‘ডিজিটাল সরকার ও অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক বিনিয়োগ প্রকল্পে ৫১৩ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কী কারণে এই বরাদ্দ রাখা হয়েছে, এই টাকায় কী কী কাজ করা হবে তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। প্রকল্পের আওতায় একটি টাকা খরচ করলেও তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) উল্লেখ থাকতে হয়। অথচ থোক বরাদ্দের ক্ষেত্রে তা উল্লেখ নেই।
এদিকে নানা কারণ দেখিয়ে প্রকল্পের মাঝপথে ছয় কোটি মার্কিন ডলার বা ৭১২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ঋণ কমিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্প সহায়তা হিসেবে দুই হাজার ৫০৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথা ছিল তাদের।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণেই প্রকল্প থেকে ঋণ কমিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
অন্যদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলছে, কোনো কারণ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় ৫১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা অনিয়ম। এটা খতিয়ে দেখা হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণে বাস্তবায়ন হচ্ছে। দুই হাজার ৫৪১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়ন করার কথা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটি যৌক্তিক নয় বলে প্রকল্পের পুরো বরাদ্দ বাতিল করা হচ্ছে বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে।
আরও পড়ুন
- বাদ পড়তে পারে অনেক প্রকল্প, মেগায় কাটছাঁট
- জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অধিক নজর
- ৫৪ লাখ টাকার কম্পিউটার সামগ্রীর মেরামত ব্যয় ৫০ লাখ!
- শুরুই হয়নি ৩৪ বাফার গুদামের নির্মাণকাজ, ব্যয় ৩২২ কোটি
‘কাজ না দেখিয়ে’ ৫১৩ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক মো. সাখাওয়াৎ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, প্রাইস কন্টিনজেন্সি ও সিডি ভ্যাট বাবদ এই টাকা রাখা হয়েছিল। তবে সংশোধিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) করা হচ্ছে। সেখানে এটা ঠিক করা হবে।
ছয় কোটি ডলার ঋণ কমিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, প্রকল্পের ডিপিপি পাস হতে সময় লাগে। এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি হয়। প্রকল্পের ধীরগতির কারণেই বিশ্বব্যাংক ঋণ কমিয়ে দিয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় এটা বন্ধ করা হবে। আমি আগের দায়িত্বে ফিরে যাবো।’
প্রকল্প সংশোধনের বিষয়ে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল জানায়, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার রূপকল্প ২০৪১ প্রণয়ন করে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে। সরকারের নতুন রূপকল্প ও উন্নয়ন দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃজনের প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে কার্যক্রমের সমন্বয় সাধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া, বর্তমান সময় থেকে প্রকল্প মেয়াদের অবশিষ্ট সময়ে বৈদেশিক ঋণ অংশের লোন ডিসবার্সমেন্ট রেট বিবেচনায় এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার পরিবর্তনজনিত কারণে বৈদেশিক অর্থায়ন অংশের মূল্যমানে পরিবর্তন আসায় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পাদিত ফিন্যান্সিয়াল এগ্রিমেন্টে কিছু সংশোধন আনা হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল যতই প্রকল্প সংশোধনের কথা বলুক, এর যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না পরিকল্পনা কমিশন। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ বাদ দিয়ে জীবনজীবিকা ও ব্যবসাবান্ধব প্রকল্পে নজর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের। ফলে এমন রাজনৈতিক প্রকল্পের কপাল পুড়ছে বলে জানায় কমিশন।
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল থেকে জানা গেছে, ঋণ চুক্তির মেয়াদ অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ২০২৫ এর মধ্যে রিস্ট্রাকচারিং প্রস্তাব অনুযায়ী উন্নয়ন সহযোগীর অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। জুন ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় ৩৩৭ কোটি ২১ লাখ যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। প্রকল্পের টাকা দ্রুত খরচ করার জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতেও ৫০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমান ঋণ সময়সীমা অনুযায়ী অবশিষ্ট অর্থ ব্যয়ের জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের তিন মাস সময় পাওয়া যাবে। এজন্য প্রকল্পের সব ঋণ খরচের জন্য মেয়াদও ২০২৬ সাল নাগাদ বৃদ্ধির পরিকল্পনা হচ্ছে।
এসব নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প যাচাই করে বাতিল করা হবে। কোনো প্রকল্পে কিছু টাকা খরচ হলেই প্রকল্প শেষ করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। যৌক্তিক অর্থনৈতিক বিবেচনা হলো- কত খরচ করেছি বিষয় এটা নয়। বাকি কাজ করতে কত লাগবে সেটা বড় বিষয়। পুরো প্রকল্প থেকে কত সুবিধা পাবো এটাই বিষয়। প্রকল্পে লাভ-ক্ষতি দেখতে হবে। কিছু খরচ হয়ে গেছে বলে মানসিক চাপ থাকবে, প্রকল্প শেষ করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। এটা অর্থনীতির যুক্তিতে চলে না। প্রকল্প থেকে জনগণ সুবিধা না পেলে বাতিল করা হবে।
আরও পড়ুন
- দেশে সরকারিভাবে প্রথম ভাসমান রেস্তোরাঁ নির্মাণের উদ্যোগ
- বিশ্বমানের হবে পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বিদেশিদের পড়াশোনার সুযোগ
- ব্যয়-মেয়াদ বাড়িয়েও নির্মাণে ‘ফাঁকি’, ঝুঁকিতে রেলপথ
- ইঁদুরে বেহাল সড়ক বিভাজক, বিটুমিন ব্যবহারেও অবহেলা
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে সব প্রকল্পে সমস্যা আছে তা বাতিল করা হবে। এ প্রকল্পটি এত জরুরি নয়। এ প্রকল্পের অনিয়ম খতিয়ে দেখা হবে, কোনো ছাড় দেবো না। প্রকল্প যেটা জরুরি সেটা রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেবো। কেউ যদি বলে ১০০ টাকার প্রকল্পে ২০ টাকা খরচ করেছি বাকি ৮০ টাকা দেন তা হবে না। আমরা বাকি ৮০ টাকা রক্ষা করতে চাই। এসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করে জনবান্ধব ও দেশের জন্য মঙ্গলকর প্রকল্প নেওয়া হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যয় সংকোচনে উন্নয়ন ব্যয় কমানোর বড় জায়গা। প্রকল্প যাচাই করা জরুরি। প্রকল্পে বিশৃঙ্খলা আছে। অনেক বড় প্রকল্পে সমস্যা আছে। প্রকল্প রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। এটা যাচাই করে ছাঁটাই করতে হবে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, চলমান থাকলে রাখতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। নকশা, ব্যয়, সময়সীমা নিয়ে অনিয়ম আছে। অনেক প্রকল্পে দুর্নীতি আছে, যা কম খরচে হতে পারতো। নকশায় ত্রুটি আছে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে প্রকল্পে বেশি খরচ, অনেক প্রকল্প আছে, কেন আছে জানি না। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এমওএস/এমএইচআর/এমএমএআর/এএসএম