কীটনাশক ঝুঁকি হ্রাসে সচেতনতা জরুরি

3 weeks ago 9

কৃষি উৎপাদনে কীটপতঙ্গ, রোগ-জীবাণু, আগাছা ও ইঁদুরসহ নানা রকম ক্ষতিকর জীব বা উপদ্রবকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব রাসায়নিক, জৈবিক বা প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, তাকে কীটনাশক বা বালাইনাশক বলা হয়। কৃষিক্ষেত্রে ফসলের উৎপাদন ও গুণগত মান ধরে রাখতে এগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উৎপত্তি ও ব্যবহার

প্রাচীনকাল থেকেই কৃষকেরা ছাই, নিমপাতা, বিভিন্ন ভেষজ পদার্থ ও জৈব উপাদান ব্যবহার করে পোকামাকড় দমন করতেন। শিল্পবিপ্লবের পর রাসায়নিক কীটনাশকের আবির্ভাব ঘটে এবং বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।

গুরুত্ব

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। রোগবালাইয়ের কারণে ফসলের যে ৩০-৪০% ক্ষতি হতে পারতো, তা হ্রাস করে। সংরক্ষণকালে শস্যকে পোকামাকড় ও ছত্রাক থেকে রক্ষা করে।

চ্যালেঞ্জ

অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। উপকারী পোকামাকড় ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাটির উর্বরতা ও পানির গুণমান নষ্ট করতে পারে। এজন্য বর্তমানে টেকসই কৃষিচর্চায় জৈব কীটনাশক, প্রাকৃতিক শত্রু এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা।

কীটনাশক ব্যবহার বা স্প্রে করার পূর্বে সতর্কতা

প্রয়োজন নির্ধারণ করুন: অযথা কীটনাশক ব্যবহার করবেন না। মাঠে কীটের আক্রমণ হয়েছে কি না, ক্ষতির মাত্রা কেমন তা আগে নিশ্চিত হোন।

সঠিক কীটনাশক নির্বাচন করুন: কীটের ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত কীটনাশক বেছে নিন। লেবেল ও নির্দেশিকা ভালোভাবে পড়ে বুঝে নিন।

ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিন: পিপিই যেমন- গ্লাভস, মাস্ক, চশমা, লম্বা হাতা জামা, বুট ব্যবহার করুন। খালি হাতে বা খালি পায়ে কখনো স্প্রে করবেন না।

মিশ্রণের সময় সতর্ক থাকুন: হাওয়া-বাতাস প্রবাহিত হয়, এমন জায়গায় কীটনাশক মেশান। মুখ দিয়ে কীটনাশক টেনে স্প্রেয়ারের পাইপে পানি ঢোকাবেন না।

খাবার থেকে দূরে রাখুন: কীটনাশক মিশ্রণ বা রাখার সময় যেন খাবার, পানীয় বা পশুখাদ্যের সাথে মিশে না যায়। কীটনাশকের বোতল বা পাত্র কখনো খাবারের কাজে ব্যবহার করবেন না।

আবহাওয়া ও সময় নির্বাচন করুন: জোরালো বাতাস, অতিরিক্ত গরম বা বৃষ্টির সময় স্প্রে করবেন না। ভোর বা বিকেলের দিকে স্প্রে করা উত্তম।

অন্যান্য সতর্কতা: শিশু, গবাদিপশু, পোলট্রি বা মাছের ঘের থেকে দূরে কীটনাশক রাখুন। স্প্রের আগে শরীর অসুস্থ থাকলে কীটনাশক ব্যবহার করবেন না।

কীটনাশক ব্যবহারের পর করণীয়

নিজের পরিচ্ছন্নতা: স্প্রে করার পরপরই হাত, মুখ ও শরীর ভালোভাবে সাবান ও পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুতে হবে। ব্যবহৃত কাপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে। স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরতে হবে।

খাবার ও পানীয় সুরক্ষা: স্প্রে করার পরপরই খাবার বা পানি গ্রহণ করা উচিত নয়। অন্তত ১-২ ঘণ্টা পর ভালোভাবে হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেতে হবে।

ক্ষেতে প্রবেশে সতর্কতা: স্প্রে করার অন্তত ২৪ ঘণ্টা পর পর্যন্ত ক্ষেত বা বাগানে প্রবেশ না করাই ভালো। প্রয়োজনে প্রবেশ করলে মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে।

পশু-পাখির সুরক্ষা: স্প্রে করা জমিতে গবাদিপশু ছাড়া যাবে না অন্তত ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত। মাছের ঘেরে বা হাঁস-মুরগির আশপাশে কীটনাশক ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: কীটনাশকের খালি বোতল বা প্যাকেট ফেলে দেওয়া যাবে না মাঠে বা পানির ধারে। মাটির নিচে পুঁতে ফেলা বা স্থানীয় নিয়ম অনুযায়ী নিরাপদে নিষ্পত্তি করতে হবে।

স্বাস্থ্যগত সতর্কতা: মাথা ঘোরা, বমি, শ্বাসকষ্ট বা চোখ জ্বালা করলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। চিকিৎসককে জানাতে হবে কোন কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে।

বালাইনাশকের প্রকারভেদ

১. বীজ শোধক
২. ছত্রাকনাশক
৩. ভাইরাসনাশক
৪. ব্যাকটেরিয়ানাশক
৫. মাকড়নাশক
৬. কীটনাশক
৭. নেমাটোসাইড
৮. জৈব বালাইনাশক
৯. আগাছানাশক
১০. পিজিআর বা হরমোন।

কীটনাশকের প্রকারভেদ

১. পাকস্থলী বিষ
২. স্পর্শ বিষ
৩. ধূম্র বিষ
৪. প্রবাহ বিষ।

কৃষিকাজে বালাইনাশক ব্যবহারের অপেক্ষমান সময়

১. সাইপারমেথ্রিন, আলফা-সাইপার = ৪-৫ দিন
২. মেথ্রিন, ম্যালাথিয়ন, ফেনিট্রোথিয়ন, ফেনথিয়ন, ফেনভেলারেট, ফেনথোয়েট = ৭-১০ দিন
৩. ডায়াজিনন, কুইনালফস, ক্লোরপাইরিফস, ইমিডাক্লোপ্রিড, থায়ামেথোক্সাম = ১০-১৫ দিন
৪. এসিফেট, কার্বারিল, কারটাপ, ফিপ্রোনিল = ১৫-২০ দিন
৫. কার্বোফুরান = ২০-২৫ দিন।

কীটনাশক ব্যবহার আধুনিক কৃষিতে অপরিহার্য হলেও অপব্যবহার ও অসচেতন প্রয়োগ মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। তাই কৃষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক মাত্রায় ও সঠিক সময়ে কীটনাশক প্রয়োগ, নিরাপদ সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার, বিকল্প পদ্ধতি যেমন- জৈব কীটনাশক বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব।

সর্বোপরি প্রশিক্ষণ, গণসচেতনতা ও সরকারি নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করলে কীটনাশক ঝুঁকি হ্রাসের পাশাপাশি টেকসই কৃষি ও সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

এসইউ/জিকেএস

Read Entire Article