কৃষিতে ৫২ কোটি টাকা অনুদানের ১৩ কোটিই পরামর্শক ব্যয়

10 hours ago 3

বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে বড় আকারে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্রের বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। টেকসই কৃষিখাতের উন্নয়নে ফাউন্ডেশনটি দেবে ৫২ কোটি ২৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকার অনুদান। কৃষিকাজের মতো প্রচলিত কাজে এই টাকার মধ্যে ১৩ কোটিই যাবে পরামর্শকের পকেটে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৫২ কোটি ২৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। চলতি সময় থেকে জানুয়ারি ২০২৮ নাগাদ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে বেশ কিছু খাত সংশোধনের সুপারিশ দিয়েছে কমিশন।

‘টেকনিক্যাল সাপোর্ট টু সাসটেইনেবল অ্যান্ড রেজিলেন্ট ইনভেস্টমেন্ট টুওয়ার্ডস এগ্রিকালচার সেক্টর ট্রান্সফরমেশন প্রোগ্রাম অব বাংলাদেশ’ প্রকল্পটির পুরোটা বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অনুদানে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ সেবা বাবদ মোট ১৩ কোটি টাকার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে সেটি মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ পরামর্শ সেবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সভায় ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

এছাড়া ন্যাশনাল প্রজেক্ট সাপোর্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট, ন্যাশনাল প্রকিউরমেন্ট সাপোর্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট, ন্যাশনাল অ্যাডমিন সাপোর্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট, ন্যাশনাল অপারেশন স্পেশালিস্ট, ন্যাশনাল আইওটি স্পেশালিস্ট রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। কন্ট্রাক্ট স্পেশিয়ালাইজড সার্ভিসেস রিলেটেড টু ইনোভেশনস রিচার্স নেটওয়ার্কিং বাবদ ১৮ কোটি ১৯ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। একান্ত প্রয়োজন না হলে কমিশন এগুলো বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

আমরা অযৌক্তিক একটি টাকাও অনুমোদন দেবো না। কেন ব্যয় চাওয়া হচ্ছে বিষয়গুলো দেখা হচ্ছে। প্রকল্পের নামের সঙ্গে ব্যয়ের যদি মিল না থাকে তবে সেই ব্যয় অনুমোদন দেওয়া হবে না।- পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মপ্রধান (ফসল উইং) ফেরদৌসী আখতার

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মপ্রধান (ফসল উইং) ফেরদৌসী আখতার জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষিখাতে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন অনুদান দিচ্ছে। এমন একটা প্রকল্প আমাদের কাছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তবে প্রকল্পে পরামর্শকসহ বেশ কিছু ব্যয় নিয়ে আমাদের দেখতে হচ্ছে। আমরা অযৌক্তিক একটি টাকাও অনুমোদন দেবো না। কেন ব্যয় চাওয়া হচ্ছে বিষয়গুলো দেখা হচ্ছে। প্রকল্পের নামের সঙ্গে ব্যয়ের যদি মিল না থাকে তবে সেই ব্যয় অনুমোদন দেওয়া হবে না।’

কৃষিতে ৫২ কোটি টাকা অনুদানের ১৩ কোটিই পরামর্শক ব্যয়

পদে পদে অসংগতি

প্রস্তাবিত প্রকল্পে নানান ধরনের অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে। প্রকল্পের মূল্যায়ন কার্যক্রমের জন্য বিভিন্ন স্থানে রাখা হয়েছে অর্থের সংস্থান। যেমন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য ১০ জনমাস হিসেবে ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার বাবদ ৫৪ লাখ টাকা সংস্থান রাখা হয়েছে। আবার কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য ৩০ জনমাস হিসেবে ন্যাশনাল এমঅ্যান্ডই স্পেশালিস্ট বাবদ সংস্থান রাখা হয়েছে ৭২ লাখ টাকা। প্রকল্প মূল্যায়ন ব্যয় বাবদ আছে ৪২ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে কমিশন জানিয়েছে, একই কার্যক্রমের জন্য আলাদাভাবে অর্থ সংস্থান যুক্তিযুক্ত নয়।

পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা যায়, প্রশাসনিক ব্যয় বাবদ মোট তিন কোটি ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা সংস্থান রাখা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে দাবি কমিশনের। এ ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে। ম্যানেজমেন্ট চার্জ ইনডাইরেক্ট সাপোর্ট কস্ট ফর এক্সিকিউশন অব দ্য ডেলিভারি অব প্রজেক্ট অ্যাক্টিভিটিস বাবদ তিন কোটি ৮২ লাখ টাকা নিয়ে ভাবতে হবে। স্থানীয় প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা বাবদ এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা বাবদ এক কোটি ৯৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা সংস্থান রাখার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।

প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, আইটি যন্ত্রপাতি ও অফিস সরঞ্জাম বাবদ ৪২ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। এ খাতের বিস্তারিত ব্যয় বিভাজন দরকার। টেকনিক্যাল সাপোর্ট টু ফিল্ড প্রজেক্টস বাবদ এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা সংস্থান রাখার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

প্রকল্পে একটু বেশি করেই পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়েছে। তবে কাটছাঁট করে কমানো যায়। পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরামর্শক ব্যয় কমানো হবে। আসলে এত পরামর্শক দরকার হয় না। তবে পরিকল্পনা কমিশন যেভাবে বলবে সেভাবে ব্যয় রাখা হবে।- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সদস্য পরিচালক (পরিকল্পনা) ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

কৃষি মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগ শক্তিশালীকরণে ২ কোটি ৬০ লাখ ১৯ হাজার টাকা সংস্থান রাখার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। মেশিনারি, যন্ত্রপাতি ও যান ভাড়া বাবদ ৩৬ লাখ টাকা সংস্থান রাখার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। প্রকল্পটির প্রস্তাবিত মেয়াদ ৩৮ মাস। উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন সংক্রান্ত নির্দেশিকা অনুসারে প্রকল্পটির মেয়াদ তিন বছর বা ৩৬ মাস নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে মত কমিশনের।

কৃষিতে ৫২ কোটি টাকা অনুদানের ১৩ কোটিই পরামর্শক ব্যয়

প্রচলিত কৃষিকাজে এত পরামর্শক কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সদস্য পরিচালক (পরিকল্পনা) ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি সম্পূর্ণ বিল গেটস ফাউন্ডেশনের অনুদানে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পে একটু বেশি করেই পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়েছে। তবে কাটছাঁট করে কমানো যায়। পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরামর্শক ব্যয় কমানো হবে। আসলে এত পরামর্শক দরকার হয় না। তবে পরিকল্পনা কমিশন যেভাবে বলবে সেভাবে ব্যয় রাখা হবে।’

প্রকল্প এলাকা

বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ নির্ধারিত ছয়টি ভৌগোলিক অঞ্চল (উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা অঞ্চল এবং নগরাঞ্চল)।

প্রধান উদ্দেশ্য

বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষির রূপান্তরে শস্যখাতে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তির প্রসার ঘটানো। কৃষির রূপান্তরে সরকারি বিনিয়োগের কার্যকারিতা মূল্যায়ন এবং নীতি ও বিনিয়োগের ব্যবধান বিশ্লেষণ করা। কৃষি রূপান্তর কার্যক্রমের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, ফসল উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনা, ফসল সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বিপণন ও বাণিজ্যিকীকরণ জোরদার করা ইত্যাদি।

টেকসই উন্নয়নে এত টাকা পরামর্শক কেন? টেকসই করতে হলে কৃষি ও কৃষকের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। কৃষি নতুন কাজ নয়। কৃষির জন্য করণীয় কী আমরা সবাই জানি, সুতরাং এত বেশি পরামর্শক ব্যয় অযৌক্তিক।- মুস্তফা কে মুজেরী

বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়নের নানান খাতে নিজেদের উপস্থিতি বড় করে তুলছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। গত দুই দশকে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ দাতব্য সংস্থার অর্থায়ন পেয়েছে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, শিক্ষা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও নারী উন্নয়নকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রকল্প। তাদের অর্থায়ন পাওয়া সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে আইসিডিডিআর,বি যেমন রয়েছে, তেমনি শিক্ষাখাতে আছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।

বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনকুবেরের হাতে গড়ে ওঠা ফাউন্ডেশনটির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তাদের মাধ্যমে পাওয়া অনুদানে গত দুই দশকে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি খাত দেশের সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। এবার নতুন করে কৃষিখাতে হাত বাড়িয়েছে এ ফাউন্ডেশন। তাই সচেতন ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে এই অনুদান খরচের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষিতে ৫২ কোটি টাকা অনুদানের ১৩ কোটিই পরামর্শক ব্যয়

এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নে এত টাকা পরামর্শক কেন? টেকসই করতে হলে কৃষি ও কৃষকের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। কৃষি নতুন কাজ নয়। কৃষির জন্য করণীয় কী আমরা সবাই জানি, সুতরাং এত বেশি পরামর্শক ব্যয় অযৌক্তিক।’

এত টাকা পরামর্শক ব্যয় রাখলে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন না হয়ে পরামর্শকদের উন্নয়ন হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাস্তব অর্থে টাকা ভেবে-চিন্তে ব্যয় করা জরুরি। কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকের উন্নয়ন জরুরি। পরামর্শকের পেছনে খরচ করে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন হবে না। অযৌক্তিক পরামর্শক ব্যয় বাদ দেওয়া দরকার। অধিকাংশ প্রকল্পে পরামর্শকের পেছনে ব্যয় করা হয়, এটা যৌক্তিক নয়।’

পরামর্শক ব্যয় বেশি রাখলে বিল গেটসের অর্থের অপচয় হবে দাবি করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাস্তব অর্থে যারা অর্থ দেয় তারা কিন্তু মাঠে দেখতে যায় না। বিল গেটসের এত সময়ও নেই। বাস্তবে কৃষির কতটুকু উন্নয়ন হচ্ছে তারা জানে না। যারা অর্থ নিয়ে ব্যয় করবে তারা কৃষকের মাঠের কিছু ছবিও ভিডিও দেখাবে, বলবে বিরাট কিছু অর্জন করা হয়েছে। অনুদানকারীরা এগুলো যাচাই করে দেখবে না। অনুদানের টাকা ছয়-নয় আত্মবঞ্চনা। এটা বিশ্বাস ঘাতকতার কাজ করছি।’

এমওএস/এএসএ/এএসএম

Read Entire Article