কী নেই নাসির স্যারের বাগানে, শুক্রবার হলেই ছুটে আসে শিশুরা

2 hours ago 5

গড়াই নদীর কূলঘেঁষে সরু পাকা সড়ক। এরই পাশে দৃষ্টিনন্দন বাগান। গাছের নিচে বিছানো ত্রিপলে রং-তুলি ও কাগজ নিয়ে বসেছে শতাধিক শিশু। তারা আঁকছে হেমন্তকালের নদীতে নৌকা, আকাশে ভাসা মেঘ, কাশফুল, বন, পাখি, প্রকৃতি জীবনের চিত্র।

বাগানে আছে দোলনা, পাঠাগার, জাদুঘর, শরীরচর্চার সামগ্রী ও বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির গাছ। কোনো কোনো শিশু খেলা করছে, কেউবা বই পড়ছে।

শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে নাসির উদ্দিনের বাড়ির বাগানে এমন দৃশ্য দেখা গেলো। যেন শিশুদের মিলন মেলা বসেছে।

কী নেই নাসির স্যারের বাগানে, শুক্রবার হলেই ছুটে আসে শিশুরা

সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী নাফিজা বলে, ‌‘এখানে সব ঋতুতেই উৎসব হয়। ছবি আঁকতে আসি। খুব ভালো লাগে। এবার হেমন্তকালের নদীতে নৌকা, আকাশে মেঘ ভাসা, কাশফুল, বনের ছবি এঁকেছি।’

উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে এই কয়া গ্রাম। একপাশে গড়াই এবং অপরপাশে পদ্মা নদী। এই গ্রামেই প্রাচীন নিদর্শন ও গ্রামীণ জীবনের নানা উপকরণ সংরক্ষণ করেন ৭৫ বছর বয়সী নাসির উদ্দিন। শুক্রবার এলেই শিশুনিকেতনে পরিণত হয় তার বাড়ির বাগান।

৩৩ শতাংশ জমির ওপর বাগানসহ নাসির উদ্দিনের বসতভিটা। রয়েছে বিনোদন ও শরীরচর্চা কেন্দ্র, পাঠাগার, জাদুঘর, সংবাদ সংগ্রহশালা। আশপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী শিশুরা আসে এখানে। তারা বই পড়ে, খেলা করে, বিলুপ্তপ্রায় হরেক প্রজাতির গাছের সঙ্গে পরিচিত হয়। জাদুঘরে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী তৈজসপত্র দেখে চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের স্পর্শ অনুভব করে। নাসির উদ্দিন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েদের তার বাগানে আসতে বলেন। বই পড়তে উৎসাহিত করেন। পাঠাগার গড়ে তুলতে স্থানীয় শিক্ষিত মানুষকে উৎসাহ দেন তিনি।

কী নেই নাসির স্যারের বাগানে, শুক্রবার হলেই ছুটে আসে শিশুরা

পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন নাসির উদ্দিন। ২০০৫ সালে পেনশনের টাকায় শিশুদের বিনোদন ও মেধা বিকাশের জন্য বাড়ির আঙিনায় বাবা-মায়ের নামে গড়ে তোলেন ‘কুলছুম নেছা-জালাল গান্ধী শিশুপার্ক’। ৫০ বছর ধরে বিলুপ্তপ্রায় গাছ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। বাগানে প্রায় ২০০ প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী গাছ আছে তার বাগানে। প্রতিটি গাছে কাগজের ওপর লেমিনেটিং করে নাম লেখা আছে, যাতে শিশুরা পড়ে চিনতে পারে।

বাগানে আছে বনকাঁঠাল, লাটা, ঢেপড়, ফলশাহী, মিষ্টি আমলকি, করমচা, জামরুল, হরগৌড়ি ইত্যাদি গাছ। নাসির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, বিলুপ্তপ্রায় ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনের গাছ সংরক্ষণে তিনি চেষ্টা করছেন। বাগানে বেশিরভাগই ঔষধি গাছ। যার যখন খুশি প্রয়োজন মতো নিয়ে যাচ্ছেন।

বাগানের মাঝখানে একটি ছোট্ট আধাপাকা ঘরে মায়ের নামে একটি পাঠাগার, জাদুঘর। পাশেই সম্প্রতি সরকারি উদ্যোগে আধাপাকা ঘর করা হয়েছে। সেখানে সংবাদ সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন তিনি। পাঠাগারে শিশুদের মেধা বিকাশ, শরীর গঠনবিষয়ক বইসহ পাঁচ শতাধিক বই আছে।

কী নেই নাসির স্যারের বাগানে, শুক্রবার হলেই ছুটে আসে শিশুরা

জাদুঘরে সেন ও পাল বংশ এবং ব্রিটিশ আমলের ইট, থালা, পানের বাটা, বিলুপ্তপ্রায় হারিকেন, ঢেঁকি, পালকি, ডাক টিকিট, ছক্কা, নাঙল, মাথাল, ঢালসহ রয়েছে শতাধিক উপকরণ। সংবাদ সংগ্রহশালায় শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি ও নানা বয়সী শিশুদের লেখা এবং দেশ-বিদেশের আবিষ্কারক বিষয়ক পত্রিকা ও পত্রিকার কাটিং রাখা হয়েছে।

নাসির উদ্দিন জানান, তার নানি ও মায়ের ব্যবহৃত পানের বাটা, পান ছেঁচনি ও চিনামাটির পুতুল দেখে তিনি জাদুঘর স্থাপনে উদ্বুদ্ধ হন। এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক উপকরণ এনে সংরক্ষণ করেছেন। এগুলো থেকে শিশুরা প্রাচীনকাল সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে।

শিশুদের মনের যে খোরাক, তা নাসির স্যারের এখান থেকে পূরণ হচ্ছে জানিয়ে কয়া মণ্ডলপাড়ার গৃহিণী রওশন আরা বলেন, ‘হেমন্ত ঋতুর বরণ উপলক্ষে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় মেয়েকে নিয়ে এসেছি। এখানে পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসবসহ নানা পার্বণে নাসির স্যার শিশু-কিশোরদের নিয়ে আনন্দ আয়োজন করেন। এছাড়া গাছে ফল পাকলে শিশুদের নিয়ে উৎসব হয় বাগানে। আনন্দ করে ফল খায় শিশুরা।’

কয়া ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী আছিয়া খাতুন বলে, ‘নাসির স্যার বয়স্ক হলেও তার আচরণ শিশুর মতো। গাছ, পাখি ও বই যাদের ভালো লাগে, তারা ছুটে আসে বাগানে। অনেক শেখার আছে এখানে।’

কী নেই নাসির স্যারের বাগানে, শুক্রবার হলেই ছুটে আসে শিশুরা

দুই শিশু নিয়ে বাগানে এসেছিলেন কয়া গ্রামের আকাশ আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নাসির স্যার একজন সাদামনের মানুষ। শিশুদের জন্য তার এমন আয়োজন প্রশংসনীয়। ’

নাসির উদ্দিনের মতো আলোকিত মানুষ দেশের কল্যাণে অনেক অবদান রাখেন বলে মনে করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম।

তিনি জানান, গতবছর তিন লাখ টাকা সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভবিষ্যতে আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এসআর/এএসএম

Read Entire Article