বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দাবি করে আসছে যে, তারা গাজায় অনাহার দূর করতে কাজ করছে। জাতিসংঘ ইসরায়েলের কাছে অনুরোধ করেছে তারা যেন আরও বেশি ত্রাণবাহী লরি এই অঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি দেয়। আরব এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো আকাশপথে ত্রাণ ফেলছে। গত ৫ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা বিতরণে আরও বড় ভূমিকা নেবে, যদিও তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি। তিনি সে সময় বলেছিলেন, আমি জানি ইসরায়েল আমাদের বিতরণ এবং অর্থের ক্ষেত্রেও সহায়তা করবে।
তবে বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। গাজার বাসিন্দারা বলছেন যে, সেখানকার অবস্থা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। গাজায় পর্যাপ্ত খাবার প্রবেশ করছে না, এমনকি ত্রাণ বিতরণের জন্য কোনো আইন-শৃঙ্খলাও নেই। বিমান থেকে খাবার পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ছে। সীমান্ত অতিক্রম করার পরপরই গাড়িবহর লুটপাট করা হচ্ছে। খাবার খুঁজে পেতে প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণভাবে ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে যেতে হয়। কিন্তু এসব ত্রাণকেন্দ্রে ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালাচ্ছে এবং শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এছাড়া কালোবাজার থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে গেলে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়।
এটা একটি বিপর্যয়, যা অনেক ফিলিস্তিনি বিশেষ করে শিশুদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি বয়ে আনবে। তবে এটা গাজার ভবিষ্যতের একটি আভাসও বলা যায়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও বছরের পর বছর ধরে অন্যদের করুণার ওপর অবরুদ্ধ এই উপত্যকাকে নির্ভরশীল থাকতে হবে।
ইসরায়েল এবং মিশরের মাঝখানে অবস্থিত এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডটি কখনোই স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ক্ষমতা দখলের পর এর প্রতিবেশীরা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। এই উপত্যকার অর্ধেক মানুষই বেকার ছিল এবং ৬০ শতাংশের বেশি জনসংখ্যা বেঁচে থাকার জন্য কোনো না কোনো বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভর করতো। গাজায় জাতিসংঘ নগদ সহায়তা প্রদান করে, বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে এবং প্রায় তিন লাখ শিশুকে শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে স্কুল পরিচালনা করছে।
অতীতে বিভিন্ন দেশের সহযোগিতার বাইরেও গাজা অন্তত কিছু মৌলিক চাহিদা নিজেরাই পূরণ করতে সক্ষম ছিল। এর ভূখণ্ডের দুই-পঞ্চমাংশ ছিল কৃষিজমি। স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য এসব কৃষিজমি পর্যাপ্ত পরিমাণে দুগ্ধ, হাঁস-মুরগি, ডিম এবং ফল ও সবজি সরবরাহ করা সম্ভব ছিল। ছোট কারখানাগুলো প্যাকেটজাত খাবার থেকে শুরু করে আসবাবপত্র পর্যন্ত সবকিছুই উৎপাদন করতো। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সঠিকভাবে কাজ করেছে। প্রায় দুই বছরের যুদ্ধের পর, এর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলছে, গাজার ২০ লাখ মানুষের প্রতি মাসে ৬২ হাজার টন খাদ্যের প্রয়োজন। কিন্তু গাজায় এখন যে পরিমাণ ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। গত ২ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত এই অঞ্চলে সম্পূর্ণ অবরোধ জারি করে ইসরায়েল। এ সময় গাজায় কোনো ধরনের ত্রাণ বা জরুরি খাদ্যও প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় ত্রাণ সহায়তা কিছুটা বাড়লেও তা পর্যাপ্ত বলা যাবে না। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ভ্যালেরি গুয়ারনিয়েরি বলেন, আমরা প্রতিদিন গাজায় ৮০ থেকে ১০০টি ট্রাক প্রবেশের চেষ্টা করছি। তবে গত ৪ আগস্ট ইসরায়েল মাত্র ৪১টি লরিকে গাজা সীমান্তের একটি স্টেজিং এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেয়।
গাজায় ত্রাণ প্রবেশ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ আর এগুলো বিতরণ করা একটি দুঃস্বপ্নের মতো। গত ১৯ মে থেকে জাতিসংঘ গাজার সীমান্ত থেকে ২ হাজার ৬০৪টি লরি বোঝাই ত্রাণ সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে মাত্র ৩০০টি তাদের নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। বাকিগুলো পথিমধ্যেই ক্ষুধায় কাতর বেসামরিক নাগরিক বা সশস্ত্র ব্যক্তিরা আটকে দিয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের ত্রাণ লুটপাটের বিষয়ে ত্রাণকর্মীরাও বেশ উদাসীন। তারা মনে করেন যে খাদ্য প্রয়োজন এমন লোকদের কাছেই এগুলো পৌঁছাচ্ছে। এটা সত্যিই হতাশাজনক। সেখানকার মানুষের কোনো আস্থা নেই যে পরের দিন খাবার আসবে কি না।
কিন্তু সেখানে কালোবাজারে খাদ্য বিক্রির তীব্রতা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, বেশিরভাগই চুরি হয়ে গেছে। গাজার চেম্বার অব কমার্স খাদ্যের দামের ওপর নিয়মিত জরিপ প্রকাশ করে। তারা বলছে, যুদ্ধের আগে ৩৫ শেকেল (১০ ডলার) মূল্যের ২৫ কেজি আটার বস্তা ৫ আগস্ট ৬২৫ শেকেলে বিক্রি হয়েছে। এক কেজি টমেটো ১০০ শেকেলের দামে বিক্রি হয়, যা যুদ্ধের পূর্বের মূল্যের ৫০ গুণ বেশি। এই দাম বেশিরভাগ গাজার মানুষের নাগালের বাইরে। যাদের সামান্য টাকা আছে তারা প্রায়ই অল্প পরিমাণে জিনিস কেনার জন্যও দর কষাকষি করে: উদাহরণস্বরূপ- একজন ক্রেতা তার পরিবারের জন্য একটি আলুও আনার জন্যও বার বার দামাদামি করেন। কারণ তাদের কাছে অর্থ নেই।
ইসরায়েলের নীতির পরিণতি সবচেয়ে বেশি ভোগ করতে হচ্ছে শিশুদের। কখনো কখনো শিশুরা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই এই পরিণতি ভোগ করছে। সেখানকার প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের গর্ভধারণের সময়টা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া অনেক শিশুই কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ২২২টি মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে, যা যুদ্ধের আগের তুলনায় ১০ গুণ বেশি।
জাতিসংঘ-সমর্থিত ক্ষুধা নিরীক্ষণকারী সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) গত মাসে বলেছে যে, এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে তীব্র অপুষ্টির জন্য ২০ হাজার শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এমনকি তারা সেই পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়েছে।
লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের শিশু বিশেষজ্ঞ মার্কো কেরাক বলেন, যখন খাবার গ্রহণ স্বাভাবিকের চেয়ে ৭০-৮০ শতাংশে নেমে আসে তখন শরীর বড় আঘাত পায়। মার্কো কেরাক দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় শিশুদের চিকিৎসা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, গাজার বেশিরভাগ শিশু প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই সামান্য খাবার পাচ্ছে। জুলাই মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুইলেন-বারে সিনড্রোমের প্রাদুর্ভাবের কথা জানিয়েছে, এটি একটি বিরল অটোইমিউন রোগ যার সঙ্গে ক্ষুধার সম্পর্ক থাকতে পারে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যে শিশুরাও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সেখানে ক্যালোরি গ্রহণই একমাত্র উদ্বেগের বিষয় নয়। গাজায় আটা এবং লবণ, কিছু ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন আয়োডিন দিয়ে সমৃদ্ধ সামান্য খাবার সরবরাহ হয়। সেখানকার অনেক বেকারি কয়েক মাস ধরে আটা এবং জ্বালানির অভাবে বন্ধ রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে, যুদ্ধবিরতি চলাকালীন ইসরায়েল গাজায় ১৫ হাজার টন ফলমূল এবং শাকসবজি এবং ১১ হাজার টন মাংস এবং মাছ প্রবেশের অনুমতি দেয়। মার্চ থেকে তারা মাত্র ১৩৬ টন মাংস প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। এর অর্থ হলো শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে এমন প্রয়োজনীয় পুষ্টির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
আজকের এই অপুষ্টি ও অনাহারের কারণে গাজার প্রতিটি শিশু আজীবন দুর্বল স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে থাকবে। দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকা জনসংখ্যার ওপর গবেষণা থেকে এর ধারাবাহিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, চীনে ১৯৬০-এর দশকের দুর্ভিক্ষ এবং সম্প্রতি ইথিওপিয়ার মতো জায়গাগুলোতে এ ধরনের চিত্র দেখা গেছে। যেসব শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের মধ্যে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের হার বেশি দেখা দিতে পারে। তাদের মানসিক বিকাশও ঝুঁকিতে রয়েছে।
গাজায় সহায়তা বাড়ানোর মাধ্যমে সব ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব না হলেও পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ হয়ে না যায় সেটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এটি টিকিয়ে রাখতে হবে। কারণ ইসরায়েলের যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের ফলে গাজাবাসীদের সহায়তার ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম কাজ হবে কেবল ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করা। স্যাটেলাইট চিত্রের ওপর ভিত্তি করে এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের এক মূল্যায়ণে অনুমান করা হয়েছে যে, গাজাজুড়ে ৫৩ মিলিয়ন টন ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর ম্যানহাটন থেকে অপসারণ করা ধ্বংসস্তূপের চেয়ে এই হার ৩০ গুণ বেশি। গাজা পুরোপুরি পরিষ্কার করতে কয়েক দশক সময় লেগে যেতে পারে।
সেখানে উৎপাদনশীল অর্থনীতি পুনর্গঠন করাও কঠিন হবে। কৃষির কথাই ধরা যাক- জাতিসংঘের কৃষি সংস্থা জানিয়েছে যে, যুদ্ধে গাজার ৮৪ শতাংশ কৃষিজমি এবং ৭১ শতাংশ গ্রিনহাউস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশুপালন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
গাজার বেশিরভাগ রাস্তা-ঘাট নষ্ট হয়ে গেছে। যুদ্ধের পর কৃষকরা যদি ফসল রোপণ শুরু করতে পারে, তবুও তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে আনা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই রকম হতাশাজনক চিত্র দেখা যাচ্ছে। সেখানকার স্কুল, হাসপাতাল এবং কারখানাগুলো মূলত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
টিটিএন