়ে হলো, বাচ্চা হলো। একটা সময় মনে হলো যে, আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে এখন এটাকে ভালোমতো পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে নিতে হবে। তাই ২০১৫ সালের দিকে চাকরি ছেড়ে জমানো পুঁজি দিয়ে কারখানা করে ফেললাম। আমি দেখছিলাম, অন্যের জায়গা থেকে কাজ করিয়ে আনতে গেলে ডিজাইন কপি হয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কম্পিটিশনে টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। খরচও বেশি হচ্ছে। আমার মনে হলো, এখন কারখানা স্থাপন করলে ভালো ফলাফল দেবে। কারখানা করার পর খুচরা বিক্রির পাশাপাশি সাপ্লায়ার কিংবা হোলসেল বিক্রির জন্য খোঁজ করতে শুরু করলাম এবং পেয়েও গেলাম।

 শাম্মি

জাগো নিউজ: পোশাক নিয়ে কেন কাজ করছেন?
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: যেহেতু আমি দেশি ব্লক এবং প্রিন্টকে রিপ্রেজেন্ট করছি। তাই মনে হলো মানুষের পোশাক সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল। এতে যদি আমাদের ব্লক এবং প্রিন্ট ব্যবহার করি তাহলে গ্রহণযোগ্যতা আরও দৃঢ় হবে। ব্যবহার যোগ্যতাও বাড়বে। বিছানার চাদর ও কুশন এগুলোতেও কাজ করা যায়। এগুলো আমরা কিন্তু সচরাচর কিনি না। যতটা না আমরা পোশাক কিনে থাকি। তাই আমার মনে হয়েছে, এই জায়গাটাতে কাজ করলে দেশের ব্লক, বাটিক ও স্ক্রিন শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কেননা পাশের দেশের ব্লক বাটিকের ওপর আমাদের অনেকেরই খুব ঝোঁক আছে। সেখানে যদি ভালো মানের এবং ইউনিক ডিজাইনের পোশাক তৈরি করতে পারি তাহলে অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হবে না।

জাগো নিউজ: সংসার সামলে উদ্যোক্তা হওয়ার চ্যালেঞ্জ কেমন ছিল?
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: কাজ করতে গেলে মেয়েদের আসলে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। সংসার সামলে উদ্যোক্তা হওয়াটা কিন্তু অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বাচ্চার দেখাশোনা, রান্নাবান্না সব করে তিন নাম্বার কাজটা ছিল আমার উদ্যোগের পেছনে সময় দেওয়া। অনেক সময় দেখা যেত মেলা করবো, কিন্তু বাচ্চা কোথায় থাকবে ইত্যাদি। সেই সময় দেখা গেছে, আমার মা কিছুটা হলেও সাহায্য করেছেন। মজার বিষয় হলো, তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না আমি কোনো কাজ করি বাচ্চা ফেলে। যেটা আসলে সব না হলেও অনেক বাবা-মা-ই মনে করেন। অনেক বকা খেয়েছি তারপরও পিছিয়ে যাইনি। অনেক সময় ছোট বাচ্চাকে নিয়েই কাজের বিভিন্ন জায়গাগুলোয় দৌড়াদৌড়ি করেছি।

জাগো নিউজ: কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন কি?
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছি এটা সত্য। কেননা এখনকার মতো সবকিছু এতটা সহজলভ্য ছিল না। তখন গুগলে সার্চ দিলে সোর্সিং খুঁজে পাওয়া যেত না। র’ মেটেরিয়াল, রং, কাপড় কোথা থেকে কিনলে কম দামে পাওয়া যাবে, হোলসেল কোথায় আছে—জিনিসগুলো সে সময় যারা নিজ উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করেছে, তাদের জন্য অনেকটাই কষ্টসাধ্য। থান কাপড়ের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে হয়েছে। খুঁজতে হয়েছে তারা কোথায় এগুলো বানায়। এখন মেয়েরা অনেক জায়গায় যায় এবং কেউ অন্যভাবে দেখে না। কিন্তু আমি যখন কাজ শুরু করেছি; তখন মেয়েদের সব জায়গায় যাওয়াটাও একটা ব্যারিয়ার ছিল। পুরুষ হোলসেলাররা এখন অনেক কোঅপারেট করেন এবং সম্মান দিয়েও কথা বলেন। আমি যে সময় কাজ শুরু করেছি; সেই সময়টায় এভাবে কোঅপারেশনটা ছিল না। এখন প্রোডাক্ট বানালে বিক্রি করার জন্য অনেক জায়গা আছে। যখন আমি কাজ শুরু করেছি; তখন এসব কিছুই ছিল না। তখন শুধু মেলায় ছিল পণ্য বিক্রি করার একমাত্র মাধ্যম। এ ছাড়া যেহেতু দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছি, তাই ২০১৩-১৪ সালের দিকে শুরু হলো ইন্ডিয়ান-পাকিস্তানি কাপড়ের দৌরাত্ম্য। সেই সময়টাতে আমাদের দেশীয় পণ্য নিয়ে টিকে থাকাটা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল। তারপরও আল্লাহর রহমতে চালিয়ে যেতে পেরেছি এবং এখন পর্যন্ত টিকে আছি।

 শাম্মি

জাগো নিউজ: কেন আপনার পণ্য কিনবে? আপনার পোশাকের বিশেষত্ব কী?
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: আমার টার্গেট কাস্টমার আসলে নির্দিষ্ট শ্রেণির। যারা একটু ভিন্ন ধরনের পোশাক পরতে পছন্দ করেন। সেটি অবশ্যই আনকমন এবং ইউনিক হতে হবে। আমি প্রত্যেকটা পোশাক খুব বেশি পরিমাণে তৈরি করি না। যেন কমন না হয় এ কারণে। এ ছাড়া রং, কাপড়ের মান অনেক ভালো দিয়ে থাকি। সালোয়ার কামিজের বিষয়ে যেটা বলবো, সেখানে একটা সুনাম আছে। সেটা হলো আমি ওড়নাগুলো অনেক বড় এবং চওড়া দিয়ে থাকি, যেটা সবার খুব পছন্দ। এ রকম ছোট ছোট অনেক বৈশিষ্ট্যের কারণেই আমার পোশাক অনেকের কাছে অনেক পছন্দের।

জাগো নিউজ: নারীদের কর্মসংস্থানে কেমন ভূমিকা রাখতে পেরেছেন?
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: যেহেতু আমি একজন মেয়ে, তাই আমি সব সময়ই চিন্তা করি আমার কাজের জায়গায়ও আমি মেয়েদের কাজ করার সুযোগ করে দেব। এই ভাবনা থেকে আমার কারখানায় ছেলেদের পাশাপাশি মেয়ে কর্মী আছে। আমার নিজস্ব শোরুম আছে। যেখানে দুজন মেয়ে বিক্রয়কর্মীও আছেন। পাশাপাশি আমার শোরুমে আরও চারজন নারী উদ্যোক্তাকে তাদের পণ্য ডিসপ্লে করার ছোট্ট স্পেস শেয়ার করেছি। আমার মতো ছোট উদ্যোক্তা যারা আছেন; যাদের একা শোরুম দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই কিন্তু একটা জায়গা প্রয়োজন। তাদেরও আমি এই শোরুমে জায়গা করে দিয়েছি; যাদের নিজস্ব পূর্ণ ডিসপ্লে করার এবং বিক্রি করার।

জাগো নিউজ: আপনার এ উদ্যোগের পেছনে কার অনুপ্রেরণা ছিল?
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: আমার কাজের অনুপ্রেরণায় ছিলেন আমার বাবা। তিনি হয়তো আমাকে পুঁজি হিসেবে অর্থ কিংবা অন্য সুবিধা দিয়ে সাপোর্ট করতে পারেননি। কিন্তু আমি যে কাজ করছি, এটা কিভাবে করছি, কী করলে ভালো হবে, হিসেব কিভাবে রাখতে হবে ইত্যাদি এমন ছোটখাটো বিষয়গুলো আমার সাথে আলোচনা করতেন। যেটা আমাকে আমার কাজকে অনেক অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

 শাম্মি

জাগো নিউজ: এই উদ্যোগ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: আমার উদ্যোগ নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো—আমি চাই, দেশীয় পোশাকের বাজার আরও বিস্তৃত করতে। যাতে আমাদের ভিনদেশি পোশাকের ওপর নির্ভর করতে না হয়। দেশীয় পোশাকের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ইউনিক ডিজাইনের গুণগত মানসম্পন্ন পোশাক ক্রেতার হাতের নাগালে পৌঁছে দেবে। সুদূর ভবিষ্যতে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইলের কাঠ ব্লক, স্ক্রিন ও ফয়েল প্রিন্টের পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে। এ ছাড়া স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইল এখন ছোট উদ্যোক্তাদের সাথে নিয়ে মাল্টিব্র্যান্ড শোরুম খুলে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমি যেমন স্বাবলম্বী হবো, আমার সাথে আরও কিছু উদ্যোক্তাকেও স্বাবলম্বী করার সুযোগ করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখি। কেননা শুধু পণ্য বানালেই হবে না। সেটা বিক্রি করার একটা জায়গা প্রয়োজন। সেই জায়গা এখন স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইলের মাধ্যমে অন্য ছোট উদ্যোক্তারাও পাবেন।

জাগো নিউজ: আপনি তো একজন সফল উদ্যোক্তা। তরুণদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
শামীম আরা আজিজ শাম্মি: আসলে আমি একজন সফল উদ্যোক্তা কি না জানি না। নিজের কাজের ক্ষেত্রে এখনো কতটুকু সফল হতে পেরেছি, তা-ও জানি না। কারণ মানুষের আসলে শিক্ষারও শেষ নেই, কাজেরও শেষ নেই। তবে আমার অভিজ্ঞতার থেকে আমি নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে এতটুকু বলব, সর্বপ্রথম যেটা বুঝতে হবে উদ্যোক্তা মানে কী? আর একজন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী কিন্তু এক নয়। এটাও তাদের জানতে হবে। যে কোনো কাজে নামার আগে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা, বাজারে অ্যানালাইসিস করে নামা উচিত। ১০০ টাকা দিয়ে কিনে ২০০ টাকা বিক্রি করলাম—এমন পদ্ধতি অবলম্বন না করাই শ্রেয়। একটি পণ্যের কিভাবে মূল্য নির্ধারণ করতে হয়—সেই বিষয়টা শিখতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে। ইদানিং এরকম না বুঝে হুট করে উদ্যোক্তা হবো কিংবা ব্যবসা করবো—এরকম ভাবনা থেকে অনেকেই নেমে যাচ্ছেন কাজে। এতে আসলে খুব বেশিদিন তারা টিকে থাকতেও পারছেন না। মাঝখান দিয়ে অন্যের বাজার তারা নষ্ট করে ফেলছেন। তাই আমি বলবো, নিজের ক্ষতি এবং দেশের ক্ষতি না করে যে কোনো কাজ করার আগে সেই কাজ সম্পর্কে পুরো ধারণা নিয়ে তারপরে নামতে হবে। অবশ্যই যথেষ্ট পরিমাণ সময় সেখানে দিতে হবে—শেখার জন্য ও বোঝার জন্য।

এসইউ/জেআইএম

Read Entire Article