কারাগার থেকে কারামুক্তি : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

3 months ago 45

‘‘হ্যাঁ, যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে, পারিপার্শ্বিক সব ধীরে ধীরে জানতে শিখেছি, কেবলই শুনেছি-আব্বা জেলে।’’(শেখ হাসিনা, অন্তরের রক্তক্ষরণ: একটি রাষ্ট্রের জন্ম, বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ২০২১)আজকের রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যখন শিশু তখন থেকে জেল বা কারাগার শব্দের সঙ্গে পরিচয় তারপর বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় শব্দটি তাঁদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে জাতির পিতা ১৯৩৮ সালে মিথ্যা অভিযোগে প্রথম কারাবরণ করে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছিলেন ‘এই আমার জীবনে প্রথম জেল।’

তখন তাঁর বয়স আঠারো।১৯৭১ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক জীবনের পরিসরে ৩০৫৩ দিন বিভিন্ন জেলখানায় সীমাহীন নির্যাতন, কষ্ট, অপমান, অবহেলা সহ্য করেছিলেন তিনি।কেবল ‘কারাগারের রোজনামচা’(২০১৭)পাঠ করলে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর বারবার গ্রেফতার হন।তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হতো এবং সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতারও করা হতো।কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে তিনি আবার অন্য জেলায় সভা করতেন।

সেসময় ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৩৫ দিনে ৩২ টি শহরে বক্তৃতা দেন।৯ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ১৯৬৬ সালের ৯ মে থেকে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কালপর্বের কারাবন্দি জীবনে তাঁর সংসার, সন্তান ও বেগম মুজিবের কষ্ট ও অনিশ্চয়তার কথা লেখা আছে স্মৃতিকথা ও দিনলিপিতে। আইয়ুব-মোনায়েম চক্র সব সময়ই কোনো না কোনো মামলা দিয়ে তাঁকে নিগৃহীত করতে চেয়েছে কিন্তু প্রতিবার প্রতিটি মিথ্যা, বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলার নাগপাশ ছিন্ন করে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। ঠিক একইভাবে ২০০৮ সালের ১১ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করে হয়রানিমূলক মামলার রজ্জু ছিঁড়ে বেরিয়ে আসেন নীলাকাশের মুক্ত প্রান্তরে। এজন্য কবি কামাল চৌধুরী লিখেছেন-

‘‘তোমার স্বপ্নে দূর বিস্তারি আলো

দিগন্তে দেখি অপরূপ উদ্ভাস

প্রিয় স্বদেশের আলোকিত বাতায়নে

আমরা লিখছি আগামীর নীলাকাশ।’’(বাঙালির সম্মান/কামাল চৌধুরী)

২.
সেদিন আমরা বুঝেছিলাম শেখ হাসিনা মুক্ত মানে বাংলাদেশ মুক্ত। স্বাধীনতার প্রহরী আর মাটির পাহারাদার শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভাবনার বিস্তার ঘটে। শেখ হাসিনা এগোলে, এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।যেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জাগানিয়া ভাষা আত্মপ্রকাশ করে কবির রচনায় ‘শেখ হাসিনার জবানবন্দী’ কবিতায় যেমনটি লেখা হয়েছে-

‘‘তোমরা অবরুদ্ধ কৃত্রিম কারাগারের ভেতর আমাকে বন্দী করে রেখেছো।

আমি জানি না, আমার কী অপরাধ।

অথচ আমাকে এই নিঃসঙ্গ, একাকী প্রহরে নিজের ছায়ার ভেতরে

নিজেকেই প্রতিবিম্বিত দেখে মনে হচ্ছে, এই কি আমি?’’ (শেখ হাসিনার জবানবন্দী/অসীম সাহা)

নিঃসঙ্গ শেখ হাসিনা প্রকৃতপক্ষে বলতে পারেন-

‘‘আমি সেই সাহসের সন্তান, নক্ষত্রের বুক থেকে অগ্নি সঞ্চয় করে

জন্ম নেয়া পিতার সাহস নিয়ে মুহূর্ত মুহূর্ত শুধু মহাশূন্য উথাল-পাথাল করে

বিদ্ধ করি অসুরের উদ্ধত বুকের পাঁজর।

আমাকে ধ্বংস করে এরকম দুর্বৃত্তের জন্ম হয়নি পৃথিবীতে আজো।’’(শেখ হাসিনার জবানবন্দী/অসীম সাহা)

এভাবেই কারাগার থেকে কারামুক্তির ভাষ্য রচিত হতে থাকে ইতিহাসের পাতায়- বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনার পথযাত্রায়।আজ আবার এসেছে ১১ জুন।জুন মাসটি নানা কারণে ঐতিহাসিক।৭ জুন ৬ দফা দিবস, ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০২২ সালের ২৫ জুন- পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন। আবার ২৩ জুন পলাশি দিবস, ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করা হয়। জুন মাসের সবগুলো দিবসের কেন্দ্রে আছেন বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা।

বিশেষত ২৫ জুনের ঐতিহাসিক ক্ষণটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের জন্য যেমন, তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বাঁক বদলের দিন হিসেবে স্মরণীয়।আর পদ্মা সেতু নির্মাণের অনন্য সাহসী কাজটি সম্পন্ন হওয়ার জন্য জননেত্রীর দূরদৃষ্টিময় নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।এই নেতৃত্ব দ্রুত সাফল্য নিয়ে এসেছে ১১ জুনের ঘটনার পর। আসলে ২০০৮ সালের ১১ জুন রাজবন্দি শেখ হাসিনার কারামুক্তি এদেশের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে সেনাসমর্থিত মেয়াদোত্তীর্ণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে। দীর্ঘ প্রায় ১১ মাস কারাভোগের পর এই দিন সাবজেলের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হন তিনি।সেই সময়কে স্মরণ করে একজন কবি লিখেছেন-

‘‘জানি, নির্জন কারাগারে প্রতিদিন আপনার দু’চোখ তাকিয়ে

রয় অভাবী জনতার দিকে।

টুঙ্গিপাড়ার দিকে, যেখানে সুনিবিড় ঘুমিয়ে আছেন

জাতির জনক।

আপনার কারাগার এখন পনের কোটি মানুষের কারাগার

হয়ে আছে।

এই বন্দিখানা একদিন জনতার মিছিলের তোড়ে তছনছ

হয়ে যাবে। ছারখার হয়ে যাবে। নিঃশেষ হয়ে যাবে।’’(এই বন্দিখানা একদিন থাকবে না/হালিম আজাদ)

কবির শেষ পঙক্তিটি প্রকৃতপক্ষেই সত্য হয়েছিল।

৩.
মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দি করা হলেও শেখ হাসিনার ২০০৭ সালের ৭ মে আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তন ছিল আমাদের জন্য মঙ্গলকর।ওই বছর ১১ জানুয়ারির পর তাঁর দেশে ফেরার উপর বিধিনিষেধ জারি করে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার।তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।কিন্তু তাঁকে রাজবন্দি করার পর গণমানুষ তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিল; দেশকে নেতৃত্ব শূন্য করার চক্রান্ত স্পষ্ট হয়েছিল। তাঁর সাবজেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেফতারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারজনের মৃত্যুবরণ, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপামর জনগোষ্ঠীকে বিহ্বল ও বিক্ষুব্ধ করে তোলে।

পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষ শেখ হাসিনাকে বারবার যুদ্ধে যেতে হয়েছে। কারণ ‘বেদখল বাংলাদেশ, শৃঙ্খলিত গণতন্ত্র, মেঘে ঢাকা মুক্তির আকাশ... নির্বাসিত দেশপ্রেম, সততা লাঞ্ছিত।’২০০৭ সালে মুজিব দুহিতা কারাবন্দি হওয়ায় দুঃখী মানুষটির জন্য প্রকৃতি ও সাধারণ জনতা আর্তকণ্ঠে বলে উঠেছে ‘‘কেন বন্দি বঙ্গদুহিতা?’’ নেত্রীর বন্দিদশায়-‘বিপন্ন স্বদেশ’- ‘মিশেছে প্রাণের ডাকে সেই কোটি কোটি চোখ/দেখে প্রিয় বাংলাদেশ, বিপন্ন স্বদেশ!’

অবশ্য সে সময় আদালতের চৌকাঠে শেখ হাসিনা ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা; দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত; বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সত্যকথা উচ্চারণে বড় বেশি সপ্রতিভ। আসলে ২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক নাটকীয় ঘটনার জন্ম হয়েছে। সেসময় ‘দুদকে’র দৌড়ঝাপ, ‘মাইনাস টু’র কুশিলবদের উচ্চস্বর ও দাম্ভিকতা, বিচারকদের অসহায়ত্ব আর শেখ হাসিনার জন্য জনগণের বেদনাবোধ অন্যান্য দেশের মানুষকেও আলোড়িত করেছিল। শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য দেশ-বিদেশে যে জোরাল দাবি উঠেছিল তা ছিল অভূতপূর্ব। যদিও ‘‘কালো গাড়িওয়ালারা/গোটা দেশটাকেই কালো চাদরে ঢেকে দেয়/বন্দুকের কাছে সব শক্তি বধির হয়ে যায়।’’(এলিফ্যান্ট রোডে কালো গাড়িগুলো/আবুল আজাদ)

অন্যদিকে দলের সভাপতিকে গ্রেফতারের পর থেকেই আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবর্গ বিভিন্নভাবে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।শেখ হাসিনাকে মুক্ত করা না হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়।তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে স্লো পয়জনিংয়ের কারণে ওই সময় কারাগারের অভ্যন্তরে নেত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য তাকে মুক্তি দেয়ারও দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও রাদওয়ান ববি বিদেশি আইনজীবীদের সহায়তায় মামলা লড়েন এবং নেত্রীর মুক্তির বিষয়ে জনমত গঠন করেন।

২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার হওয়ার সময় শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশে দিক-নির্দেশনামূলক একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে অভিব্যক্ত শেখ হাসিনার সাহসী ও প্রজ্ঞামণ্ডিত উচ্চারণগুলো তখনকার নেতাকর্মীরা অনুসরণ করেছিলেন। কারণ গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সারাজীবন সংগ্রাম করা একজন কর্মঠ নেতার জন্যই অন্যেরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল। আর জনগণের দাবির কারণেই ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্ত হন।

আওয়ামী লীগের ক্রমাগত চাপ, আপসহীন মনোভাব ও অনড় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।ফলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগষ্ঠিতা নিয়ে বিজয় লাভ করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করা হয়।অবসান ঘটে বিএনপি-জামায়াত ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুঃশাসনের কাল।একারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভার গৌরবান্বিত রাষ্ট্র, যার রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, যিনি একটানা ১৫ বছর ৫ মাস ক্ষমতায় আসীন।

৪.
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে খুন করার সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে দুঃখের কষ্টিপাথরে সহিষ্ণুতার দীক্ষায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন ২০০৭ সালে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবার পর।

পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই দীর্ঘ ২১ বছর পর সম্ভাবনার বাংলাদেশে তিনি হন প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অমানিশার দুর্যোগে প্রাণ বাঁচানোর দুঃসহ স্মৃতি; অর্থাৎ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া জীবন নিয়ে আবার নির্যাতিত জনগণের জন্য রাতদিনের পরিশ্রম- কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর সময় হঠাৎ করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি হলেন; শুরু হলো আরেক জীবন। সেই জীবনের স্মৃতি আছে তাঁর রচনায়, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে।

কারাগারে বন্দি শেখ হাসিনার অন্তর অপমান ও কষ্টে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তিনি কখনো মনোবল হারাননি।২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তাঁকে বন্দি করে সংসদ ভবনের একটি বাড়িকে সাবজেলে পরিণত করা হয়।ওই সাবজেলের ভবনটি ছিল অত্যন্ত ময়লা ও নোংরা।পুরোনো গদি ছেঁড়া কাপড় চোপড়, পুরনো কাগজপত্র সব ছড়ানো। খাটখানা ব্যবহারের উপযুক্ত ছিল না।খাবার আসতো কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে।মাঝে মাঝে খাবার আসতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো।আর খাবারের মেনুও সস্তা জিনিসে ঠাসা ছিল।দুঃখের দিনে কষ্টের মাঝে পড়ে তিনি জাতির পিতার কথা স্মরণ করতেন।কারণ নিঃসঙ্গ কারাগারে তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিল স্মৃতি।

অনেক কথাই তাঁর মনে পড়ত।মনে পড়ত-বঙ্গবন্ধুকে কারাগারের বন্দিজীবনে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।তাঁকে জেলখানায় সংকীর্ণ সেলের ভেতরে রাখা হতো।প্রকৃতপক্ষে বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন আর দিবসরজনী কষ্ট সহ্য করে গেছেন। ১৯৭১ সালের বন্দি করে তাঁকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে নেওয়া হয় যেখানে গ্রীষ্মকালে যেমন গরম, তেমন শীতের সময় শীত। রুটি ডাল ছাড়া কিছুই পেতেন না খেতে।অথচ ওই খাবার তিনি কখনোই পছন্দ করতেন না।তারপরেও তাঁর মুখ থেকে কোনও দিন কোনও কষ্টের কথা কেউ শোনেননি।নিজের কষ্টের কথা তিনি সব সময় চেপেই রাখতেন। শেখ হাসিনাও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন রাজনীতিবিদ যিনি নিজের কষ্ট গোপন করে অপরের দুঃখে সবসময় কাতর হন।

সাবজেলের ওই বাড়ির উত্তর দিকের জানালা দিয়ে গণভবন দেখা যেত। কষ্টের মধ্যেই কারাগারের জানালায় সকাল-বিকাল দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে গণভবন দেখতেন যেখানে তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবস্থান করেছিলেন।সবুজ মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় জনগণের চলাফেরা অবলোকন করতেন।ইচ্ছে হলেই বের হতে পারতেন না।কারণ তিনি তো বন্দি, দোতলায় একদম একা।বাইরে বের হওয়ার স্বাধীনতা নেই।কিন্তু তাঁর মনটা স্বাধীন ছিল, মনের কল্পনায়ই তিনি সবুজ মাঠ পেরিয়ে চলে যেতেন স্বপ্ন রাজ্যে।ওই বাড়িটার চারিদিকে অনেক গাছ ছিল।সেই প্রকৃতির প্রাণময়তা তাঁকে তৃপ্তি দিত।মানসিক চাপ আর দেশ ও জনতার চিন্তার মাঝে স্বস্তি খুঁজে নিতেন।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে সংসদ ভবনের কয়েকটি বাড়িতে স্পেশাল কোর্ট বসানো হয়েছিল।তারপর একটার পর একটা মামলা দিয়ে হয়রানি করতে থাকা হয় শেখ হাসিনাকে।সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আবিষ্কার হলো সব চেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ তিনি।তাই তারা তাঁকে প্রথমে দেশের বাইরে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্ত সফল হয়নি।পরে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে বিনা ওয়ারেন্টে টেনে হিঁচড়ে কোর্টে নিয়ে গিয়ে তারপর সাবজেলে ১১ মাস বন্দি করে রাখে।

তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর বিচারের নামে প্রহসন চলে।তখন বিচারকরা তাদের বিবেক, চিন্তা, জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে বিচার করতে পারেন নি।উচ্চ আদালতে শপথ মোতাবেক বিচারকরা কাজও করেননি। বিচারকদের উপর গোয়েন্দাদের চাপ অব্যাহত ছিল।এজন্য তাঁকে জামিন দিতে নিষেধ করা হয়েছিল।উপরের নির্দেশে মামলার রায় হতো তখন।তিনি তখনকার ক্ষমতাবানদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যারা আজ ক্ষমতায় তাদেরও ভবিষ্যতে কারাগারে থাকতে হবে না এই গ্যারান্টি কি পেয়েছে? ক্ষমতার মসনদ ও কারাগার খুব কাছাকাছি।

সরকার প্রথমে চাঁদাবাজির মামলা দেয় তিন কোটি টাকার।যারা চাপে পড়ে মামলা করেছিল তারা ভাল করেই জানত তাদের কাছে শেখ হাসিনা কোনদিন চাঁদা চাননি।ওদের তিনি চেনেনও না।অথচ মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে যাতে অংশ নিতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করার জন্যই যাকে খুশি তাকে দিয়েই যা খুশি তা বলানো হতো। একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল সেসময়ের প্রশাসন।কারণ তারা জানত নির্বাচন হলে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে। তারা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে।‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ শেখ হাসিনার এসব ভাবনা বাস্তব হয়ে উঠেছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় লাভের মধ্য দিয়ে।

শেখ হাসিনা সাবেক-প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসকদের দ্বারা মিথ্যা মামলায় হয়রানি ও কারা-যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন দুর্ভাগ্যবশত। কারণ স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের মতো নিপীড়ক শাসক থাকার কথা ছিল না, দেশও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছিল। অথচ দেশ-বিদেশে বেঁচে থাকা বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা তখনও সক্রিয়। তাছাড়া শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের একাধিকবার চেষ্টা চলেছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে’র পর থেকেই যা ২০২০ পর্যন্ত ২১ বার হিসাবে তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য দেয়। আগেই বলেছি, সাবজেলে থাকার সময় স্লো পয়জনিংয়ে তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।

৫.
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল চাঁদাবাজির। অথচ ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতাকালে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের হলেও কখনো চাঁদাবাজির মামলা করা হয়নি। এজন্য শেখ হাসিনার মনে হয়েছে, মামলাবাজ জোট সরকার থেকেও বড় আবিষ্কারক ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার জন্য তিনি আন্দোলন করেছিলেন। আটষট্টি জন মানুষ জীবন দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী ও পুলিশ বাহিনীর হাতে। সেই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।

যে নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। চারদলীয় জোটের ভোট কারচুপির নীলনকশা প্রতিহত করার জন্যই আন্দোলন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করে গণতন্ত্রকে সুসংহত করাও তাঁর মূল টার্গেট ছিল। নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর ভাষায়- ‘আন্দোলন করে দাবি পূরণ করলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করলাম। যেই দ্রুত নির্বাচনের কথা বললাম, সেই আমি চাঁদাবাজ হয়ে গেলাম, দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলাম। আমার স্থান হল কারাগারে। পাঁচটি বছর চারদলীয় জোট তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আমার ও আমার পরিবারের দুর্নীতির কোন কিছু পায় কিনা, পায় নাই। পেয়েছে ফখরুদ্দীন সরকার।’

দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ শেখ হাসিনা জেলে থাকার কারণে তাঁর সন্তান পুতুল-জয়ের পাশে সব সময় থাকতে পারেননি। এই বেদনা তিনি তুলে ধরেছেন নিজের লেখায়।রাজনীতির জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা বঙ্গবন্ধুর লেখনিতেও রয়েছে।অনুরূপভাবে একজন বন্দি মা কতোটা অসহায়, তার বর্ণনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। তার একমাত্র কন্যা পুতুল মা হবেন; থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মা হিসেবে মেয়ের কাছে থাকাটা খুব দরকার।যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেও যেতে দেওয়া হয়নি।সেই সময়ের প্রশাসন আটকে দিয়েছিল তাঁর বিদেশ ভ্রমণ।

‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে এভাবেই তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন কারান্তরালে যাপিত জীবনের স্মৃতিকথায়।তিনি ওই গ্রন্থে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের চুলচেরা ব্যবচ্ছেদ করেছেন।সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চাপে চাঁদাবাজির মামলাগুলো কীভাবে করা হয়েছিল তাও তিনি জানতেন।গণতন্ত্রকে সুসংহত করা এবং জনগণের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টাকে চিরতরে বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল যারা, তারা গোপনে ষড়যন্ত্র করে মানুষকে সামরিক শাসন উপহার দিতে চেয়েছিল।

২০০৭ সালে প্রথমে সশস্ত্রবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়। নির্বাচনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করে- দুই বছর পর নির্বাচন হবে। সাধারণ মানুষ নির্বাচন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। অথচ তখন নতুন নতুন দল গঠন করা হচ্ছে। ‘মাইনাস টু’ অনুসারে তৃতীয় শক্তির উত্থান প্রত্যাশা করছে শাসকগোষ্ঠী। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের সুদখোর, কালোটাকার মালিকরা টাকা সাদা করে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছে। অন্যদিকে ‘দুদক’কে দিয়ে রাজনীতিবিদদের জনগণের কাছে বিতর্কিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার, একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে সিনিয়র রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নয়টি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ছয়টি মোট ১৫টি মামলা করা হয়। একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এবং তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে ‘দুদক’কে ব্যবহার করে। ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বিদেশি প্রতিষ্ঠান নাইকোকে অবৈধভাবে গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ এনে শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করে ‘দুদক’।

২০০৮ সালের ৫ মে এ মামলায় নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলার দায় থেকে অব্যাহতির জন্য শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে হাইকোর্টে বাতিল আবেদন করলে ৭ জুলাই হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন। এই রুলের উপর শুনানি শেষে আদালত মামলাটি বাতিল ঘোষণা করেন। এভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা সব মামলার পরিসমাপ্তি ঘটে। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উদঘাটিত/প্রমাণ হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মামলাগুলো করা হয়েছিল। এজন্য হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিধিমালার অসঙ্গতি দূর করতে তা সংশোধনেরও নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

৬.
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার হওয়ার সময় শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশে দিক-নির্দেশনামূলক একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে অভিব্যক্ত শেখ হাসিনার সাহসী ও প্রজ্ঞামণ্ডিত উচ্চারণগুলো তখনকার নেতাকর্মীরা অনুসরণ করেছিলেন। কারণ গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সারাজীবন সংগ্রাম করা একজন কর্মঠ নেতার জন্যই অন্যেরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল। আর জনগণের দাবির কারণেই ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্ত হন।

১১ জুনের প্রভাবে ও তাঁর সৎ নেতৃত্বের কারণেই নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অতীতের জেল-জুলুম, হত্যার প্রচেষ্টা এবং হুমকি আর বর্তমানের অপপ্রচারের মধ্যেও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে ২০৪১ সালেই বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে- এটা নিশ্চিত। ২০২৪ সালে তাঁর কারামুক্তি দিবস উন্নয়ন-বিপ্লবের বিস্ময়কর জয়যাত্রায় পরিপূর্ণ।কবি কামাল চৌধুরী লিখেছেন-

‘‘কাণ্ডারি তুমি সাহস এবং শক্তি

সারা পৃথিবীতে বাঙলার জয়গান

মুজিব কন্যা তুমি আজ বাতিঘর

তুমি বাঙালির অনিঃশেষ সম্মান।’’(বাঙালির সম্মান/কামাল চৌধুরী)

লেখক : বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article