কড়াইল বস্তিতে বারবার আগুন, দায় কার?
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়লো রাজধানীর সবচেয়ে বড় ঘনবসতিপূর্ণ কড়াইল বস্তি। মহাখালী-গুলশানের আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর কড়াইলের টিনের চালের জরাজীর্ণ খুপড়ি ঘরের মাঝখানে ব্যবধান শুধু একটি লেকের। তবে এই সামান্য ব্যবধানের আড়ালে লুকিয়ে আছে জীবনমানের আসমান-জমিন পার্থক্য। ক্ষমতার অশুভ আঁতাত ও বেঁচে থাকার স্বপ্ন বেচা এই বস্তির মানুষগুলো বারবার জ্বলে-পুড়ে নিঃস্ব হন। কড়াইলের মানুষদের কাছে এই অগ্নিকাণ্ড যেন আরেকবার জীবনের বিরুদ্ধে ফিরতি আঘাত। কড়াইল বস্তির আগুন যেন এক পুরনো অতিথি, অপ্রত্যাশিত সত্ত্বেও ঘুরে ফিরে আসে, রেখে যায় ছাই, কান্না আর ক্ষত। সঙ্গত কারণে কড়াইল বস্তির নিম্নআয়ের মানুষদের হৃদয়ে আঁকড়ে থাকা আতঙ্কের নাম ‘আগুন’। আগুন যেন তাদের দীর্ঘদিনের পরিচিত শত্রু, যে কখনো সতর্ক করে আসে না, শুধু সবকিছু কেড়ে নেয়। বারবার আসে এ আগুন, কিন্তু কেন আসে, কীভাবে আসে—তা থেকে যায় অজানা। বারবার কড়াইল বস্তিতে কেন আগুন?এই কড়াইল বস্তিতে কেন বারবার আগুন লাগে? কারণ কী? কে বা কারা দায়ী? আগুনের খবর পেয়েও কেন ফায়ার সার্ভিস বারবার আটকে যায় পথে? আগুনের নেপথ্যে কারও কোনো গোপন উদ্দেশ্য থাকাও কি অমূলক? সরকারেরই বা কী উদ্যোগ? এসব প্রশ
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়লো রাজধানীর সবচেয়ে বড় ঘনবসতিপূর্ণ কড়াইল বস্তি। মহাখালী-গুলশানের আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর কড়াইলের টিনের চালের জরাজীর্ণ খুপড়ি ঘরের মাঝখানে ব্যবধান শুধু একটি লেকের। তবে এই সামান্য ব্যবধানের আড়ালে লুকিয়ে আছে জীবনমানের আসমান-জমিন পার্থক্য। ক্ষমতার অশুভ আঁতাত ও বেঁচে থাকার স্বপ্ন বেচা এই বস্তির মানুষগুলো বারবার জ্বলে-পুড়ে নিঃস্ব হন। কড়াইলের মানুষদের কাছে এই অগ্নিকাণ্ড যেন আরেকবার জীবনের বিরুদ্ধে ফিরতি আঘাত।
কড়াইল বস্তির আগুন যেন এক পুরনো অতিথি, অপ্রত্যাশিত সত্ত্বেও ঘুরে ফিরে আসে, রেখে যায় ছাই, কান্না আর ক্ষত। সঙ্গত কারণে কড়াইল বস্তির নিম্নআয়ের মানুষদের হৃদয়ে আঁকড়ে থাকা আতঙ্কের নাম ‘আগুন’। আগুন যেন তাদের দীর্ঘদিনের পরিচিত শত্রু, যে কখনো সতর্ক করে আসে না, শুধু সবকিছু কেড়ে নেয়। বারবার আসে এ আগুন, কিন্তু কেন আসে, কীভাবে আসে—তা থেকে যায় অজানা।
বারবার কড়াইল বস্তিতে কেন আগুন?
এই কড়াইল বস্তিতে কেন বারবার আগুন লাগে? কারণ কী? কে বা কারা দায়ী? আগুনের খবর পেয়েও কেন ফায়ার সার্ভিস বারবার আটকে যায় পথে? আগুনের নেপথ্যে কারও কোনো গোপন উদ্দেশ্য থাকাও কি অমূলক? সরকারেরই বা কী উদ্যোগ? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে না কখনোই।
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর শুধু মোটাদাগে কারণগুলো উঠে আসে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের তদন্তে। কিন্তু তাতে আগুন লাগা বন্ধ হয়নি, নিঃস্ব হওয়া বাসিন্দারা কোমড় সোজা করে দাঁড়াতেই আবারো নিঃস্ব হন। তাদের এ করুণ পরিণতি শেষ হয়েও হয় না। এ যেন প্রশ্নের পর প্রশ্ন, কিন্তু কোনো উত্তরই শেষমেশ আগুনের কালো ছাই থেকে উঠে আসে না।
মহাখালী-বনানী-গুলশানের মতো বাণিজ্যিক-অভিজাত এলাকার মাঝখানে প্রায় ৯০ একর জায়গাজুড়ে ঘনবসতিপূর্ণ এক বস্তি কড়াইল। প্রায় লাখখানেক মানুষের বসবাস এই বস্তিতে। এখানকার বাসিন্দাদের জীবিকা দিনমজুরি, ড্রাইভিং, ভাঙারি ব্যবসা, গার্মেন্টসে কাজ, রিকশা চালানো, ছোট ব্যবসা ও হকারি ঘিরে। কর্মজীবী নারী বাসিন্দাদের অধিকাংশই ছোট দোকানি, পোশাককর্মী বা বাসা-বাড়িতে কাজ করেন।
মরতে মরতে বাঁইচ্চা আইছি। বানের জলে সব হারাইছি বরিশালে। বাপের হাত ধরে এই বস্তিতে আইছিলাম। কিন্তু এখানেও যেন শুধু বাঁইচ্চা আছি। আগে বানের জলে এখন আগুনে। গতরাতের আগুনে সব পুড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা ক্লান্ত।—বস্তির বাসিন্দা পোশাককর্মী রুবিনা আক্তার
কোনো বছর দু-তিনবারও লাগে আগুন
যেখানে আধুনিক নগর পরিকল্পনায় একজন মানুষের ন্যূনতম থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত প্রধান প্রায়োরিটি, সেখানে কড়াইল বস্তিতে গড়ে প্রতি ৪০-৫০ বর্গফুটে একজন মানুষের বসবাস শুধু মানবিক সংকটই নয়, অগ্নিকাণ্ডের জন্যও যেন প্রস্তুত এক মঞ্চ। একা একা দাঁড়ানো সেই ছোট্ট খুপড়িগুলো যেন অপেক্ষায় থাকে কখন দপ করে জ্বলে উঠবে। তারই যেন প্রমাণ দিতে হয় প্রতিবছর আগুনে। কখনো কখনো তো বছরে দু-তিনবারও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এখানকার বস্তিবাসীর এমন একটি বছরও কাটে না বেদনাহীন।
আরও পড়ুন
আগুন শুধু ঘরই না, পুড়ায় মানুষের ভরসাও
দ্রুত খাবার ও গরম কাপড় চান আগুনে ক্ষতিগ্রস্তরা
কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ড তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের কমিটি
সবশেষ মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকেল ৫টা ২২ মিনিটের দিকে কড়াইল বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের খবর জানায় ফায়ার সার্ভিস। এবারের আগুনও মুহূর্তেই ছুটে যায় গলিঘুপচিতে, ভেঙে দেয় জীবনের কোমল বন্ধন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে আগুন লাগার খবর পেয়ে মোট ১৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ শুরু করে। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ১৫ ঘণ্টা পর বুধবার (২৬ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টায় আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ সম্ভব হয়। কিন্তু ততক্ষণে জীবনের শত শত অধ্যায় পুড়ে কালো কালিতে রূপ নেয়।
কড়াইল বস্তির মূল বউবাজার এলাকার বাসিন্দা আব্বাস আলী জাগো নিউজকে জানান, বউবাজারের কুমিল্লা পট্টি, বরিশাল পট্টি ও ক-ব্লক এলাকায় আগুনের সূত্রপাত। ওই অংশে হাজারখানেক ঘর ছিল। আগুন লাগার পর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নির্বাপণে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও বাসিন্দারা বলছেন, অন্তত ১৫০০ ঘর পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া ঘর মানে শুধু টিন-কাঠের ঘরগুলোই নয়; যেন পুড়ে গেছে স্বপ্ন, স্মৃতি ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ।
বুধবার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, কড়াইল বস্তির অধিকাংশ ঘরই জোড়াতালি দেওয়া। টিন, বাঁশ, প্লাস্টিক, কাঠ, কার্ডবোর্ডে তৈরি ঘর। যেসব মূলতঃ আগুনের বা অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড দাহ্য সব উপকরণ। যা আগুনকে থামতে না দিয়ে হাত ধরে দৌড়ানোর সুযোগ করে দেয়। যেন পুরো এলাকাটিই এক বিশাল শুকনো চিতা।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, টিনসেড ঘরকেই কোথাও কোথাও দ্বিতল বা তিনতলায় রূপ দেওয়া হয়েছে। কোথাও ৫/৭টা বড় ঘর মিলে একটি করে ওয়াশ রুম ও রান্নাঘর। যেখানে পালা করে নিত্যদিন সেরে নিতে হয় গোসল, বাথরুম ও রান্নার কাজ। তবে একজন মানুষের জীবন ধারণের জন্য এমন কিছু নেই যা এই বস্তিতে মেলে না। কী বৈধ কী অবৈধ। যেন টাকা হলে সবই মেলে বস্তিটিতে। তবে বারবার আগুনের কারণে গেল বছর বস্তিতে গ্যাসের লাইন সরকারিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। এখানকার বাস্তবতা এতটাই নির্মম, যেন প্রয়োজনের চাপে মানুষ নিজের ঝুঁকি নিজেই বাড়ায়।
আগুনে সব বই-খাতা পুড়ে গেছে, এক কাপড়ে বের হইছি মায়ের লগে। স্কুল ড্রেসটাও নেই। এরমধ্যে ৭ ডিসেম্বর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা। সব এলোমেলো দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে।—স্কুল শিক্ষার্থী ইতি আক্তার
বারবার আগুন লাগার ৮ কারণ
কেন বারবার আগুন কড়াইল বস্তিতে? এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে আগুন লাগার কারণ জানতে চাওয়া হয় ক্ষতিগ্রস্তসহ বস্তি বাসিন্দাদের কাছে। তাদের কথায় উঠে আসে অন্তত আটটি কারণ। তারমধ্যে অন্যতম—প্রথমত: অস্থায়ী, ঘন, দাহ্য গঠনের অবকাঠামো। বস্তির রাস্তা প্রায় মানুষের কাঁধের চেয়েও সরু। ঘরগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব এতটাই কম যে কোথাও কোথাও দেয়ালই যেন দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে। আগুন লাগলে বাতাস তাকে পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে দেয়। একটি স্পার্কই এখানে মুহূর্তে পুড়িয়ে দিতে পারে শতশত ঘর।
দ্বিতীয়ত: অনুমোদনহীন বিদ্যুৎ সংযোগ। এখানে বেশিরভাগ বিদ্যুৎ লাইনই অবৈধ ও ঝুলন্ত তারবিশিষ্ট। সরবরাহের তুলনায় অতিরিক্ত লোড শর্টসার্কিটের মতো সম্ভাব্যতাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। যে তারের ওপর আলো জ্বলে, সেই তারই আবার মৃত্যুর আগুন নিয়ে ছুটে আসে।
তৃতীয়ত: বস্তির প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়িতেই গ্যাস সিলিন্ডার। নিরাপত্তা মানহীন সিলিন্ডার, রেগুলেটর লিক, চুলার গ্যাস জমে থাকা—এগুলো নিয়মিত বিস্ফোরণের সূত্র। এ যেন ঘরের ভেতরেই লুকানো টিকটিক বোমা।
চতুর্থত: লেক ঘেঁষে ৯০ একর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠা বস্তিটিতে সহজপ্রাপ্য পানির উৎস নেই। তারমধ্যে সরু রাস্তার কারণে ফায়ার সার্ভিসসহ জরুরি সেবার গাড়িও ঢুকতে বেগ পেতে হয়। প্রতিবারই আগুন নির্বাপণের পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়- আগুন নেভাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা পানি আর ঢুকতে সমস্যা। জীবন বাঁচাতে পানি চাই, কিন্তু সে পানি এখানে পৌঁছায় চোখের জল ঝরার পর।
পঞ্চমত: আগুনের পর বড় ফায়ার ট্রাক ঢুকতে পারে না। পানি সরবরাহের হোস পাইপও অনেক সময় ফেটে যায়। সংকীর্ণ গলি, ভাঙাচোরা পথ সব মিলিয়ে কড়াইল বস্তির আগুন যেন ফায়ার সার্ভিসের জন্যও দুঃস্বপ্ন। ফায়ার ফাইটারদের চোখেও কড়াইল এক লড়াইয়ের গহ্বর।
ষষ্ঠ কারণের অন্যতম হচ্ছে—বস্তিতে দখলদারত্ব ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার। বস্তির জমি সরকারি হলেও বছর বছর এ নিয়ে নানা সংঘর্ষ, স্বার্থ, উচ্ছেদ, পাল্টা-উচ্ছেদের ঘটনা যেন হরহামেশা। অনেকগুলো কারণের মধ্যে ভুক্তভোগীদের দাবি ও জোর সন্দেহে কারও না কারও লাভ হয় আগুনে। এই সন্দেহগুলো ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে থাকে মানুষের মনে।
সপ্তমত: সরকারি তদারকি নেই বসতিপূর্ণ বস্তিতে। একেক সময় একেক পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও আদতে বস্তির বসতি ও ঘনত্ব বেড়েছে, সেবা বা জীবনমান বাড়েনি। নিরাপত্তায় সাব-স্টেশন হয়নি, ড্রেনেজ পরিকল্পনা নেই, নেই ফায়ার হাইড্রেন্টও। পরিকল্পনার অভাবে এখানে নিরাপত্তা যেন চিরদিনের অনাথ।
ফায়ার সার্ভিসের পর্যবেক্ষক দল ও বাসিন্দাদের মতে, আগুনের ভয়াবহতা কিংবা আগুনের উৎপত্তির শুরুতেই ডিটেক্ট করতে না পারাও আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির অন্যতম কারণ। তাছাড়া দিনের বেলায় ফাঁকা আর রাত্রিকালীন ঘন জটলা। বেশিরভাগ আগুন লাগে সন্ধ্যা বা রাতে যখন রান্নার কাজ চলে, যখন কি না বিদ্যুতের চাপ বেশি। যে সময়ে ঘরগুলো জীবনের উষ্ণতায় ভরে ওঠে, ঠিক সে সময়ই আগুন সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকভাবে কড়াইল বস্তিতে আগুনের সম্ভাব্য কারণ ৩টি—১. বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, ২. গ্যাস সিলিন্ডার এবং ৩. অসাবধানতাজনিত আগুন।
বস্তিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য আগুন লাগাতে পারে। সেটার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাজনৈতিক কারণেও আগুন লাগানো হতে পারে। গোয়েন্দারা ভালো বলতে পারবেন।—ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ডিজি আলী আহমেদ খান
তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ-ও বলছেন, ঘনবসতিতে আগুন স্বাভাবিকের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়। প্রতিকার না করা হলে এটি আবারও ঘটবে। আগুনের উৎপত্তির প্রয়োজনীয় প্রমাণ পাওয়া কঠিন, কারণ ঘরগুলো সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ভুক্তভোগীদের কণ্ঠে জীবনের নীরব আর্তনাদ
কড়াইল বস্তিতে লাগা আগুনে সব হারানো মানুষদের সাক্ষ্য যেন অভিন্ন। শুধু পার্থক্য আজ বস্তির উত্তর তো কদিন বাদেই দক্ষিণে আগুন।
বস্তির বাসিন্দা পোশাককর্মী রুবিনা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মরতে মরতে বাঁইচ্চা আইছি। বানের জলে সব হারাইছি বরিশালে। বাপের হাত ধরে এই বস্তিতে আইছিলাম। কিন্তু এখানেও যেন শুধু বাঁইচ্চা আছি। আগে বানের জলে এখন আগুনে। গতরাতের আগুনে সব পুড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা ক্লান্ত।’
নিজে ড্রাইভার, স্ত্রী কিছু করেন না। এক ঘরে ৬ সদস্যের সংসার। ৯ ঘরের ভাড়া আর নিজের চাকরির টাকায় ভালোই চলছিল গিয়াস উদ্দিনের সংসার। কিন্তু আগুনই যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। গিয়াস উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৯৯৯ সালে এই বস্তিতে আসছি। এখন পর্যন্ত ২০০৪, ২০১৭, ২০২৫ সালে তিনবার আগুনে সব হারাইছি। দুইবার মরতে মরতে বেঁচে গেছি।’
জীবন যেন আগুনের সঙ্গে এক অনন্ত যুদ্ধ
১৫ বছর ধরে কড়াইল বস্তির বাসিন্দা মর্জিনা বেগম। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগুন লাগার সময় রান্না করছিলাম। স্বামী বাইরে রিকশার প্যাডলে পা চালাচ্ছিল, এদিকে আগুন। কোনো রকমে দুই মেয়ে আর ছেলে-নাতিরে নিয়ে বের হইছি।’
তিনি বলেন, ‘এবারই প্রথম, কিন্তু এটিই হয়তো শেষ, আর হয়তো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো না। একদম নিঃস্ব হয়ে গেছি।’ তার মেয়ে ইতি আক্তার বস্তির পাশেই বিদ্যাসাগর স্কুলের ক্লাস সেভেনের শিক্ষার্থী।
ইতি বলেন, ‘আগুনে সব বই-খাতা পুড়ে গেছে, এক কাপড়ে বের হইছি মায়ের লগে। স্কুল ড্রেসটাও নেই। এরমধ্যে ৭ ডিসেম্বর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা। সব এলোমেলো দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে।’
যেখান থেকে বস্তির আগুনের উৎপত্তি সেই বউবাজারের কাছের বাসিন্দা রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগুন লাগে নাকি লাগানো হয়, এটা একটা বড় প্রশ্ন। অনেকবারই তো পুড়লো বস্তি। সব আগুন আমাদের কারণে না। বস্তি বলে তদন্ত হয় না। আমাদের নিঃস্ব হওয়াতে, জীবন যাওয়াতে কার কী আসে যায়!’
আরও পড়ুন
কড়াইল বস্তির ১৫০০ ঘর-বাড়ি আগুনে পুড়েছে
শুধু পরনের পোশাকটাই আছে, বাকি সব পুড়ে ছাই: মমতাজ
হতে পারে নাশকতা
নাশকতার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স) মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুধু আজকে নয় অনেক আগে থেকে কড়াইল বস্তি নিয়ে অনেক কাহিনী রয়েছে। জায়গা দখল থেকে শুরু করে বহু কিছু রয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, ক্ষমতা দখল অনেক কিছু। ৫ আগস্টের আগে ছিল এক গ্রুপ, এখন আরেক গ্রুপ।’
রাজনৈতিক কারণেও আগুন লাগানো হতে পারে
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এলপিজি গ্যাস যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে। বস্তির ঘরগুলো খুব ঘিঞ্জি, একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। ঘরগুলো কাঠ, টিন আর কাগজের বক্স দিয়ে বানানো। যা দাহ্যবস্তু। ইলেকট্রনিক লাইনগুলো অনেক নিম্নমানের। রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের সিলিন্ডারগুলোতে আগুন লাগলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’
যেহেতু বস্তি নিয়ে সরকারের ভিন্ন পরিকল্পনা নেই, সচেতনতামূলক কার্যক্রমেও বস্তিতে আগুন বন্ধ হচ্ছে না। সরু পথ প্রশস্ত করতে হবে। পানির সরবরাহ সহজপ্রাপ্ত করতে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করতে হবে বস্তিজুড়ে। ফায়ার হাইড্রেন্ট পয়েন্টগুলো ব্যবহারে আমরা খুব সহজে আগুন কন্ট্রোলে নিয়ে আসতে পারবো। এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা চিন্তা করছি—ফায়ার সার্ভিসের ডিজি মুহাম্মদ জাহেদ কামাল
তিনি বলেন, ‘বস্তিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য আগুন লাগাতে পারে। সেটার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাজনৈতিক কারণেও আগুন লাগানো হতে পারে। গোয়েন্দারা ভালো বলতে পারবেন।’
আগুন নেভাতে দেরির কারণ ও সমাধানের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসে নতুন কোনো সদস্য কড়াইল বস্তিতে গেলে সে রাস্তা খুঁজে পায় না। এজন্য অভিজ্ঞ এবং যারা কড়াইল বস্তি সম্পর্কে জানে শুধু তারাই দ্রুত আগুন নেভাতে পারবে। কারণ, কড়াইল বস্তি সম্পর্কে তাদের ধারণা রয়েছে। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন আলাদা একটি ইউনিট ছিল কড়াইলের জন্য।’ সেখানে সাব-স্টেশন করা, ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন ও অভিজ্ঞ জনবল মোতায়েনের পরামর্শ দেন তিনি।
যানজটে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আটকেপড়ায় ক্ষতি বেশি
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেন্টেনেন্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আগুন লাগার ৩৫ মিনিট পর ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় তিনটি স্টেশনের ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট। কারণ, সড়কে অনেক যানজট ছিল। এরপরে আরও ইউনিট এলেও বড় গাড়িগুলো ঢুকতে পারেনি সরু রাস্তার কারণে। অনেক সীমাবদ্ধতায় কাজ করতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তবে এখানে পৌঁছানোর আগেই আগুন ডেভলপ স্টেজে চলে যায়। এ কারণে একটু সময় লেগেছে আগুন নিয়ন্ত্রণে। প্রথমেই আমাদের খুবই বেগ পেতে হয়েছে আগুনের সোর্সের কাছে পৌঁছাতে। ফায়ার ফাইটাররা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।’
বস্তিতে সচেতনতার অভাব
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘কড়াইল বস্তিতে গেলে দেখবেন যে ওখানে যত্রতত্র বিদ্যুতের লাইন, যার অধিকাংশই অবৈধ। বাড়িঘরগুলোও একটার পাশে আরেকটা লাগানো, ঘিঞ্জি; এমনভাবে লাগানো যে, ছোটখাটো আগুনও বড় হতে বেগ পায় না। মানে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।’
‘দ্বিতীয়ত, দিনের বেলা বাসাবাড়িতে একজন দুজন লোক থাকে। এখানে বেশিরভাগ মানুষ কাজের প্রয়োজনে বাইরে থাকে। তখন আগুন লাগলে প্রাথমিকভাবে আনডেন্টিফাই করা সম্ভব হয় না। ঝিলের পাড়ের বসতি কড়াইলের। বাসিন্দারা খুব সহজেই পার হয়ে চলে যায় বিভিন্ন জায়গায়, চাকরিতে বা কাজে। ফলে ছোট আগুনেও দেখা যায় যে এটেন্ড করতে না পারার কারণে মানে যথাসময়ে আগুনটা বড় হয়ে যায়। এছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনও বৈধ না। সঠিক ব্যবস্থাপনাও নেই। সচেতনতারও অনেক অভাব। সরবরাহের তুলনায় হিউজ অবৈধ লাইন। এছাড়া সিলিন্ডারের একটু লিকেজ থেকে বড় আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে, এই সচেতনতাটুকুও এখানে নেই।’
তিনি বলেন, ‘এখানে সচেতন হয়েও লাভটা কোথায়? সচেতন হলেও তো বস্তির বাসিন্দাদের যাওয়ার জায়গা নাই। কোথায় যাবেন তারা? ছোট্ট একটা জায়গায় কত লোক একসঙ্গে বাস করছে! আমরা যতই বুঝাই না কেন কিছুদিন পর পর আগুন সেখানে লাগছে। আমরা সেখানে মহড়া করেছি, রেডক্রিসেন্টও নিয়মিত মহড়া ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম করে। কিন্তু আলটিমেটলি দিনশেষে খুব বেশি ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।’
পানির সহজপ্রাপ্ততার জন্য জরুরি ফায়ার হাইড্রেন্ট
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল বলেন, ‘বস্তিতে আগুন লাগলে আমরা পানি পাই না, পানি পেলেও আবার গাড়ি এমন জায়গায় রাখতে হয় যা স্পট থেকে দূরে। গতকালও (মঙ্গলবার) এক কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। ফায়ার ফাইটাররাও পানি নিয়ে গিয়ে যে কাজ করবে সেক্ষেত্রেও অনেক প্রতিবন্ধকতা।’
‘যেহেতু বস্তি নিয়ে সরকারের ভিন্ন পরিকল্পনা নেই, সচেতনতামূলক কার্যক্রমেও বস্তিতে আগুন বন্ধ হচ্ছে না। সরু পথ প্রশস্ত করতে হবে। পানির সরবরাহ সহজপ্রাপ্ত করতে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করতে হবে বস্তিজুড়ে। ফায়ার হাইড্রেন্ট পয়েন্টগুলো ব্যবহারে আমরা খুব সহজে আগুন কন্ট্রোলে নিয়ে আসতে পারবো। এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা চিন্তা করছি’—যোগ করেন ফায়ারের ডিজি।
কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ড তদন্তে কমিটি
কড়াইল বস্তিতে লাগা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (অপারেসন্স অ্যান্ড মেইন্টেনেন্স) মামুনুর রশিদকে তদন্ত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, ফায়ার সার্ভিস ঢাকা জোন-২ এর উপসহকারী পরিচালক অতীশ চাকমা, তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নাজিম উদ্দিন সরকার, ঢাকা-২৩ এর ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর সোহরাব হোসেন এবং সদস্যসচিব করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামানকে।
টিটি/এমকেআর/এমএস
What's Your Reaction?