# প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া
# নগরজুড়ে ছিনতাই আতঙ্ক
# ৭ মাসে গ্যাং লিডারসহ গ্রেপ্তার দুই শতাধিক
# ৮ বছরে ১২ হত্যাকাণ্ড
কুমিল্লা নগরীতে হঠাৎ বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। দিন-দুপুরে অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে তারা। প্রশাসনের নীরবতার সুযোগ বুঝে তারা মাথাচাড়া দিয়ে মহড়ার মাধ্যমে গ্রুপের নিজেদের শক্তি জানান দেন। এতে করে নগরজুড়ে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। তাদের কর্মকাণ্ডে পুলিশ প্রশাসন সক্রিয় হলে গা ঢাকা দেন কিশোর অপরাধীরা। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তারা সক্রিয়। আধিপত্য ধরে রাখতে তুচ্ছ ঘটনায় সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন এসব কিশোর অপরাধীরা।
গত ৮ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। নগরীতে বিভিন্ন নামে অন্তত ২০টি গ্রুপ রয়েছে। গ্যাংলিডারদের নির্দেশে তারা মাদক কারবার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে হরহামেশা। অপরাধীদের গ্রেফতারের পর আইনের ফাঁকফোকরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফের জড়িয়ে পড়েন অপরাধের সঙ্গে। গত কয়েকদিন নগরীতে উদ্বেগজনক হারে চুরি-ছিনতাই বেড়েই চলছে।
গত ২২ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নগরীর ধর্ম সাগর পাড় থেকে সিডি এক্স গ্রুপের গ্যাং লিডার ইফতি এবং রানীর দিঘীর পাড় থেকে আরডি এক্স গ্রুপ লিডার সাইমুনের নেতৃত্বে দুটি গ্রুপ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে নগরীতে মহড়া দেয়। খবর পেয়ে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ২৭ জন কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে সুইচ গিয়ার, ছোরা চাকু ও লোহার রডসহ বিভিন্ন অস্ত্র জব্দ করা হয়।
শনিবার (২৩ আগস্ট) বিকেল ৩টায় এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত তাদের কুমিল্লা আদালতের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গত ১ আগস্ট বিকেলে কিশোর গ্যাংয়ের একটি গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার মোস্তফাপুর এলাকায় হোটেল জাইতুন থেকে এক্সট্রিম রাইড নামে একটি গ্রুপ সহস্রাধিক মোটর সাইকেল নিয়ে মহাসড়ক দখল করে মহড়া দেন। এতে কুমিল্লা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওইদিন হোন্ডা মহড়ায় যোগ দিতে যাওয়া সময় মহানগরীর অশক তলা থেকে ৫ জনকে চাকুসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আরও পড়ুন
প্রকাশ্যে ৩০০ কিশোরের অস্ত্রের মহড়া, আতঙ্কে নগরবাসী
অস্ত্র নিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ২ গ্রুপের মহড়া, গ্রেফতার ২৭
কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার ১৬, অস্ত্র উদ্ধার
একই দিন (১ আগস্ট) ভোর সাড়ে ৫টায় নগরীর রানির দিঘী এলাকা থেকে রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাখাওয়াত হোসেন সজিবের কাছ থেকে আইফোন, হাত গড়ি ও মানিব্যাগে থাকা আড়াই হাজার টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
গত ২ আগস্ট ভোরে তারা লাকসাম সড়কের সালাউদ্দিন মোড়ে পৌঁছালে সিএনজি চালিত অটোরিকশাযোগে আসা পাঁচজনের একটি ছিনতাইকারী দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ ১৭ হাজার টাকা, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নেয়।
গত ৪ আগস্ট শাসনগাছা এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে চান্দিনা উপজেলা বাসিন্দা ইব্রাহীম। তার কাছ থেকেও মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পর ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় তারা। একদিন সকালে বসন্তপুর স্বতন্ত্র মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান টমছম ব্রিজ এলাকায় ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। এ সময় তার হাতব্যাগ ছিনিয়ে নিতে বাঁধা দিলে তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে তিনি কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেন।
গত ৭ আগস্ট ভোর ৬টার দিকে নগরীর টমছম ব্রিজ সংলগ্ন কাসেমুল উলুম মাদরাসার পাশে এক শিক্ষক ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন। তার কাছ থেকে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।
২৫ এপ্রিল বিকেলে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অস্ত্র নিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের তিনটি গ্রুপের প্রায় ৩ শতাধিক সদস্য মহড়া দেয়। এরপর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ ৯২ জনকে গ্রেফতার করে। কিশোর অপরাধ দমনে ওই মাসেই কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এর আগে ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর নগরীর পুলিশ লাইন এলাকায় থেকে ৪ কিশোর গ্যাং সদস্যকে অস্ত্রসহ আটক করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। পরে এ ঘটনাও পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় ৪৬ জন কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। দুই মামলায় গত ৭ মাসে একাধিক গ্রুপ লিডারসহ ১৪৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বিভিন্ন সূত্র মতে, ২০১৫ সালে কুমিল্লা নগরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। ‘র স্কোয়াড’(রতন গ্রুপ), সিবিক, আইএনজি, এলেক্স গ্রুপ, ঈগল, র্যাক্স, এলআরএন, কেডিজি, মডার্ন, রকস্টার, ডিস্কো বয়েজসহ বিভিন্ন নামে অন্তত ১৫-২০টি গ্রুপ রয়েছে।
২০১৭ সালের পর থেকে গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের হাতে কুমিল্লা নগরীতে অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে নগরের অশোক তলা এলাকায় সজীব হোসেন ওরফে বাবু (২২) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে ছুরিকাঘাতের পরদিন সকালে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। পুলিশ বলছে, ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের মাদক কারবার। নিহত সজীব জেলার দেবীদ্বার উপজেলার সুলতান পুর গ্রামের মফিজুল ইসলামের ছেলে। তারা অশোকতলা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।
একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি নগরীর সবচেয়ে আলোচিত কিশোর গ্যাংয়ের দুটি পক্ষ ‘ঈগল গ্রুপ’ ও ‘রতন গ্রুপ’ সদস্যদের মধ্যে সশস্ত্র মহড়া ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় উভয় পক্ষের সদস্যরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ঘটনায় দুই পক্ষের ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েক মাস চুপচাপ থেকে দুটি গ্যাং আবার বেপরোয়া হয়ে পড়ে। একই বছর ২৪ মে নগরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৩৯ কিশোর গ্যাং সদস্যকে আটক করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। পরে রাতে অভিভাবকদের মুচলেকায় ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।
১১ অক্টোবর ৬টি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা তানজিম আবদুল্লাহকে (২০) দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, তানজিম সিবিকে (কুমিল্লা ব্রাদার্স কমিউনিটি), সিবিকে ডেঞ্জার জোন, সিবিকে জুনিয়র, সিবিকে স্পেশালসহ ছয়টি গ্যাং গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল আবদুল্লাহ।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে নগরের দক্ষিণ চর্থা বড়পুকুর পাড় এলাকায় ‘থার্টি ফার্স্ট নাইটের পার্টি’ থেকে ডেকে নিয়ে ফয়সাল ইসলাম (১৯) নামের এক তরুণের হাত-পায়ের রগ কেটে এবং কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই বছরের ১৯ আগস্ট নগর উদ্যানের সামনে শাহাদাত হোসেন নামে (১৫) এক কিশোরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল কুমিল্লা ইপিজেডের একটি চীনা কোম্পানির কর্মকর্তা খায়রুল বাশারকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইপিজেডের সামনে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনাটিও কিশোর গ্যাং ঘটায় বলে জানিয়েছে র্যাব-১১। একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি নগরের ঠাকুর পাড়া এলাকার মোহাম্মদ আমিন (১৫) নামের এক কিশোরকে পিঠে ও ছুরিকাঘাত করে খুন করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।
ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে তাদের গ্রুপ রয়েছে। ওই গ্রুপের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করে তারা বিভিন্ন অপরাধের পরিকল্পনা করেন সেখানে। গত তিন মাস এসব গ্যাং সদস্যরা গা ঢাকা দিলেও পুনরায় তারা সুসংগঠিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
নাঈমুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি জানান, ১৭ জুলাই রাত ১১টার দিকে রানীর দিঘীরপাড় এলাকায় ৫-৬ জনের একদল কিশোর অস্ত্র ঠেকিয়ে আমার কাছে থাকা নগদ এক লাখ টাকা ও একটি মোবাইল সেট ছিনতাই করে নিয়ে যায়। তার ধারণা এরা সবাই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
নাম প্রকাশ নাকরার শর্তে ঈগল গ্রুপের এক সদস্য জানান, বেশ কিছুদিন তারা আত্মগোপনে থাকলেও বর্তমানে নিয়মিত রানির কুটির, নগর উদ্যোন ও কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে মিলিত হচ্ছেন। সহপাঠীদের জন্মদিনের নামে কেক কেটা এবং বিভিন্ন দিবসে ছোট ছোট আয়োজনে সক্রিয় করা হচ্ছে গ্রুপ সদস্যদের। সন্ধ্যার পর রানির কুটিরের সামনে বসানো হয় মাদকের আড্ডা।
রতন গ্রুপের এক সদস্য জানান, নগরীর সব চেয়ে বড় গ্রুপ তাদের। বর্তমানে প্রকাশ্যে মহড়া দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই। তবে হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপে সদস্যরা সক্রিয় রয়েছেন। একইভাবে সিবিকে গ্রুপ সদস্যরাও আত্মগোপনে চলে গেছে। তবে বিসিক শিল্পনগরীর জলারমাঠ নিয়মিত মিলিত হচ্ছেন তারা। সেখানে চলে মাদক বেচা-কেনা ও গ্রহণ।
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লাটিপু বলেন, কুমিল্লায় কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করেছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতারা। বর্তমানে তারা আত্মগোপনে থেকেও এদের নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ থাকবে এদের শক্ত হাতে দমন করা এবং গ্রেফতারের পর যেন দ্রুত জেল থেকে ছাড়া না পায়, সেই ব্যবস্থা করা। বর্তমানে কোন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি যদি এদের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে তাদেরও আইনের আওতায় আনার অনুরোধ জানান তিনি।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি আলমগীর খাঁন বলেন, কিশোর গ্যাং মহড়া দিলে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী সক্রিয় হয়। কিছুদিন যাওয়ার পর তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। অনুরোধ থাকবে নোট ডাউন করে নিয়মিত যেন কিশোর অপরাধীদের দমনে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রাখে এবং তাদের অধীনে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সাহসী অভিযান চালানো হয়। এতে করে কিছুটা হলেও নগরবাসীর মনে স্বস্তি ফিরবে।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম বলেন, কুমিল্লা পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় কিশোর গ্যাং দমনে পুলিশ তৎপর রয়েছে। গত সাত মাসে অস্ত্র ও গুলিসহ প্রায় ২ শতাধিক কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। বন্ধের দিনগুলোতে পুলিশের মহড়া অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ২২ আগস্ট ২৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
জাহিদ পাটোয়ারী/আরএইচ/জেআইএম