বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধীরে ধীরে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছে। আজকের দিনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ বিকাশের ক্ষেত্রে দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই অগ্রগতির অন্যতম বড় চালিকাশক্তি হলো নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ।
একসময় নারীর অবদান গৃহস্থালি কাজ, সন্তান প্রতিপালন বা কৃষি খাতে স্বল্প পারিশ্রমিকের শ্রমেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে তাদের কাজের মূল্যায়নও যথাযথভাবে হতো না। কিন্তু সময়ের পরিবর্তন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ, নারী শিক্ষার প্রসার, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি নারীদের সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আজ তারা কেবল ভোক্তা বা সহায়ক শক্তি নয়, বরং উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি হিসেবে অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছেন।
বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও মাঝারি উদ্যোগে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্থানীয় পর্যায়ে তারা হস্তশিল্প, কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ, কুটির শিল্প কিংবা ক্ষুদ্র দোকানের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে ধীরে ধীরে সেটিকে টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামীণ অঞ্চলে নকশিকাঁথা, তাঁতের কাপড়, বাঁশ-বেতের সামগ্রী, মাটির কাজ বা ঘরে তৈরি খাবারের ব্যবসা নারীদের আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে শহরাঞ্চলে নারীরা অনলাইন ব্যবসা, ই-কমার্স, ফ্যাশন হাউস, কসমেটিক্স শপ, বিউটি সেলুন, ক্যাটারিং সার্ভিস, এমনকি আইটি খাতেও দৃঢ় অবস্থান তৈরি করছেন। তাদের উদ্যোগ শুধু পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করছে না, বরং স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে, কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি করছে এবং সমাজে নারীর মর্যাদা বাড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে একজন নারী উদ্যোক্তা নিজের উদ্যোগের পাশাপাশি প্রতিবেশী বা গ্রামের অন্য নারীদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছেন, যা সমাজে আত্মকর্মসংস্থানের সংস্কৃতি গড়ে তুলছে। এভাবে নারীরা আজ শুধু পরিবারের আর্থিক ভিত্তিই শক্তিশালী করছেন না, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোতেও নতুন গতি ও প্রাণ সঞ্চার করছেন।
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারী পরিবারের অভ্যন্তরে এবং বাইরের সামাজিক অঙ্গনে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। যখন একজন নারী নিজস্ব আয় থেকে পরিবারের ব্যয় মেটাতে সক্ষম হন, তখন তিনি আর কেবল গৃহস্থালির সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকেন না; বরং সক্রিয়ভাবে পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেন। সন্তানের শিক্ষায় বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে তার মতামত গুরুত্ব পায়, কারণ তিনি নিজেই আয় করেন এবং ব্যয়ের উৎস নির্ধারণে ভূমিকা রাখেন।
নারীর ক্ষমতায়ন মানেই দেশের শক্তি ও সমৃদ্ধির নতুন অধ্যায় সূচিত হওয়া। বাংলাদেশ যদি নারী উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, তবে ‘আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন অনেকাংশেই সহজ হবে। নারীরা যত বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবেন, তত দ্রুত দেশ দারিদ্র্যমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই উন্নয়নের পথে অগ্রসর হবে।
একইভাবে পরিবারের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নে নারীর সচেতনতা ও আর্থিক সামর্থ্য সরাসরি প্রতিফলিত হয়—তিনি উন্নতমানের খাবার কিনতে সক্ষম হন, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করতে পারেন এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিবারের জন্য সঞ্চয় গড়ে তুলতে পারেন। সম্পদ ব্যবস্থাপনা, গৃহনির্মাণ, জমি ক্রয়-বিক্রয় কিংবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়ও তার সক্রিয় উপস্থিতি থাকে। ফলে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন শুধু পারিবারিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করে না, বরং সামাজিক রূপান্তরেরও শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তোলে। এই কারণে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এ নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গসমতা একটি বিশেষ লক্ষ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত না করলে কোনোভাবেই টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব নয়। বরং নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অগ্রগতি সম্ভব হবে।
নারী উদ্যোক্তাদের ভূমিকা বহুমুখী এবং তা ক্রমবর্ধমানভাবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কাঠামোয় প্রভাব বিস্তার করছে। উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমে তারা কেবল আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করছেন না, বরং আত্মমর্যাদা ও সামাজিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠা করছেন। আগে যেখানে একজন নারী কেবল গৃহিণী বা সহায়ক ভূমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন, এখন তিনি ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী এবং সামাজিক নেতৃত্বদানকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
একজন নারী উদ্যোক্তা যদি হস্তশিল্প বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবসা শুরু করেন, তবে তিনি নিজের সঙ্গে আরও কয়েকজন নারী বা যুবককে যুক্ত করতে সক্ষম হন, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে এবং বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করে। কৃষি প্রক্রিয়াকরণে নারীরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যকে নতুনভাবে বাজারজাত করছেন, হস্তশিল্পে তারা দেশীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বে পরিচিত করছেন, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনে নতুন বাজার তৈরি করছেন, অনলাইন ব্যবসা ও ই-কমার্সের মাধ্যমে আগ্রহী গ্রাহকের দ্বারে পৌঁছাচ্ছেন, আবার ফ্রিল্যান্সিং ও আইটি খাতে দক্ষতার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। তাদের উদ্যোগে অর্থনীতি বহুমুখী হয়ে উঠছে এবং দেশ বৈদেশিক বাণিজ্য ও রেমিট্যান্স উভয় ক্ষেত্রেই লাভবান হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এইসব কর্মকাণ্ড সমাজে নতুন মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে—যেখানে নারীরা আর কেবল পরনির্ভরশীল নয়, বরং অর্থনীতির সক্রিয় চালিকাশক্তি।
ক্ষুদ্র ব্যবসা বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় সত্তর শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত থেকে আসে, যা জিডিপির উল্লেখযোগ্য অংশ বহন করে থাকে। কৃষিনির্ভর ও জনবহুল দেশে এ খাত স্থানীয় অর্থনীতিকে সচল রাখার পাশাপাশি আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে তুলতে বড় শিল্পের মতো বিপুল মূলধন, জটিল প্রযুক্তি বা বিশাল অবকাঠামোর প্রয়োজন হয় না। সামান্য মূলধন, স্বল্প জায়গা এবং অল্প দক্ষতা দিয়েই এই ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। এ কারণে নিম্নআয়ের পরিবার, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী কিংবা আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা নারীরাও সহজেই এই খাতে প্রবেশ করতে পারেন। যেমন, একটি ছোট মুদি দোকান, হাঁস-মুরগি পালন, দর্জি কাজ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বা হস্তশিল্প তৈরির মতো ক্ষুদ্র উদ্যোগ দ্রুত আয় সৃষ্টি করে এবং পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের পথ দেখায়। এর মাধ্যমে শুধু দারিদ্র্য হ্রাস পায় না, স্থানীয় বাজারে অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি করে, কর্মসংস্থান তৈরি হয় এবং সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। এভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে একদিকে স্থিতিশীলতা আনে, অন্যদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
তবে বাস্তবতায় নারী উদ্যোক্তারা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, যা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মূলধনের অভাব। ব্যবসা শুরু বা সম্প্রসারণের জন্য ব্যাংক ঋণ প্রয়োজন হলেও, নারীরা প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হন। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান নারী উদ্যোক্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ গ্রাহক মনে করে ঋণ অনুমোদনে অনীহা প্রকাশ করে।
তাছাড়া অধিকাংশ সম্পদ পুরুষদের নামে নিবন্ধিত থাকায় জামানত প্রদানের সুযোগ থেকেও নারীরা বঞ্চিত হন। সামাজিক ও পারিবারিক মানসিকতাও বড় প্রতিবন্ধকতা। এখনো অনেক পরিবার মনে করে ব্যবসায় যুক্ত হলে নারীরা সংসার, স্বামী বা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব অবহেলা করবে। ফলে নারীরা আত্মবিশ্বাস হারায় এবং উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস করে না। বাজারে প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়ায় তারা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পান না; বড় ব্যবসায়ী বা পাইকারি বাজারে তাদের স্থান হয় না। প্রযুক্তি ও তথ্য ঘাটতির কারণে অনলাইন ব্যবসা বা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে তারা পিছিয়ে পড়েন। প্রশাসনিক জটিলতা, লাইসেন্স বা নিবন্ধন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা তাদের নিরুৎসাহিত করে।
এছাড়া প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ সবার কাছে পৌঁছায় না, বিশেষত গ্রামীণ নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন। নিরাপত্তাজনিত সমস্যা এবং চলাফেরার সীমাবদ্ধতাও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা, যার কারণে তারা অনেক সময় ব্যবসায়িক সভা, মেলা বা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এসব কারণে অনেক নারী উদ্যোক্তা সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায় টিকে থাকতে পারেন না অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যর্থ হন।
এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হলে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করা জরুরি। নারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, বিশেষ করে জামানতবিহীন ও কম সুদের ঋণ যাতে তারা দ্রুত অনুমোদন পায়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নারী-বান্ধব নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম শহরের পাশাপাশি গ্রামেও সমানভাবে বিস্তৃত করতে হবে, যাতে নারী উদ্যোক্তারা হিসাবরক্ষণ, বিপণন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং এবং গ্রাহক ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়ে বাস্তব দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমকে সহজলভ্য করতে হবে, যাতে নারীরা প্রযুক্তির মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে পারেন।
একইসাথে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, পরিবার ও সমাজকে বুঝতে হবে যে নারীর উদ্যোক্তা হওয়া মানেই দায়িত্ব অবহেলা নয়, বরং এটি পরিবার ও সমাজের জন্য অতিরিক্ত শক্তি। ব্যবসার নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স, কর প্রদান ইত্যাদি প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত নিষ্পত্তিযোগ্য করতে হবে। বাজার সংযোগ তৈরি করা, আন্তর্জাতিক মেলা ও প্রদর্শনীতে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের জন্য শক্তিশালী ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। যদি এসব কৌশল কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে নারী উদ্যোক্তারা কেবল ক্ষুদ্র ব্যবসায় সীমাবদ্ধ থাকবেন না; বরং বৃহত্তর অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবেন এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবেন।
বাংলাদেশে সফল নারী উদ্যোক্তাদের অসংখ্য অনুপ্রেরণামূলক গল্প রয়েছে, যা প্রমাণ করে সুযোগ ও সহায়তা পেলে নারীরা সমাজ ও দেশের অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন। কেউ ঘরে বসেই অনলাইনে জামদানি শাড়ি, নকশিকাঁথা বা অন্যান্য হস্তশিল্প বিক্রি করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছেন, কেউ স্থানীয়ভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তুলে গ্রামের কৃষকদের উৎপাদিত ফল-সবজি ব্যবহার করে টেকসই ব্যবসা গড়ে তুলেছেন, আবার কেউ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ফ্রিল্যান্সিং করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন।
এ ছাড়াও অনেক নারী বিউটি সেলুন, ফ্যাশন হাউস, অনলাইন বুটিক, ক্যাফে, ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি, এমনকি আইটি স্টার্ট-আপ সফলভাবে পরিচালনা করছেন। এসব উদাহরণ দেখায়, নারী উদ্যোক্তাদের শুধু পারিবারিক উন্নয়ন নয়, বরং বৃহত্তর সমাজ ও জাতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তাদের সাফল্য অন্য নারীদের অনুপ্রাণিত করে এবং সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
সরকারও নারীর উদ্যোক্তা উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, যা নারী ক্ষমতায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নারী উদ্যোক্তা ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে অনেক নারী সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রকল্প নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদান করছে। বাণিজ্য মেলায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বতন্ত্র প্যাভিলিয়ন তাদের পণ্য প্রদর্শন ও বিপণনের সুযোগ বাড়াচ্ছে। একইসাথে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম প্রসারের ফলে এখন গ্রামীণ নারীও অনলাইনে ব্যবসা শুরু করতে পারছেন। তবে এসব উদ্যোগকে আরও কার্যকর ও সমন্বিত করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে ‘উইমেন বিজনেস হাব’ প্রতিষ্ঠা করা গেলে উদ্যোক্তারা নিবন্ধন, ঋণ সুবিধা, প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ ও আইনি পরামর্শ—সবকিছু এক জায়গায় পাবেন। পাশাপাশি নারীদের জন্য বিশেষ ট্যাক্স রেয়াত, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধা, আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের সুযোগ এবং স্থানীয় পর্যায়ে সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হলে গ্রামীণ নারীরাও ব্যবসায়িক সুবিধা সহজে পাবেন। এ ধরনের সমন্বিত পদক্ষেপ নারীর উদ্যোক্তা উন্নয়নকে টেকসই ও গতিশীল করে তুলতে পারে।
নারী উদ্যোক্তার ক্ষমতায়নের সামাজিক প্রভাবও বহুমুখী ও গভীর। তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভর হয়ে ওঠেন, যা পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন, যেমন—সন্তানের শিক্ষার মান উন্নয়ন, পরিবারের স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ, সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ। একজন সচেতন নারী উদ্যোক্তা সাধারণত কন্যাশিশুর শিক্ষা ও পুষ্টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমে নারীরা সমাজে নেতৃত্ব তৈরি করেন, অন্য নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনেন। এর ফলে সামাজিক সচেতনতা বাড়ে, মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে এবং লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস পায়, পরিবারগুলো স্বাবলম্বী হয়, অপরাধপ্রবণতা কমে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। তাই নারী উদ্যোক্তার ক্ষমতায়ন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তনেরও অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
সবশেষে বলা যায়, নারী উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষমতায়ন কেবল একজন নারীর ব্যক্তিগত উন্নয়ন বা আর্থিক স্বাবলম্বিতার বিষয় নয়; এটি একটি জাতির সামগ্রিক অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। নারী উদ্যোক্তার সক্রিয় অংশগ্রহণ অর্থনীতিকে বহুমুখী করে তোলে, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। তাদের উদ্যোগ দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখে, কারণ একজন নারী উদ্যোক্তার ব্যবসা সাধারণত আশেপাশের অন্য নারীদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। এর ফলে সমাজে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা সুদৃঢ় হয়।
নারী উদ্যোক্তার সাফল্য কেবল অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচক নয়, বরং এটি সামাজিক প্রেরণার উৎস। একজন নারী যখন ব্যবসায় সফল হন, তখন তার গল্প অন্য নারীদের নতুন করে স্বপ্ন দেখায়, আত্মবিশ্বাস জোগায় এবং সাহসী পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করে। এভাবে নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিটি সাফল্য সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেখানে একসময় নারীর ভূমিকাকে গৃহস্থালি কাজে সীমাবদ্ধ ধরা হতো, সেখানে আজ তারা নেতৃত্ব, উদ্ভাবন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছেন।
অতএব, নারীর ক্ষমতায়ন মানেই দেশের শক্তি ও সমৃদ্ধির নতুন অধ্যায় সূচিত হওয়া। বাংলাদেশ যদি নারী উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, তবে ‘আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন অনেকাংশেই সহজ হবে। নারীরা যত বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবেন, তত দ্রুত দেশ দারিদ্র্যমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই উন্নয়নের পথে অগ্রসর হবে।
লেখক : অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), ঢাকা। [email protected]
এইচআর/জেআইএম