সারা বিশ্বের কৃষি বিনিয়োগকারীদের জন্য অন্যতম সেরা গন্তব্য হতে পারে ‘পার্ল অব আফ্রিকা’ কিংবা ‘আফ্রিকার মুক্তা’ খ্যাত দেশ উগান্ডা। দেশটির জলবায়ু কৃষির জন্য বিশেষভাবে অনুকূল হওয়ায় ও বিস্তৃতি চাষযোগ্য জমি থাকায় এখানে অর্গানিক চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
উগান্ডার অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ জীবিকার জন্য এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ২৪ শতাংশ, আর মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৩৫ শতাংশই আসে কৃষিপণ্য থেকে। কফি, চা ও অন্যান্য কৃষিপণ্য এর প্রধান রপ্তানি আয় যোগায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক কৃষি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে আফ্রিকার এই সম্ভাবনাময় দেশটি। চলুন জেনে নেওয়া যাক, কেন এই দেশ কৃষি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে...
অনুকূল পরিবেশ
উগান্ডায় বছরে দুইবার বর্ষাকাল আসে- মার্চ থেকে মে ও সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর। এই ধারাবাহিক বৃষ্টিপাতের কারণে এক বছরে একাধিক মৌসুমে ফসল ফলানো সম্ভব হয়। তাছাড়া দেশটির গড় তাপমাত্রা ২৫ থেকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ফসল চাষের জন্য আদর্শ।
নিয়মিত বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা স্থিতিশীল হওয়ায় এখানে কৃষকদের বড় ধরনের সেচব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। দেশটির উর্বর মাটি, বিশেষ করে মাউন্ট এলগন এলাকার আশপাশের অঞ্চল, বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষের জন্য উপযুক্ত। উগান্ডায় জন্মায় প্রধান খাদ্যশস্য যেমন ভুট্টা ও ডাল, আবার নগদ ফসল যেমন কফি ও চা-ও প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়।
প্রধান ফসল ও পণ্য
- কফি: আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম কফি উৎপাদক উগান্ডা। এখানে রোবাস্টা ও অ্যারাবিকা কফি উভয় প্রজাতিই চাষ হয়।
- কলা: কলা উগান্ডার প্রধান খাদ্য। দেশটিতে প্রায় ১০০ প্রজাতির কলা চাষ হয়।
- চা: উগান্ডার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চায়ের চাষ হয়। উর্বর মাটি ও অনুকূল জলবায়ু মানসম্মত চা উৎপাদনে ব্যাপক সহায়তা করে।
- দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্য: বছরে প্রায় ২২০ কোটি লিটার দুধ উৎপাদন করে উগান্ডা। দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশটির দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রতিবেশী দেশগুলোতেও রপ্তানি হয়।
- ভ্যানিলা: উগান্ডায় উৎপাদিত ভ্যানিলা উচ্চ মানসম্পন্ন ও বিশ্বজুড়ে এর চাহিদা রয়েছে। দেশটির কৃষি রপ্তানি খাতে এই পণ্য বেশ ভালো অবদান রাখে।
- মাছ: ‘নাইল তেলাপিয়া’ উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ দেশ উগান্ডা। বর্তমানে দেশটির মৎস্য খাত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ও দেশীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াচ্ছে সরকার
কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে উগান্ডার সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
- ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস (এনএএডিএস): ২০০১ সালে চালু হওয়া এই কর্মসূচি কৃষকদের কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও চাষের কৌশল উন্নত করতে সহায়তা করছে।
- অপারেশন ওয়েলথ ক্রিয়েশন (ওডব্লিউসি): ২০১৩ সালে চালু হওয়া এ প্রকল্পের লক্ষ্য কৃষিকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়া, আয়ের সুযোগ বাড়ানো ও দারিদ্র্য কমানো।
এই উদ্যোগগুলোর ফলে কর ছাড় ও আমদানি-রপ্তানিতে সুবিধা মিলছে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি করছে।
২০২২ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইওয়েরি মুসেভেনি আরব দেশগুলোর বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে স্টেট হাউজ এন্টেবেতে বৈঠক করেন। তিনি বলেন, আমাদের জলবায়ুর কারণে গাছপালা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বিশ্বের অন্যান্য অংশের মানুষ যখন সংগ্রাম করছে, তখন উগান্ডায় যারা কঠোর পরিশ্রম করেন ও প্রচুর খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্য রাখেন, তারাই উন্নতি করছেন।
বাজার সুযোগ ও রপ্তানি চাহিদা
পূর্ব আফ্রিকায় উগান্ডার অবস্থান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারে প্রবেশাধিকার প্রদান করে। দেশটির পূর্ব আফ্রিকান সম্প্রদায় (ইএসি) এবং পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ বাজারের (কমেসা) সদস্যপদ রয়েছে।
পূর্ব আফ্রিকান সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে উগান্ডা, কেনিয়া, তানজানিয়া, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি এবং দক্ষিণ সুদান, যা প্রায় ১৭৪ মিলিয়ন মানুষের বাসস্থান।
অন্যদিকে, কমেসা’র ২১টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে, যা প্রায় ৫৬ কোটি মানুষের একটি বৃহত্তর বাজার। জোটটির লক্ষ্য হলো- প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে আঞ্চলিক অর্থনীতিকে উন্নীত করা।
তাছাড়া উগান্ডা ত্রিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (টিএফটিএ) থেকে উপকৃত হয়। যার মধ্যে ইএসি, কমেসা ও দক্ষিণ আফ্রিকান উন্নয়ন সম্প্রদায় (এসএডিসি) এর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত। এসব জোটের প্রধান লক্ষ্য হলো- এই অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্য বাধা হ্রাস ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা।
আফ্রিকার অফুরন্ত সম্ভাবনা
আলিবাবার সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা আফ্রিকাকে অসীম ব্যবসায়িক সম্ভাবনার জায়গা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, আফ্রিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্যপ্রাণী আর সর্বোপরি মানুষই আসল সম্পদ। হ্যাঁ, সমস্যাও রয়েছে, তবে পৃথিবীর কোথায় সমস্যা নেই? আমি উগান্ডায় অপার সম্ভাবনা দেখেছি।
কৃষি উগান্ডার সংস্কৃতি ও অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। উর্বর জমি, অনুকূল আবহাওয়া, কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান ও সরকারি প্রণোদনা উগান্ডাকে কৃষি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য করে তুলেছে।
উগান্ডার তরুণ প্রজন্মও কৃষিতে ঝুঁকছে। সঠিক বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দেশটি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহে বড় অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
সূত্র: দ্য আফিক্রান ড্রিমস
এসএএইচ