কৃষিজমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে

3 hours ago 2

বাংলাদেশে আগে প্রতি হেক্টর জমিতে সাড়ে আট কেজি কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার (রাসায়নিক সার) ব্যবহার করা হতো, যা বর্তমানে ৭০০ কেজিতে পৌঁছেছে। এটি একটি ভয়াবহ অবস্থা বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

এসময় তিনি কয়েকটি পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ২০০৫ সালে ১২ হাজার টন কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল। ২০২০ সালে তা ২৭ হাজার টনে উন্নীত হয়। অর্থাৎ আমরা দ্বিগুণের বেশি কীটনাশক আমদানি করছি। এসব কীটনাশক আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে।

বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ‘কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএআরএফ)।

পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে প্রতি হেক্টর জমিতে যেখানে ৯৮ টাকার কীটনাশক লাগার কথা, বর্তমানে তা লাগছে ৮৮২ টাকার। এর সবকিছু খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি করছে। তাই শুধু খাদ্য ফলালাম, এটা করলে হবে না- বরং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা হাইব্রিড যুগে পৌঁছে গেছি। খাদ্য বলেন আর যাকিছু বলেন, আমাদের সবকিছু বেশি করে উৎপাদন করতে হবে। রাষ্ট্রও অধিক পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে পুশ করছে (জোর দিচ্ছে)। আমাদের অধিক খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনেও মনোযোগ দিতে হবে।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কৃষিকে পানি থেকে বা পানিকে কৃষি থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। বরং একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি দেশের মানুষের প্রধান চাহিদাই হচ্ছে খাদ্য। করোনায় মানুষ বা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী স্থান থেকে অস্থিরতা শুরু হলো ধান কাটবে কে, শ্রমিক কোথায় পাওয়া যাবে। এখন যেহেতু সংবিধান সংস্কার কমিশন কাজ করছে, তাদের কাছে এ দাবি তুলতে হবে- খাদ্যের অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার।

তিনি বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষা আইনসহ বেশকিছু নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এগুলো চূড়ান্ত হলে আমরা আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারবো।

বিএআরএফ সভাপতি রফিকুল ইসলাম সবুজের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কাওসার আজমের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্যাহ মিয়ান। প্রধান আলোচক ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কৃষিবিদ ড. আলী আফজাল। বক্তব্য রাখেন কৃষিবিদ খন্দকার রাশেদ ইকবাল, শেখ ফজলুল হক মনি প্রমুখ।

কৃষি সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় জলবায়ু সহিষ্ণু জাত যেমন ব্রি ধান ৫২, বীনা ১১ ধানের জাত উৎপাদন করা হচ্ছে। স্মার্ট প্রযুক্তি, যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এর প্রভাব মোকাবিলা করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরাা খামারি নামের একটি অ্যাপ তৈরি করছি। যেখানে জমির পরিমাণ অনুযায়ী মাটির উর্বরতা বিবেচনায় নিয়ে কোন ফসল ভালো ফলবে, কতটুকু সার লাগবে, কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে এবং সর্বোপরি আবহাওয়া উপযোগী একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে চাষাবাদের ক্ষেত্রে। দ্রুতই এই অ্যাপটির কার্যক্রম শুরু হবে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, একেক দেশে কৃষি উৎপাদনের প্যাটার্ন একেক রকম। উন্নয়নশীল দেশে উৎপাদনে যারা জড়িত তারা নিজের জন্য খাবার রাখেন। আমাদের দেশেও। বাকিটা বিক্রি করেন। অধিকাংশ কৃষক শিক্ষিত নন। কৃষিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। এটা আবহাওয়া ও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে প্রাচীন পদ্ধতিতে তারা চাষাবাদ করেন। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে চান না। তারা সাহস করেন না।

কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। আরও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ কারণে সব অংশীদার মিলে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিক কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্যও ধরে রাখতে হবে। উৎপাদন দুইভাবে বাড়ানো যায়। এক হলো জমি বাড়ানো। আর অন্যটি হলো উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। জমি বাড়ানোর যেহেতু সুযোগ কম, এ কারণে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ড. আলী আফজাল বলেন, বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের যেসব সমস্যায় প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছে তা হলো বনাঞ্চল উজাড়, লবণাক্ততা, পানি দূষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জমির অবক্ষয়, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পয়োনিষ্কাশন ও শিল্পবর্জ্যের পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষিতে ক্রমাগত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এসব চ্যালেঞ্জ দেশের কৃষি, অর্থনীতি এবং জনগণের জীবিকার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যাগুলি আরও গুরুতর হয়ে উঠছে, যা দেশের লাখ লাখ মানুষ এবং দেশের উন্নয়নকে প্রভাবিত করছে।

মূল প্রবন্ধে তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিশ্ব ব্যাংকের ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’এর তথ্য অনুযায়ী সাইক্লোনের প্রভাবে বাংলাদেশকে প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এই রিপোর্টে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশগত ঝুঁকি এবং হঠাৎ বন্যা, সাইক্লোনের মতো ভয়াবহ নানান দুর্যোগের প্রভাবে কৃষি জিডিপির এক তৃতীয়াংশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ১৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ এই ভয়াবহতার প্রভাবে আগামী ৩০ বছরে দেশের মধ্যেই মাইগ্রেট করতে হতে পারে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এই ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশে কমপক্ষে ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন শুধুমাত্র মিড টার্ম পদক্ষেপ বাস্তবায়নে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর তথ্য মতে, দেশের এখনো ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান হয় এই কৃষি খাতে। কিন্তু এই খাতটি যদি এত ভয়াবহতার মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলে দেশের খাদ্য উৎপাদনের অবস্থা এবং এই ৪০ ভাগ মানুষের আয়ের রাস্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এই অবস্থা মোকাবিলায় খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সরকারের দৃশ্যমান বরাদ্দ এবং ব্যবস্থাপনা খুবই অপ্রতুল।

ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন, উচ্চ তাপমাত্রার আবির্ভাব, বন্যা ও আকষ্মিক বন্যার কারণে শস্য বিন্যাসের ওপর প্রতিনিয়ত প্রভাব পড়ছে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার দীর্ঘসূত্রতায় যেখানে তিন ফসল হওয়ার কথা বা চার ফসল হওয়ার কথা সেখানে দুই ফসল বা তিন ফসল হচ্ছে। এছাড়া ফসলে পোকামাকড় ও রোগের প্রাদুর্ভাবের প্রতিনিয়ত ধরন পরিবর্তন হচ্ছে।

এনএইচ/কেএসআর/জিকেএস

Read Entire Article