একাকিত্বের মাঝে পাখি হতে পারে আপনার পরম সঙ্গী। তাহলে ছোট্ট একটি পাখির সঙ্গেই বন্ধুত্ব কেন নয়? কিচিরমিচির শব্দ আর সুরেলা গান সহজেই জাগিয়ে তুলতে পারে বেঁচে থাকার প্রেরণা। দীর্ঘদিন ধরে পাখি পোষেন তানভীর ইসলাম। পশুপাখি, গাছপালার প্রতি ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ। প্রাণিকূল নিয়ে জানতেও ভালো লাগে তার। তিনি বলেন, ‘শখ থেকেই শুরু হয় মানসিক শান্তির খোঁজ। পাখির সৌন্দর্য, ডাকাডাকি আর বাচ্চা থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠার দৃশ্য আমাকে ভরিয়ে তোলে শান্তি ও আনন্দে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়, শখ ও মানসিক শান্তির জন্যই পাখি পোষেন অনেকে। রশিদ শাহরিয়ার রাফি নামে একজন লিখেছেন, ‘মানসিক শান্তি আছে বেশি, বাসায় সব সময় ঈদ ঈদ লাগে’। মো. সজিব নামের ফেসবুক ব্যবহারকারী লেখেন, ‘মানসিক শান্তি, শখ এবং ভালোবাসার জন্য পাখি পুষি’।
সানজিদা সুলতানা পুতুল বলেন, ‘শখেই শুরু করছিলাম! কিন্তু যখন বাইরে থেকে আসি, আমাকে দেখার পর কিচিরমিচির শুরু করে। কাছে গেলেই চুপ হয়ে যায়। তখন নিজেকে সুখী মানুষ মনে হয়!’ ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘কেন পুষি তা বলতে পারবো না। ছোট থেকেই এটা নেশার মতো’।
তবে সব পাখি যে পোষা যায় না। দেশে রয়েছে আইন। আমাদের দেশের আইনে দেশি ময়না, টিয়া, শ্যামা, শালিক, ঘুঘু, দোয়েল কিংবা ফিঙের মতো বন্যপাখি পালন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে নিয়ম মেনে চললে বিদেশি পাখি পালনে তেমন বাঁধা নেই। বাজরিগর, ককাটিয়েল, জাভা, লাভবার্ড, ফিঞ্চ, রিং নেক কনুর, লরিকিট বা ম্যাকাওয়ের মতো বিদেশি প্রজাতি অবাধে পালন করা যায়।
পাখি পালনে চাই আরামদায়ক খাঁচা। পাখির আকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খাঁচা বেছে নিতে হবে। ২৪-২৪-২৪ বা ২৪-২৪-১২ ইঞ্চি মাপের খাঁচায় ছোট পাখি ভালোভাবে রাখা যায়। আবার চাইলে নেট দিয়ে ঘিরে ভেতরে ডালপালা বসিয়ে ছেড়েও রাখা যায়। একে বলা হয় কলোনি পদ্ধতি। এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করলে পাখি যেমন নিজেকে খাপ খাওয়াবে; তেমনই নিজের বাসস্থানকে মনে হবে পাখির রাজ্য।
শুধু খাঁচা থাকলেই হবে না। থাকতে হবে পানির পাত্র, খাবারের বাটি, বসার জন্য লাঠি, আর প্রজননের সময়ে উপযুক্ত বক্স বা হাঁড়ি। একেক পাখি একেক ধরনের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। কিছু পাখি শস্য, বীজ, শাক-সবজি জাতীয় খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার কিছু পাখি আছে যারা ফলমূল, ফলের রস খেতে বেশি পছন্দ করে। পাখি কেনার সময় পাখির খাদ্যের দিকটাও বিবেচনায় রাখুন। দোকানদারের কাছ থেকে পাখিটির খাবার, খনিজ ও পানীয় সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। পোষা পাখির দোকানেই পাবেন পাখিদের জন্য প্যাকেটজাত খাবার। আরও পাবেন শস্য ও দানাদার খাবার।
পরিচ্ছন্নতা হলো পাখির সুস্থতার প্রধান শর্ত। সপ্তাহে অন্তত একদিন পাখিকে গোসল করাতে হবে। যাতে পালক ঝকঝকে থাকে আর রং ফুটে ওঠে। এ ছাড়া খাঁচার খাবার ও পানির পাত্র প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একবার খাঁচা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। নোংরা খাবার বা অপরিষ্কার পরিবেশেই সাধারণত পাখি অসুস্থ হয়। অসুস্থ হলে দ্রুত আলাদা খাঁচায় নিয়ে উষ্ণ পরিবেশে রাখতে হবে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এ ছাড়া নিয়মিত চেকআপের জন্য চিকিৎসকের সাক্ষাৎ নেওয়া ভালো।
কেয়ার অ্যান্ড কিউর ভেটেরিনারি ক্লিনিকের কনসালটেন্ট অ্যান্ড সার্জন ডা. আবু ইরবাত আহমদ রাফি বলেন, ‘পাখির সুস্থতায় বার্ড প্যারেন্টসদের সব থেকে বেশি যেটা মাথায় রাখা উচিত, সেটা হলো বায়োসিকিউরিটি। স্ট্রিক্ট বায়োসিকিউরিটি অ্যান্ড আইসোলেশন মেইন্টেইন করতে পারলে পাখির ইনফেকশন অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়। নিয়মিত ভ্যাক্সিনেশন, কৃমির ওষুধ খাওয়ানো, ওয়েদার এবং বডি কন্ডিশন অনুযায়ী খাবার ফর্মুলেশন; এগুলোও পাখির সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘এরপরও কোনোভাবে পাখি অসুস্থ হলে, মৃত্যুহার কমাতে পরামর্শ থাকবে পাখির স্ট্রিক্ট অবজারভেশন। যেমন- প্রতিদিন পাখি কতটুকু খাবার এবং পানি খায়, পাখির ড্রপিংস প্রতিদিন কেমন হয় ইত্যাদি। পাখির পালকগুলো স্বাভাবিক আছে কি না, গায়ে কোন পরজীবী আছে কি না, শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক আছে কি না, হাঁটা-চলা স্বাভাবিক আছে কি না; এগুলো খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই পাখির অসুস্থতা সম্পর্কে আগাম ধারণা পাওয়া যায়। এতে কোনো পরিবর্তন দেখলেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এ ছাড়া প্রজাতিভেদে সুস্থ পাখিদেরও বছরে এক থেকে দুইবার ভেটেরিনারিয়ানের কাছে রুটিন চেকআপের জন্য যাওয়া উচিত।’
শুধু চিকিৎসা কিংবা খাবার নয়, খাঁচার জায়গাটাও গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরি রোদ, ঝড় বা বৃষ্টির পানির ধাক্কা যেন না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি বিড়াল, কুকুর, ইঁদুর কিংবা চিল-কাকের মতো শিকারি প্রাণী থেকে দূরে রাখতে হবে। রাতে পাতলা কাপড় দিয়ে খাঁচা ঢেকে দিলে পাখি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারে।
পাখি কেনার জন্য ঢাকার কাঁটাবন বাজার বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া পুরান ঢাকা, মিরপুর, টঙ্গীসহ বিভিন্ন পশুপাখির দোকান ও সাপ্তাহিক হাটেও পাওয়া যায় নানা প্রজাতির বিদেশি পাখি। দাম ভিন্ন হয় জাত ও রং অনুযায়ী। সৌন্দর্য বা বিনোদনের জন্য নয়, পাখি মানুষের মানসিক শান্তির জন্যও জরুরি। ভোরের ঘুম ভাঙাতে, ক্লান্তি দূর করতে কিংবা মনের অবসাদ ভাঙাতে আজই নিয়ে আসুন পাখি। ভালোবাসা আর যত্নে গড়ে তুলুন আপনার প্রিয় সঙ্গী।
এসইউ/জেআইএম