দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজের ক্যাম্পাসে এক শিক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহ থেকেই পশ্চিমবঙ্গে তোলপাড় চলছে। একদিকে যেমন নির্যাতিতা শিক্ষার্থীর জন্য ন্যায় বিচার এবং নারী নিরাপত্তার দাবি জোরালো হয়েছে, তেমনই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার পর কলকাতার আরও একটি কলেজে একই ঘটনা কিভাবে ঘটলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে পথে নেমেছে বিভিন্ন সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমও গঠন করা হয়েছে।
তবে এসব কিছুর মধ্যেও রাজনৈতিক বিতর্ক জোরালো হয়ে উঠেছে। বিজেপি, বাম ও কংগ্রেসের দাবি, কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী যার সঙ্গে তৃণমূলের ছাত্র পরিষদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে প্রকাশ পেয়েছে, তিনি কীভাবে এতটা ‘প্রভাবশালী’ হয়ে উঠলেন? পাশাপাশি তাদের অভিযোগ, ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে তিনি ওই কলেজেই অস্থায়ী পদে চাকরি পেলেন?
অন্যদিকে তৃণমূলের ছাত্র পরিষদ প্রথমদিন থেকেই অভিযুক্তদের থেকে নিজেদের দূরত্ব স্পষ্ট করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, মদন মিত্র বা কল্যাণ ব্যানার্জীর মতো নেতাদের ‘বেফাঁস’ মন্তব্যকে যে সংগঠন সমর্থন করে না তাও স্পষ্ট করে দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, আরজি কর হাসপাতালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্ত এবং পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে শাসকদলকে যেভাবে ‘অস্বস্তিতে’ পড়তে হয়েছিল তারপর কসবার ঘটনার বিষয়ে অনেকটাই ‘সাবধানী’ তৃণমূল। অন্যদিকে শাসকদলকে আবার ‘কোণঠাসা’ করতে ‘মরিয়া’ বাম, বিজেপিসহ বিরোধীরা।
বিরোধীরা কী বলছে?
কসবার আইন কলেজে ছাত্রী গণধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই তৃণমূলকে ‘নিশানা’ করা শুরু করেছে বিরোধীরা। মূল অভিযুক্তের সঙ্গে তৃণমূলের একাধিক বড়সড় কর্মকর্তাদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করতে শুরু করে বিজেপি।
রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন,কসবার ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সন্দেশখালি থেকে শুরু করে কসবা, সব জায়গায় মা-বোনেরা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। আরজি করের ঘটনার ১০ মাসের ব্যবধানে ফের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই ঘটনা ঘটেছে। গণধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে এক শিক্ষার্থীকে। এরপরও একজন মুখ্যমন্ত্রী মুখ দেখাতে পারেন? বলতে পারেন যে বাংলা এগিয়ে? লজ্জা করে না?
এই ঘটনায় তৃণমূলকে নিশানা করতে ছাড়েনি বামেরাও। বাম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বুঝে গিয়েছে যে মুখ্যমন্ত্রী একজন নারী হলেও রাজ্যে মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা নেই। বাংলা তার নিজের মেয়ের নিরাপত্তা চায়। প্রতিবাদ করাটা জরুরি এবং প্রতিবাদ হচ্ছে… তা আরও বাড়বে।
পশ্চিমবঙ্গে নৈরাজ্য চলছে বলে অভিযোগ তুলেছেন কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী। তিনি বলেন, কসবার ওই কলেজের ঘটনা প্রমাণ করে যে পশ্চিমবঙ্গে নৈরাজ্য চলছে। আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি যে আইন কলেজের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীকে গণধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে। আর এ ধরনের অপরাধীদের আশ্রয় দিচ্ছে তৃণমূল।
তৃণমূল কী বলছে?
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ থেকে শুরু করে বর্ষীয়ান নেতারা সবাই প্রথমেই দলের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, তৃণমূলের কেউ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাক বা না থাক, দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপের দাবি জানাচ্ছি। যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সে বর্তমানে কলেজের কর্মচারী। ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত নয়।
পাশাপাশি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য আন্দোলনের ঘোষণাও দিয়েছেন। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রত্যেক কর্মী এই ঘটনার নিন্দা করছে। অভিযুক্তদের কড়া শাস্তির জন্য তিনি দাবি তুলেছেন।
অস্বস্তিতে তৃণমূল
অভিযুক্তের সঙ্গে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের সংযোগের অভিযোগ যে ‘অস্বস্তি’ বাড়িয়েছে তা স্পষ্ট। তদন্তের সময় ওই সাবেক ছাত্রের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে তৃণমূলের একাধিক নেতাদের বিতর্কিত মন্তব্য দলের ‘অস্বস্তিকে’ আর বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে কল্যাণ ব্যানার্জীকে বলতে শোনা গেছে, যারা এ ধরনের লোকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের বোঝা উচিত, তারা কার সঙ্গে যাচ্ছে। এরপর কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশি নিরাপত্তা দিতে হবে কি না সেই প্রশ্নও করেন তিনি।
এ নিয়ে বিতর্ক কাটতে না কাটতেই মদন মিত্র মন্তব্য করেন ওই ছাত্রীর রাতে একা যাওয়া উচিত হয়নি। এই মন্তব্যকে ঘিরে বিরোধীরা শাসকদলকে আরও সমালোচনা করতে শুরু করে। তবে তড়িঘড়ি করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয় তৃণমূল। এই মন্তব্য যে দলের নয় তা স্পষ্ট করে দেওয়ার পাশাপাশি পদক্ষেপও নেওয়া হয়। ২০২৬-এর নির্বাচনের আগে দল যে বড় কোনো বিতর্কে জড়াতে চায় না, সেটা স্পষ্ট।
তৃণমূল বনাম বিজেপি
তৃণমূলই যে শুধু নিজেদের অবস্থান রক্ষা করতে ‘মরিয়া’ এমনটা কিন্তু নয়। বিরোধী বিশেষত বিজেপি এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান জোরালো করার চেষ্টা করছে। বিরোধীদলগুলো এরই মধ্যে প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে পথে নেমেছে। তাদের পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে, আটকও করা হচ্ছে।
প্রতিবাদের সময় বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে শনিবার গড়িয়াহাট চত্বর থেকে গ্রেফতার করা হয় সুকান্ত মজুমদারসহ একাধিক বিজেপি নেতাকে। কিন্তু ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন নিতে রাজি হননি তিনি। পুরো রাত কাটানোর পর, রোববার লকআপ থেকে বেরিয়ে তিনি জানিয়েছেন, এবার বিজেপি কর্মীদের গ্রেফতার করা হলে, কেউ ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন নেবেন না।
এই ঘটনার আঁচ রাজ্য ছাড়িয়ে জাতীয়স্তরের রাজনীতির ময়দানেও পৌঁছেছে। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা দ্রুত একটি তথ্য অনুসন্ধানকারী দল গড়েছেন। সেই দলের প্রতিনিধিরা সোমবার কলকাতায় এসে পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকও করেছেন।
গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এর আগে জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধি দল রোববার ওই কলেজ পরিদর্শনে আসে। ঘটনাস্থলের ভিডিও করতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। এ নিয়েও দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলছে।
সামাল দিতে পারবে তৃণমূল কংগ্রেস?
কলেজে ছাত্রনেতাদের প্রভাবের বিষয়টা যে নতুন নয়, তা ব্যাখ্যা করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিখা মুখার্জী। তিনি বলেন, আসলে কংগ্রেস জামানা থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটা কলেজে শাসকদলের পক্ষ থেকে এ ধরনের দাদাগিরি চলে এসেছে। ছাত্রনেতা থেকে বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়েছেন এমনটা অহরহ বলতে শোনা যায়। এই তালিকায় মমতা ব্যানার্জীও পড়েন। কসবার কলেজের ঘটনা নিয়ে তৃণমূল সাবধান এবং সংযতভাবে চলছে বলেই মনে করেন তিনি।
তার কথায়, তৃণমূল খুবই সংযতভাবে এবং সাবধানতার সঙ্গে এ বিষয়ে এগোচ্ছে। এখানে তাদের দুটি ভূমিকা আছে। একটা দল হিসাবে অন্যটা রাজ্যে ক্ষমতাসীন সরকার হিসাবে।
সরকার হিসেবে তারা এ বিষয়ে তৎপরতা দেখাচ্ছে এবং তদন্ত নিয়ে বিরোধীদের খুব একটা বলার সুযোগ দিচ্ছে না। যেমনটা আরজি করের ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে। সে সময় ঘটনার তদন্ত নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। রাজ্য সরকারের কাজ এবং উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এর পেছনে কারণটা বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, এর রাজনৈতিক পরিণতি অনেক কিছুই হতে পারে। আরজি করের ঘটনার পর কলকাতার অন্য এক ক্যাম্পাসে একজন ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে-এই বিষয়টা উদ্বেগের। দুর্ভাগ্যবশত আরজি কর হাসপাতালের সেই তরুণী জীবিত নেই, কিন্তু এই ছাত্রী ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ উল্লেখ করে বয়ান দিয়েছে।
এখনো পর্যন্ত সূত্র মারফত যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ছাত্রীর বয়ানের সঙ্গে সিসিটিভির ফুটেজ এবং অন্যান্য তথ্য মিলে যাচ্ছে। তাই তৃণমূল জানে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দিক থেকে পরিস্থিতি অনেকটা জটিল।
এ বিষয়ে অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। তিনি বলেছেন, তৃণমূল জানে এভাবেই চলবে। যতই অন্যায় হোক, অপশাসন হোক তারা ভোট পাবে সেটা তারা জানে। এই ভাবনা নিয়েই তারা চলছে।
বিরোধীরা তৃণমূলকে কোণঠাসা করতে পারবে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের কাছে রাজ্যের গভর্নেন্সের (শাসন) বিষয়টা খুব একটা চিন্তার কিছু নয়। যতক্ষণ না তাদের গায়ে আঁচ লাগছে মানুষের খুব একটা যায় আসে বলে মনে হয় না আমার।
বিরোধী হিসাবে বিজেপি যে চেষ্টা চালাচ্ছে সেটা মেনে নিয়েছেন তিনি। তার কথায়, বিজেপি চেষ্টা করছে এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তারা রাস্তায় সক্রিয়। জেলাগুলোতেও তারা মিছিল করছে।
অন্যদিকে শিখা মুখার্জী আবার বলেছেন, বিজেপি বা বামেরা যারাই রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করুক না কেন, দেখতে হবে মানুষ বিষয়টাকে শেষপর্যন্ত কীভাবে দেখছে। পরপর দুই-তিনটা ঘটনা ঘটার পর একটা রাজনৈতিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে তৃণমূল সেটাকে কীভাবে সামাল দেবে সেটা দেখার। পাশাপাশি বিজেপির কৌশলটা কেমন এবং তৃণমূলকে রাজনৈতিক দিক থেকে কতটা ক্ষতি করতে পারে সেটাও বিবেচনা করতে হবে। তবে তার প্রভাব এখনো দেখতে পাচ্ছি না।
টিটিএন