কারাগারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে

3 months ago 11

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন কারাগার ভেঙে ও পুড়িয়ে প্রায় দুই হাজার ২০০ বন্দি আসামি পালিয়ে যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কঠিন সময়ে কারাগারের হাল ধরেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন। ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি।

সেনাবাহিনীর এই চৌকশ কর্মকর্তা দায়িত্ব গ্রহণের পর কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসন্তোষ থেকে শুরু করে অনেক কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেন। ধীরে ধীরে গ্রেফতার ও আত্মসমর্পণ হতে থাকে পালিয়ে যাওয়া আসামি। অন্যদিকে কারাগারগুলোতে সংস্কারের কাজ চলতে থাকে। বর্তমানে দেশের সবকয়টি কারাগার সচল রয়েছে এবং কারাগারের সমস্যাগুলোর সমাধানে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন ১৯৯৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৩১তম বিএমএ লং কোর্সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পদাতিক কোরে কমিশন লাভ করেন। অসামান্য পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে তিনি বিভিন্ন কমান্ড, স্টাফ ও ইন্সট্রাকশনাল অ্যাপয়েন্টমেন্টে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশনস ট্রেনিং (বিপসট) এবং স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও (এসএসএফ) সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন ক্রীড়াপ্রেমী এবং কৃতী গলফার। কারা মহাপরিদর্শক হিসেবে যোগদানের আগে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোতাহের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) মহাপরিচালক হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

কারাগারের বিভিন্ন সংকট, কারাগারের ভেতর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মোবাইলে কথা বলা, ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের সুবিধা দেওয়ার গুঞ্জন, কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অ্যাকশন, কারাগারে মাদক, বন্দিদের ভার্চুয়ালি হাজিরাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোতাহের হোসেন। বিশেষ এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়। তিন পর্বের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথম পর্ব

জাগো নিউজ: ৫ আগস্টের পরে কারাগারগুলো কি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে? কী কী সংকট রয়েছে এখনও?

কারা মহাপরিদর্শক: ৫ আগস্টে কারাগারগুলোতে যে ঘটনা ঘটেছিল তা দেশের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। কারাগার ভেঙে বন্দিদের নিয়ে যাওয়া, কারাগার জ্বালিয়ে দেওয়া, কারারক্ষীদের ওপর আক্রমণ, সবকিছু মিলিয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বাংলাদেশ দেখেছে। আমি কারা মহাপরিদর্শক হিসেবে যোগ দেই ১১ আগস্ট। এসে দেখি আমাদের অনেক স্টাফের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে। পালিয়ে না যেতে পারা বন্দিদের মধ্যে ছিল অসন্তোষ। কারণ কেন তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না। সে সময় ৬৮টি কারাগারের মধ্যে পাঁচটি কারাগারে বন্দি পালানোর ঘটনা ঘটেছিল। বিশৃঙ্খলা হয়েছিল ৬৮টি কারাগারেই। এছাড়া কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও অসন্তোষ ছিল। কারণ দীর্ঘদিন ধরে কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে সুযোগ-সুবিধা ও পদায়নের ক্ষেত্রে। প্রায় ১০ মাস হতে চললো। অনেক সমস্যাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি আমরা।

৫ আগস্ট কারাগার রক্ষা ও বন্দিদের পালাতে বাধা দেওয়ার কারণে ২০২ জন কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হয়েছিলেন। তখন ১১৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় কারগারগুলোতে। যে কারাগারগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল সেগুলো সচল করা হয়েছে। বর্তমানে সব কারাগার সচল এবং সব কারাগারেই বন্দি রয়েছে।

জাগো নিউজ: ৫ আগস্টের পর চ্যালেঞ্জ কী কী?

কারা মহাপরিদর্শক: মূল চ্যালেঞ্জ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা। অতীত কৃতকর্মের জন্য আমাদের ডিপার্টমেন্টের ইমেজ খারাপ নজির সৃষ্টি করেছে। আমাদের সম্পর্কে কেউ ভালো বলে না। আমার কাছে এটি বড় চ্যালেঞ্জ মনে হয়েছে। ইমেজ ঠিক করতে গেলে কাজ করে প্রমাণ করতে হবে। ওই জায়গায় কাজ করা হচ্ছে।

কারাগারের দুটি স্টেকহোল্ডার রয়েছে। এক. কারাগারের বন্দি, দুই. বন্দিদের আত্মীয়-স্বজন যারা বিভিন্ন সময় কারাগারে আসেন। এ দুটি সেবা স্বচ্ছ করতে পারলে চ্যালেঞ্জ ওভারকাম করা যাবে। কারাবন্দিদের সঙ্গে যারা দেখা করতে আসে তাদের জন্য শিগগির অটোমেশন চালু করা হবে। অ্যাপসের মাধ্যমে বন্দির আত্মীয়-স্বজনের সাক্ষাৎ অটোমেশনের আওতায় আনা হবে।

জাগো নিউজ: এখনও ৭০০ বন্দি পলাতক, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কতজন?

কারা মহাপরিদর্শক: ৫ আগস্ট কারাগার ভেঙে প্রায় ২২০০ আসামি পালিয়ে যায়। তাদের মধ্যে ৭০-এর বেশি বন্দি এখনও পলাতক। তাদের মধ্যে ৬৯ জন আছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। বাকি বন্দিদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।

জাগো নিউজ: কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন?

কারা মহাপরিদর্শক: যোগদানের পর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মেসেজ দেওয়া হয় ‘নতুন বাংলাদেশে অতীতে আর ফিরে যাবো না।’ পরিশুদ্ধ, স্বচ্ছ এবং একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কারাগারকে দাঁড়াতে হবে। কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি-অনিয়ম অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছিল এবং এখনও আছে দুর্নীতি। এ কারণে কাজ করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে। কঠোর হতে হচ্ছে, জিরো টলারেন্স বলছি। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানে যখন অনেক রকম সমস্যা থাকে তখন একসঙ্গে পরিশুদ্ধ করা যায় না। ধাপে ধাপে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করছি। এখনও যেসব কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত তাদের জন্য কঠোর অবস্থা। এমন অনেককে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমি কিছু কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি।

জাগো নিউজ: কারাগারে সন্ত্রাসীরা একসঙ্গে থাকায় সেখানে মিটিং করে জামিনে বেরিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে। সমাধান কীভাবে?

কারা মহাপরিদর্শক: ধারণক্ষমতার চেয়ে যেহেতু বেশি বন্দি থাকে সেহেতু কারাগারের ধারণক্ষমতা বাড়াতেই হবে। পুরাতন কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতা কম, সেগুলো সম্প্রসারণের কাজ চলছে। আসামি ভেদে বন্দিদের যদি পৃথক না করা যায় তবে সমাজের জন্য হুমকি থেকেই যায়। ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী তরুণ বন্দিদের পৃথক কারাগারে স্থানান্তরের পরিকল্পনা চলছে। যাতে দাগি আসামিদের সংস্পর্শে অন্য কেউ না আসে। মাদকাসক্ত বন্দিদের জন্য বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। মাদকাসক্ত বন্দিদের জন্যেও পৃথক কারাগারে নেওয়ার প্রস্তাবনা রয়েছে।

জাগো নিউজ: কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি সংক্রান্ত অসন্তোষ ছিল। কতটা সমাধান হয়েছে?

কারা মহাপরিদর্শক: আমি যোগদানের পর ডিপার্টমেন্টকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। সৎ, যোগ্য ও মেধার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পোস্টগুলোতে পদায়ন করা হয়েছে। কেউ বলতে পারবে না কোনো অসৎভাবে কেউ বদলি হয়েছে। (চলবে...)

আগামীকাল থাকছে সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব: আদালতে হাজিরা শেষে কারাগারে মাদক আনছেন বন্দিরা

টিটি/এমএমএআর/জেআইএম

Read Entire Article