খাতুনগঞ্জে ভেঙে গেছে চিনির সিন্ডিকেট
• আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লাগাতার কমছে চিনির দাম• পাইকারিতে প্রতি মণে কমেছে ১ হাজার ১৯৫ টাকা, খুচরায় প্রতি কেজিতে ৩৫-৪০ টাকা দেশে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রিত হয় বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে। একটি বিশেষ শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল ভোগ্যপণ্যের বড় একটি অংশ। এরমধ্যে ভোজ্যতেল ও চিনি অন্যতম। বিশেষ করে চিনির মিলার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল ওই শিল্প গ্রুপের হাতে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে নানামুখী চাপে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এতে ভেঙে যায় সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটহীন হয়ে পড়ার সুফল পড়ছে চিনির বাজারে। লাগাতার কমছে চিনির দাম। খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে পাইকারি বাজারে চিনির দাম ছিল মণপ্রতি চার হাজার ৪৪০ টাকা। একই বাজারে বর্তমানে সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি তিন হাজার ২৪৫ টাকায়। প্রতি মণে কমেছে এক হাজার ১৯৫ টাকা, যা কেজিতে কমেছে ৩০ টাকার মতো। যার প্রভাব চিনির খুচরা বাজারেও পড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি খুচরায় চিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। ঠিক ২০২৪ সালের জুলাই
• আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লাগাতার কমছে চিনির দাম
• পাইকারিতে প্রতি মণে কমেছে ১ হাজার ১৯৫ টাকা, খুচরায় প্রতি কেজিতে ৩৫-৪০ টাকা
দেশে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রিত হয় বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে। একটি বিশেষ শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল ভোগ্যপণ্যের বড় একটি অংশ। এরমধ্যে ভোজ্যতেল ও চিনি অন্যতম। বিশেষ করে চিনির মিলার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল ওই শিল্প গ্রুপের হাতে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে নানামুখী চাপে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এতে ভেঙে যায় সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটহীন হয়ে পড়ার সুফল পড়ছে চিনির বাজারে। লাগাতার কমছে চিনির দাম।
খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে পাইকারি বাজারে চিনির দাম ছিল মণপ্রতি চার হাজার ৪৪০ টাকা। একই বাজারে বর্তমানে সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি তিন হাজার ২৪৫ টাকায়। প্রতি মণে কমেছে এক হাজার ১৯৫ টাকা, যা কেজিতে কমেছে ৩০ টাকার মতো। যার প্রভাব চিনির খুচরা বাজারেও পড়েছে।
বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি খুচরায় চিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। ঠিক ২০২৪ সালের জুলাই মাসে একই চিনি বিক্রি হতো প্রতি কেজি ১৩০-১৩৫ টাকা। এতে পাইকারিতে কেজিতে গড়ে ৩০ টাকা এবং খুচরায় ৩৫-৪০ টাকা কমেছে।
দেশে বছরে কমবেশি ২০ থেকে ২২ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে ৩০ হাজার টনের মতো। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় ১৫ চিনিকলে ৩০ হাজার ৮০ টন চিনি উৎপাদিত হয়েছে। অবশিষ্ট চিনি আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়।
আরও পড়ুন
১৬৪ টাকা লিটার সয়াবিন তেল ও ৯৫ টাকা কেজিতে চিনি কিনছে সরকার
ঘোষণায় বছর পার, মিল চালুর উদ্যোগ না পেয়ে বাড়ছে উদ্বেগ
চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি নিষিদ্ধ ৩৯ টন ঘনচিনি আটক
ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির জন্য তেল-ডাল-চিনি কিনছে সরকার
দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর প্রায় ৯৮ শতাংশের বেশি চিনি আমদানি করতে হয়। দেশে ব্যক্তিখাতের পাঁচ শিল্পগ্রুপ সিটি, মেঘনা, এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিল অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। পরে নিজেদের মিলে পরিশোধন করে এসব চিনি বাজারজাত করে। এরমধ্যে দেশবন্ধু সুগার মিলে নানান জটিলতায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেকায়দায় পড়ে এস আলম গ্রুপ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬০ টন চিনি আমদানি হয়। এরমধ্যে ‘র’ চিনি রয়েছে ৯ লাখ ৩ হাজার ৭২ টন এবং পরিশোধিত সাদা চিনি ৮২ হাজার ৬৮৮ টন। ‘র’ চিনির মধ্যে আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ৯ হাজার ৬৬৯ টন, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ৩ লাখ ১৬ হাজার ২৩৫ টন, দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড ৫ হাজার ৫০০ টন, মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ৫ লাখ ৩ হাজার ৬২৩ টন ও এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ৬৭ হাজার ৬৩৮ টন আমদানি করে।
‘র’ চিনির পুরোটাই আমদানি হয় ব্রাজিল থেকে। অন্যদিকে সরকারের অনুমোদন নিয়ে গত অর্থবছর রিফাইন্ড সাদা চিনি আমদানি করে কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। তাছাড়া কারখানার কাঁচামাল হিসেবেও রিফাইন্ড চিনি আমদানি হয়।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে (১ জুলাই থেকে ২৫ নভেম্বর) ‘র’ ও রিফাইন্ড মিলে ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৫১১ টন চিনি আমদানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ লাখ ৫ হাজার ৭৫১ টন বেশি। ‘র’ চিনির মধ্যে মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ৫ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৩ টন, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড ২ লাখ ৮১ হাজার ৫৫১ টন, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৪ লাখ ২১ হাজার ৪৯৬ টন এবং এস আলম সুগার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ৪৬ হাজার ১১৪ টন আমদানি করে।
ভোগ্যপণ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গিয়ে সরেজমিনে কথা হয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ২০২৪ সালের ১ জুলাই প্রতি মণ চিনির দাম ছিল চার হাজার ৪৪০ টাকা। ২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারি তা কমে হয় প্রতি মণ চার হাজার ২৪০ টাকা। চলতি বছরের ৮ জুলাই পাইকারিতে প্রতি মণ চিনির দাম দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৮০ টাকা। গত ২৭ নভেম্বর পাইকারিতে চিনির দাম ছিল তিন হাজার ২৪৫ টাকা।
খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ডিও ব্যবসায়ী বলেন, ‘চিনির দাম লাগাতার কমছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর শক্তিশালী সিন্ডিকেটগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে চিনিতে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট হতো। এখন সেই সিন্ডিকেট ভেঙে গেছে। চিনির দাম যেভাবে কমছে, তাতে বাজারে কেজিপ্রতি ৬০-৭০ টাকায় চলে আসবে।’
আরও পড়ুন
নাটোরে বকেয়া পরিশোধের দাবিতে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ
দরপত্র ছাড়াই ১১৫ টাকা কেজি দরে চিনি কিনছে সরকার
চিনিতে লোকসান, মদ বেচে ১৯০ কোটি টাকা মুনাফা কেরুর
৩১০ বস্তা ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ৩
বৃহস্পতিবার বিকেলে কথা হয় খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘চিনির বাজার একেবারেই মন্দা। খাতুনগঞ্জে চিনি মণপ্রতি ৩২৪০-৩২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত একমাসে প্রতি মণে ১০০ টাকার বেশি কমেছে। এক বছরের তুলনায় মণপ্রতি এক হাজার টাকার বেশি কমেছে।’
খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী শাহজাহান বাহাদুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেড় বছর ধরে চিনির দাম লাগাতার কমছে। বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি কেজি ৮৭ টাকার মতো দাম পড়ছে। গত বছরের মাঝামাঝি পাইকারিতে ১১৮-১২০ টাকা ছিল। এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দাম আরও কমবে।’
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম কমছে। চিনির দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কমেছে। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ব্যবহার কমে যাওয়ায় পণ্যের দাম কমছে।’
এদিকে পাইকারি বাজারের মতো খুচরা দোকানেও কমেছে চিনির দাম। ২০২৪ সালের ১ জুলাই খুচরায় প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হতো ১৩০-১৩৫ টাকা, ২০২৫ সালের জানুয়ারির শুরুতে একই চিনি বিক্রি হয় কেজি ১২০-১২৫ টাকায়। চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ১১০-১১৫ টাকা। বর্তমানে বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১০০ টাকা কেজিতে।
জানতে চাইলে নগরীর কাজীর দেউরি এলাকার খুচরা দোকানি কুমকুম স্টোরের মালিক দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত সরকারের আমলে ১৫০ টাকা কেজিতে চিনি বিক্রি করেছি। এখন ধীরে ধীরে কমে একশ টাকার নিচে চলে এসেছে। আমরা এখন খোলা চিনি ৯৫ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি।’
আরও পড়ুন
প্রস্তুতি ছাড়াই পরিত্যক্ত চিনিকল চালুর উদ্যোগ
হাজার কোটি টাকার তেল-ডাল-চিনি কিনছে সরকার
বিষাক্ত হাইড্রোজ ও গো-খাদ্যের চিনি দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড়
নাটোর সুগার মিলে ৫ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা
কাজীর দেউড়ি সিডিএ মার্কেটের মুদি ব্যবসায়ী মেসার্স জীবন গ্রোসারির স্বত্বাধিকারী মো. নোমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাইকারিতে কমলে খুচরায়ও কমে যায়। পাইকারিতে ওঠানামা করলে সে প্রভাব পড়ে না। চিনির ক্ষেত্রে পাইকারিতে সাড়ে চার হাজার টাকার চিনি তিন হাজার ২৫০ থেকে তিন হাজার ৩০০ টাকায় নেমেছে। বাজার কমে যাওয়ায় বড় মিলাররা প্যাকেটজাত চিনির দামও কমিয়েছে। এখন প্যাকেট চিনি ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। প্যাকেটের গায়েও ১০০ টাকা লেখা।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা সত্যি যে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানান ধরনের সিন্ডিকেট রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালনের পর থেকে চিনির বাজারের সিন্ডিকেট ভেঙে গেছে। যার সুফল ভোক্তারা পাচ্ছে। গত দেড় বছরে চিনির দাম ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এখন যারা চিনির ব্যবসা করছেন তারা ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন।’
তিনি বলেন, ‘চিনির দাম কমে যাওয়ার মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার ব্যবসায়ীরা চাইলে সব ধরনের পণ্যের দাম কমানো সম্ভব। চিনি বাদেও ভোজ্যতেল, চাল, ডাল, পেঁয়াজের সিন্ডিকেটও ভেঙে দেওয়া উচিত। এতে সাধারণ ভোক্তারাই উপকৃত হবেন।’
এমডিআইএইচ/এমএমএআর/এমএফএ/এমএস
What's Your Reaction?