কারা হেফাজতে তরুণ ব্যবসায়ী আদনানের মৃত্যু, নেপথ্যে কি?

1 month ago 10

 

প্রবাসী কর্মী ও রাষ্ট্রকে জিম্মি করে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের হোতা ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুহুল আমিন স্বপনের কর্মচারীর করা মামলায় গ্রেফতারের পর কারাগারে মারা যান তরুণ ব্যবসায়ী আদনান খন্দকার। তিনি রাজ ওভারসিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।

যে মামলায় তাকে গ্রেফতার ও কারাগারে পাঠানো হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তেমনি প্রশ্ন উঠছে মামলায় বর্ণিত বিপুল টাকার লেনদেন কীভাবে হলো তা নিয়েও। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, এ লেনদেনের নামে আদনান খন্দকারকে সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদকে দিয়ে হয়রানির টার্গেট করেছিলেন ক্যাথারসিজ ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুহুল আমিন স্বপন, যার বিরুদ্ধে চক্র গড়ে ও অনিয়মের মাধ্যমে কর্মী পাঠিয়ে মালয়েশিয়ার বাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধের কারণ হয় বারবার।

২০২৪ সালের ২১ মে ব্যবসায়ী আদনান চেকের মাধ্যমে রুহুল আমিন স্বপনের কাছ থেকে ৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা ধার নিয়েছেন— এমন অভিযোগ এনে ঘটনার ১৩ মাস পর গত ২ জুলাই ভাটারা থানায় ‘প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ এবং অপরাধমূলক ভয়ভীতি প্রদর্শনের’ মামলা করা হয় স্বপনের পক্ষে।

রুহুল আমিন স্বপন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ী বলে প্রচলিত আছে। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে স্বপনও দেশ ছাড়েন। তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একাধিক মামলা রয়েছে।

পলাতক স্বপন তার কর্মচারী মোহাম্মদ শাহ আজমকে দিয়ে আদনানের বিরুদ্ধে মামলাটি করান। এ ধরনের ঘটনায় মামলা নেওয়া থেকে শুরু করে আসামি গ্রেফতার এবং কারাগারে পাঠানো পর্যন্ত অতিরিক্ত তৎপর ছিল পুলিশ- এমন অভিযোগও উঠেছে।

বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের বিরোধ ও চেক ডিজ-অর্ডারের ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে মামলা দায়েরের একটা সাধারণ রীতি চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে সেটি পালন করা হয়নি বলে জানা গেছে।

মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে— ব্যবসায়ী আদনান ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুহুল আমিন স্বপনকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ দাখিল করা হয়নি।

মূলত ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকে বিশেষ করে বিদেশে লোক পাঠানো নিয়ে স্বপন কৌশলে তরুণ ব্যবসায়ী আদনানকে গ্রেফতার করান— অভিযোগ রাজ ওভারসিজের কর্মচারীদের।

রাজ ওভারসিজের কর্মচারীরা জানান, সাবেক ডিবিপ্রধান (বর্তমানে পলাতক) হারুন অর রশীদের সঙ্গে রুহুল আমিন স্বপনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। স্বপনের অফিসে প্রায় সময় আড্ডা জমাতেন হারুন ও তার সহযোগীরা। বিদেশে শ্রমিক পাঠানো নিয়ে আদনানের সঙ্গে কিছুটা বিরোধ ছিল স্বপনের। সেসময় আদনানকে শায়েস্তা করতে হারুনকে ব্যবহার করেন স্বপন।

রাজ ওভারসিজের একজন কর্মচারী জানান, গত বছরের মে মাসে আদনানকে জিম্মি করে দুটি চেকে তার সই নেওয়া হয়। এতে ডিবি হারুনের ভূমিকা ছিল। নিজেকে হয়রানি থেকে বাঁচাতে নিরুপায় হয়ে আদনান দুটি চেকে সই করেন।

সূত্রমতে, ডিবি হারুনকে দিয়ে স্বপন ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালে ডেকে নেন আদনানকে। সেখানে তাকে জিম্মি করে ভয়-ভীতি দেখানো হয়। পরে আদনানের কাছ থেকে দুটি চেকের পাতায় (পাঁচ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা উল্লেখ করে) সই নেওয়া হয়। একই সঙ্গে একটি লিখিত চুক্তিনামায়ও সই করানো হয় সেখানে।

রাজ ওভারসিজের ওই কর্মকর্তা জানান, গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতন হলে স্বপনের হয়রানি থেকে পরিত্রাণের আশা করেছিলেন ব্যবসায়ী আদনান। তবে স্বপনের জাল থেকে তিনি নিস্তার পেলেন না। ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

প্রশ্ন আসছে, তরুণ ব্যবসায়ী আদনানকে ধারে যে ৫ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন স্বপন তা কেন নিজের আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি। সঠিক চ্যানেলে এই টাকা দিলে অবশ্যই নথিভুক্ত করতেন।

আদনানকে গত ২৪ জুলাই গ্রেফতারের পর ভাটারা থানার ওসি রাকিব উদ্দিন গণমাধ্যমে জানান, বনানী এলাকা থেকে প্রতারণার মামলায় ব্যবসায়ী আদনানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪২০ ও ৫০৬ ধারায় মামলা রয়েছে। আদনানকে গ্রেফতার করার পরপরই বিভিন্ন মহল থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিতে তদবির করা হয়।

আদালতের আদেশে কারাগারে পাঠানোর পর আদনান খন্দকার অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই তরুণ ব্যবসায়ী।

আদনান খন্দকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার সামসুল আলমের (পোখরাজ) ছেলে। বাবার মৃত্যুর পর তিনিই পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনা করতেন।

গত ৬ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে।আদনান খন্দকার কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

কারাগার সূত্রে জানা যায়, গত ২৫ জুলাই চেক ডিজঅনারের একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে আদনান কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। ৬ আগস্ট বেলা ২টা ১০ মিনিটে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার এ কে এম মাসুম বলেন, বন্দি আদনান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন তিনি হৃদ্‌রোগে ভুগছিলেন।

কে এই রুহুল আমিন স্বপন?

রুহুল আমিন স্বপন একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, যার প্রধান ব্যবসা বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি; এই কাজের আড়ালে অবৈধ উপায়ে বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ার অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমে তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অনিময়-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির তথ্য পান এনবিআরের গোয়েন্দারা।

এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল-সিআইসির অনুসন্ধানে তার অনিয়ম-দুর্নীতি, বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি, অর্থপাচারের তথ্য উঠে এসেছে।

সিআইসির মহাপরিচালক খাইরুল ইসলাম বলেছেন, আগের সরকারের আমলে স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা হলেও বারবার আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

ক্ষমতার পালাবদলে সুবাদে সেই অসম্পূর্ণ অনুসন্ধান আবার শুরু হয় এবং এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন খাইরুল ইসলাম।

এছাড়া মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকার জায়গায় গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নেয় মেসার্স ক্যাথারসিজ ইন্টারন্যাশনাল। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে চক্র গড়ে অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে তিনি বিদেশে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন- এমন কথা প্রচলিত আছে এই সেক্টরে।

টিটি/এমএএইচ/

Read Entire Article