আল্লাহ মানুষকে সম্পদ দেন আল্লাহর কাজে এবং মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য। তবে কিছু মানুষ লোভ ও কৃপণতার কারণে সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখে। এমন একজন কৃপণ লোক ছিল হজরত মুসা (আ.)-এর যুগের কারুন। তার করুণ পরিণতির ঘটনা পবিত্র কোরআনে বিবৃত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তাকে (কারুন) ও তার প্রাসাদকে মাটিতে ধসিয়ে দিলাম। তার সপক্ষে এমন কোনো দল ছিল না যে, আল্লাহর শাস্তি থেকে তাকে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না।’ (সুরা কাসাস: ৮১)। এ আয়াতের পূর্বাপর কয়েকটি আয়াত মিশরের কারুন সম্পর্কিত। আল্লাহর আজাবে সে সহায়-সম্পদসহ ধ্বংস হয়েছিল।
কারুন ছিল মুসার (আ.)-এর চাচাতো ভাই। মুসা (আ.) বনি ইসরাইলের এক অঞ্চলের নেতৃত্ব দিতেন এবং কারুন অন্য অঞ্চলের নেতৃত্ব দিত। কারুনের জাগতিক প্রজ্ঞা ছিল সুবিদিত। পবিত্র কোরআনের সুরা কাসাসে তাকে যে ‘ইলম’ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা অর্থনৈতিক কলাকৌশল তথা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি অর্থ হতে পারে। কারুন নবী ইউসুফ (আ.)-এর একটি বিরাট ভূগর্ভস্থ ধনভান্ডার লাভ করেছিল।
কারুনের সম্পদের পরিমাণ ছিল অঢেল। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘কারুন ছিল মুসার সম্প্রদায়ভুক্ত; কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল। আমি তাকে দান করেছিলাম এমন ধনভান্ডার, যার চাবিগুলো বহন করা একদল বলবান লোকের পক্ষেও কষ্টসাধ্য ছিল।’ (সুরা কাসাস: ৭৬)। কোরআনে ‘কারুন ও তার নিবাস’ বলতে কারুনের বসতভূমি ও শাসিত অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই স্থান কোথায়, যেখানে আল্লাহ কারুনকে তার সম্পদসহ মাটিতে ধসিয়ে দিয়েছিলেন? কোনো কোনো তাফসিরকার ঘটনাটি মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মিশর ত্যাগের পরবর্তী ‘তিহ’ এলাকায় সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ ঘটনাটি ইরাকের নিনওয়া অঞ্চলে ঘটে থাকবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে কারুন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বর্ণনা সামনে রাখলে মুসার (আ.) সঙ্গে তার মিশর ত্যাগের প্রশ্নই আসে না।
কারুন একসময় বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। কারুন বনি ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও ফেরাউনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল এবং তাদের একজনে পরিণত হয়েছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মুসাকে আমার নিদর্শনগুলো এবং সুস্পষ্ট যুক্তি সহকারে ফেরাউন, হামান ও কারুনের কাছে পাঠালাম। কিন্তু তারা বলল, এ একজন জাদুকর, ডাহা মিথ্যুক।’ (সুরা মুমিন: ২৩-২৪)। এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, কারুন নিজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং বনি ইসরাইলকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। আর এ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার বদৌলতে ফেরাউনের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সে এমন গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিল।
কারুন হ্রদ: মিশরের ফায়ুম শহরে ‘বুহাইরা কারুন’ তথা ‘কারুন হ্রদ’ নামে একটি স্থান রয়েছে। রাজধানী কায়রো থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখন এটি ‘বিরকেত কারুন’ নামে টিকে আছে। যার আয়তন প্রায় ২০২ বর্গকিলোমিটার বা ৭৮ বর্গমাইল। জনশ্রুতি আছে, মুসা (আ.)-এর চাচাতো ভাই কারুনের নামানুসারে এ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদিন কারুন একজন ব্যভিচারী নারীকে এ শর্তে কিছু অর্থ দিল যে, সে জনতার সামনে প্রকাশ্যে বলবে, হে মুসা, তুমি আমার সঙ্গে ব্যভিচার করেছ! মুসা (আ.) আঁতকে উঠলেন এবং ওই নারীকে ডেকে পাঠালেন। ওই নারী ঘটনা অস্বীকার করে এবং কারুন তাকে অর্থের বিনিময়ে এরূপ মিথ্যা অপবাদে প্ররোচিত করেছে—এ কথা জানিয়ে দেয়। তখন মুসা (আ.) সেজদায় পড়ে কান্না করতে লাগলেন। আল্লাহ মুসার (আ.) কাছে এ মর্মে ওহি প্রেরণ করলেন যে, ভূমিকে নির্দেশ মান্য করতে বলা হয়েছে। মুসা (আ.) বলেন, ‘হে ভূমি, তাকে গ্রাস কোরো।’ এতে তার হাঁটু পর্যন্ত ধসে গেল। তিনি আবার বলেন, হে ভূমি, তাকে গ্রাস কোরো!’ এতে তার কোমর পর্যন্ত প্রোথিত হয়ে গেল। এবার আবার বলেন, হে ভূমি, তাকে ধরো। তাতে তার বুক পর্যন্ত দেবে গেল। সে বাঁচার জন্য সাহায্য কামনা করল। মুসা (আ.) বলেন, হে ভূমি, তাকে ধরো। তারপর সে সম্পূর্ণ তলিয়ে গেল। (তাফসিরে তাবারি)।
মিশরের আল-ফায়ুম শহরে কারুন লেকের পাড়ে ‘কাসরু কারুন’ নামে প্রসিদ্ধ একটি বিধ্বস্তপ্রায় তলিয়ে যাওয়া প্রাসাদ আছে, যা দেখে একজন পরিব্রাজকের হৃদয়ে আল্লাহর ওই বাণী গুঞ্জরিত হয়—কত জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি যার অধিবাসীরা নিজেদের ভোগ-সম্পদের জন্য গর্বিত ছিল। এগুলোই তো তাদের আবাস-নিবাস। তাদের পর এগুলোতে লোকজন সামান্যই বসবাস করেছে। আর আমিই চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী! বাস্তবেই সামান্যসংখ্যক বাসগৃহ ছাড়া এসব ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদগুলোর কোনো বাসগৃহ পুনরায় পুরোপুরি আবাদ হয়নি। তারা পেছনে রেখে গিয়েছিল বহু উদ্যান ও প্রস্রবণ; কত শস্যক্ষেত ও সুরম্য প্রাসাদ; কত বিলাস-সামগ্রী, যাতে তারা আনন্দিত ছিল।’ (সুরা দুখান, আয়াত: ২৫-২৭)।
আল-ফাইয়ুমকে নবী ইউসুফ (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত মনে করা হয়। বনি ইসরাইলের কাছে দাওয়াতি কাজে নবী মুসা (আ.) এখানে এসেছেন। কোরআন ও সিরাতের প্রখ্যাত ভাষ্যকার আবুল কাসিম আস-সুহাইলি লিখেছেন, ওই আয়াতের সুরম্য প্রাসাদ মিশরের ফাইয়ুম নগরীর প্রাসাদ। (আত-তারিফ ওয়াল ইলাম, পৃষ্ঠা ১২৬)।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক