‘ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে দুনীর্তির পালাবদল বন্ধ করতে হবে’
ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে দুর্নীতির পালাবদল বন্ধ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
রোববার (৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর এফডিসিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন তিনি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকলেও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। প্রয়োজনে বিকল্প কোনো দেশ থেকে আমাদের পণ্য ক্রয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিটি বিতর্কিত ও একপক্ষীয় হয়েছে। জনগণকে পাশ কাটিয়ে এ চুক্তি করা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়নি।
তিনি বলেন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি অবস্থা বিবেচনায় টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দিয়েছে, এই টাকা কোনোভাবেই ঋণ বা ব্যবসায়িক কাজে লাগানো যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী বর্তমান এবং পূর্বতন কোনো সরকারি কর্মকর্তা গভর্নর কিংবা ডেপুটি গভর্নর হতে পারে না। তারপরও আমরা দেখি অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সেখানে আমলাদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপরাধ করে শাস্তি না পেয়ে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে শোষণ ও দুর্নীতির পালাবদল চলতে থাকবে। চলমান ব্যাংকগুলোতে এত সমস্যা থাকার পরও বিগত সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে, যেখানে স্বজনপ্রীতিই ছিল মুখ্য।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বিগত ১৫ বছরের শাসন আমলে আর্থিক খাতকে চোরতন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করলেও পতিত সরকারের আমলে শুধু চোরতন্ত্র নয়, তারা দখলতন্ত্র, লুটতন্ত্রসহ ডাকাততন্ত্র কায়েম করেছিল। পতিত সরকারের শাসন আমলে পাচার ২৩৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ৭৫ থেকে ৮০টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। খেলাপিকৃত ঋণ ৩ লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল ও আরও ২৪টি পদ্মাসেতুর মতো প্রকল্প নির্মাণ করা যেত। খেলাপি ঋণে পিছিয়ে নেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোও। রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের বোঝা যা দাঁড়িয়েছে, তা কেয়ামত পর্যন্ত শোধ করা যাবে না। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন পাঁচ তারকা হোটেলে বসে সুদহার ও ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিত। আর সেই সুদ হার ও ডলারের মূল্য বাংলাদেশ ব্যাংক মেনে নিত। আমাদের জন্য বড় দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে- রাজনীতিবিদরাই ব্যবসায়ী, তারাই ব্যাংকের মালিক, আবার মিডিয়া হাউসেরও মালিক। যিনি কর খেলাপি, তিনিই ঋণখেলাপি আবার তিনিই অর্থ পাচারকারী। ফলে দেশে সুশাসনের অভাব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বর্জন করা হয়। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়িভাড়া এমনকি পেট্রল পাম্পে তেলও নিতে পারে না। অথচ আমাদের দেশে ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীরা এয়ারপোর্টে ভিআইপি হিসেবে যাতায়াত করে। রাষ্ট্রীয় সফরে প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি বসে ভ্রমণ করে।
তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন দুই সেনাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও তৎকালীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তারা দুজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়েছে। বিগত সময়ের এই ডাকাতরা বিদ্যুৎ খাতে ৬ বিলিয়ন ডলার নয় ছয় করেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার শুধু ঘুষ নিয়েছে পতিত প্রধানমন্ত্রীর পরিবার ও তার দোসররা। বিদ্যুতের এমন মিটার বসিয়েছে আওয়ামী সরকার বাতি না জ্বললেও মিটার ঘোরে। প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করার সঙ্গে সঙ্গে এক-চতুর্থাংশ টাকা মিটার খেয়ে ফেলে। শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাসের পাইপে গ্যাসের পরিবর্তে বাতাস দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ফেরি করে বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলা হলেও বিদ্যুতের ফেরিওয়ালারা এখন সব পলাতক। অনেকে মনে করেন আদানি বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। আমি মনে করি আদানির সঙ্গে আমাদের বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিল হলে বাংলাদেশ বেঁচে যাবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে টানাপোড়েন চলছে, তা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে আমাদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এক সময়ে আমরা ভারতের গরুর ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন আমরা পশুপালনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভারতীয় পেঁয়াজ, আলু, সুতাসহ যেসব পণ্য আমরা আমদানি করি তা বন্ধ হলে বাংলাদেশ খুব বেশি বিপদে পড়বে না। এখন থেকে আমরা নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবো অথবা বিকল্প আমদানির পথ বের করতে হবে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। প্রতি বছর আমাদের দেশের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে ভারতে গিয়ে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। আমরা উদ্যোগ নিলে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি নিতে পারব। সুতরাং ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বা সেবা খাতে কোনো টানাপোড়েন দীর্ঘায়িত হলে সেটি বাংলাদেশের জন্য বুমেরাং হবে।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাবই দুর্নীতি প্রতিরোধে বড় চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ছায়া সংসদে বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটিকে বিতার্কিকদের পরাজিত করে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, সাংবাদিক মো. তৌহিদুল ইসলাম, সাংবাদিক জাকির হোসেন ও সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।