কুমিল্লায় ফের বাড়ছে স্ক্যাবিসের সংক্রমণ
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় ফের বৃদ্ধি পাচ্ছে অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ স্ক্যাবিসের সংক্রমণ। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন এ রোগে। গত বছরের বন্যা পরবর্তী সময়ে শুরু হওয়া রোগটি কিছু মাস আগে অনেকটা কমে এলেও আবারও বাড়তে থাকায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে বাড়ছে স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
এ নিয়ে চিকিৎসকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তবে আবারও সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে রোগীদের সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি ও বহির্বিভাগ এবং উপজেলার বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্র ঘুরে চিকিৎসক ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, গত বছরের ভয়াবহ বন্যা শেষে এ উপজেলায় ছোঁয়াচে রোগ স্ক্যাবিসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। পরে রোগটি নীরব মহামারিতে রূপ নেয়। এতে আক্রান্ত হয়েছিল শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ। তবে কয়েক মাস তাণ্ডব চালানো শেষে স্ক্যাবিসের সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু বছর ঘুরতেই পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার অভাবে আবারও রোগটির সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে দেখে চিকিৎসকসহ জনমনে এ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চিকিৎসকরা জানান, স্ক্যাবিস একটি সারকোপ্টেস স্ক্যাবেই নামক পরজীবী মাইট (অণুবীক্ষণিক পোকা) দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রামক চর্মরোগ। এটি আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে গেলে, আক্রান্ত রোগীর পোশাক, ব্যবহৃত গামছা, তোয়ালে ও আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত বালিশ, বিছানা ব্যবহার বা স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। যার ফলে আক্রান্ত রোগী থেকে সচেতনতার অভাবে পরবর্তীতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও আক্রান্ত হয়। যে কারণে এ রোগটি দ্রুত সংক্রমিত হয়। এ জন্য এ রোগ নির্মূলে শুধু চিকিৎসা নয়, এ রোগ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সচেতনতা খুব বেশি জরুরি।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. অরূপ সিংহ কালবেলাকে বলেন, স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় পারমেথ্রিন লোশন ও ক্রিম দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও তীব্র চুলকানি থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। পাশাপাশি এটি যেন পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য রোগীকে অন্যদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। রোগীর ব্যবহৃত পোশাক, বিছানাপত্র পরম পানিতে ফুটিয়ে এবং সাবান দিয়ে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নিতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ রোগে আক্রান্ত শিশু নুসাইবাকে (৪) নিয়ে এসেছেন স্বজনরা। তার হাতের ও পায়ের আঙুলে পুঁজযুক্ত ছোট ছোট গোটা। শিশু নুসাইবার মা আইরিন আক্তার বলেন, এসব গোটায় তীব্র চুলকানি ও ব্যথা হয়। যখন গোটাগুলো চুলকায় ও ব্যথা করে তখন আমার মেয়েটা কান্না করে। এর আগেও তার এই সমস্যা হয়েছিল। চিকিৎসা নেওয়ার পর ভালো হয়ে ছিল। গত এক সপ্তাহে আগে আবারও এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই হাসপাতালে এসেছি চিকিৎসা নিতে।
দেড়বছর বয়সী শিশু মুনতাহাকে উপজেলার নাল্লা এলাকা থেকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে নিয়ে এসেছেন স্বজনরা। শিশু মুনতাহার হাত ও পায়ে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট র্যাশ দেখা দিয়েছে।
চিকিৎসক বলেছেন, শিশু মুনতাহা স্ক্যাবিস আক্রান্ত। এ রোগ থেকে আরোগ্য পেতে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
মুনতাহার মা জেসমিন আক্তার বলেন, গত বছর আমাদের পরিবারের সকলের চুলকানি রোগ হয়েছিল। অনেকদিন ভালো ছিলাম, তবে এখন আবার সবার এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন আমার ছোট মেয়েটারও এ রোগ দেখা দিয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. শঙ্খজিৎ সমাজপতি কালবেলাকে বলেন, গত বছর বন্যা-পরবর্তী সময়ে এ উপজেলায় চর্মরোগ চরম আকার ধারণ করেছিল। এসব চর্ম রোগের মধ্যে স্ক্যাবিস ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। তবে গেল কয়েকমাস এ রোগটি অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই আবারও এ রোগটি বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এ রোগ নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ও পরামর্শ দিচ্ছি। তবে অধিকাংশ রোগীই অসম্পূর্ণ চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ মানছেন না। যার ফলে সাময়িকভাবে কিছুটা কমলেও এ রোগটি পুরোপুরিভাবে নির্মূল হচ্ছে না।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শেখ হাসিবুর রেজা কালবেলাকে বলেন, স্ক্যাবিস পরজীবী জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত এক ধরনের চর্মরোগ। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ রোগে সঠিক চিকিৎসা ও এ রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এ রোগ দীর্ঘদিন শরীরে থাকলে রোগীর কিডনি জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এ রোগ নিয়ে অবহেলা করার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, গত বছরের বন্যার পর থেকে এ রোগটি এ উপজেলায় দেখা দেয়। এ নিয়ে আমরা স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসহ এ রোগ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিলাম। মাঝখানে কয়েকমাস এ রোগটির প্রাদুর্ভাব অনেকটা কমে এসেছিল। তবে রোগী ও রোগীর স্বজনদের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতার অভাবে এ রোগটি আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এ রোগ নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের চিকিৎসাপত্রের সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও রোগ প্রতিরোধে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও এ রোগটি যেন মহামারি আকার ধারণ না করে সেজন্য এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে এ রোগ পুরোপুরিভাবে নির্মূলে চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।