খুঁড়িয়ে চলছে সাফারি পার্ক, নানা অব্যবস্থাপনায় বিমুখ দর্শনার্থীরা

9 hours ago 6

অনেকটা খুঁড়িয়ে চলছে গাজীপুরে অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ, জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ গাজীপুর সাফারি পার্ক। নানা অব্যবস্থাপনা, একের পর এক প্রাণীর মৃত্যু, সড়কের বেহাল দশাসহ নানা কারণে পার্কে ক্রমাগত কমছে দর্শনার্থী। ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে সাফারি পার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা যেন ফিকে হয়ে গেছে। বিনোদনপ্রেমীরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নে ইন্দ্রপুর অবস্থিত পার্কটি ৪ হাজার ৯০৯ একর ভূমির মধ্যে ৩ হাজার ৮১৯ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা সাফারি পার্ক ছোট ছোট টিলা ও শালবন সমৃদ্ধ। থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ডের অনুকরণে তৈরি সাফারি পার্কটি ২০১৩ সালে চালু করা হয়। এই সাফারি পার্কের অন্যতম আকর্ষণ কোর সাফারি। পুরো পার্কটি স্কয়ার, কোর সাফারি পার্ক, বায়োডাইভার্সিটি পার্ক, সাফারি কিংডমস ৫টি অংশে বিভক্ত। ঢাকা ও আশপাশ থেকে সারাদিন পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়াবার জন্যে সাফারি পার্ক হতে পারে আদর্শ জায়গা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও অব্যবস্থাপনার অভাবে বহু স্থাপনা নষ্ট ও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী মারা যাওয়াসহ রোগা হয়ে পড়ছে অনেক প্রাণী। এতে দিন দিন কমছে দর্শনার্থীর সংখ্যা। সংকট উত্তরণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পর্যটক, দর্শনার্থী ও স্থানীয়রা।

জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় পার্কটিতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এর মূল ফটক শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, প্রাণী জাদুঘর, পাখিশালা, পার্ক অফিসসহ বিভিন্ন খাদ্যের দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়। লুটপাট করা হয় খাদ্য বিক্রির দোকানের মালামাল, বৈদ্যুতিক মোটর, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, চেয়ার, টেবিলসহ নানা সরঞ্জাম। ভাঙচুরে পার্ক অফিসের সবকটি কক্ষের জানালার কাচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাঙা হয় রেস্ট হাউসের জানালার কাচ ও পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত দুটি জিপ গাড়ি। এই ঘটনার ৩ মাস ৯ দিন পর দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় গাজীপুর সাফারি পার্ক।

সরেজমিন দেখা গেছে, পার্কে জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, বাঘ, ভালুক, সিংহ, হরিণ, লামচিতা, শকুন, কচ্ছপ, রাজধনেশ, কাকধনেশ, ঈগল, সাদা বক, রঙিলা বক, সারস, কাস্তেচরা, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বনগরু গুঁইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, খ্যাঁকশিয়াল, বনরুইসহ প্রায় শতাধিক প্রজাতির প্রাণী থাকার কথা থাকলেও তা নেই। পার্কে বর্তমানে ১টি জিরাফ, ৪২টি জেব্রা, ১১টি ওয়াইলবিষ্ট, ৭টি বাঘ, ৪টি সিংহ, ২২টি ভালুক, ২ শতাধিক হরিণ, ১১টি গয়াল, ৯টি নীলগাই, ৫টি সাম্বার হরিণ, ৩টি কমন ইলন, ১৫টি মায়া হরিনসহ হাতি, ঘোড়া, মেকাউ, ময়ূর, ময়না, শকুন, ধনেশ, মদনটাক, প্যালিকেনসহ কয়েক প্রজাতির প্রাণী, পাখি, সরীসৃপ রয়েছে। এ ছাড়া দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে শিশু পার্কসহ অনেক স্থান একেবারেই বন্ধ রাখা হয়েছে।

ভেতরে কোর সাফারির ৪ কিলোমিটার সড়কে বিশেষ বাসে চড়ে বাঘ, সিংহ, ভালুকসহ বিভিন্ন আফ্রিকান প্রাণী পর্যবেক্ষণ করেন দর্শানার্থীরা। ওই সড়কের তিন কিলোমিটার কাদা-জল আর খানাখন্দে ভরে গেছে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে স্থানে দেবে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ আর গভীর খাদের। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই দর্শনার্থী বহন করে থাকে বাসগুলো। মূলত এসব প্রাণীগুলো দেখতে বা বাচ্চাদের দেখাতে পরিবারসহ বিভিন্ন জেলা থেকে দর্শনার্থীরা আসেন সাফারি পার্কে। কিন্তু এখানে এসে প্রতিনিয়ত হতাশ হচ্ছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্কে যেমন প্রাণী মৃত্যু হচ্ছে তেমনই দেওয়া হচ্ছে রাজস্ব ফাঁকি। অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে একের পর এক প্রাণীর মৃত্যু, ভেতরে নোংরা পরিবেশে, ঘাস বড়সহ গজারি গাছে লতাপাতা পেঁচিয়ে এক ভূতুড়ে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই পার্কে চলতি বছরের গত ১৬ জানুয়ারি দেয়াল টপকে পালিয়ে যায় একটি নীলগাই। এর আগে ২০২১ সালেও একটি নীলগাই পালিয়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর পার্কে একটি সিংহ ও একটি ওয়াইল্ডবিস্ট মারা যায়। ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর মারা যায় একটি জিরাফ। ২০২১ সালে পার্কে তিনটি ক্যাঙাররু মারা যাওয়ার পর থেকে ক্যাঙারুশূন্য হয়ে যায় কোর সাফারি। এ ছাড়া লেকগুলো একসময় ব্ল্যাক ও হোয়াইট সোয়ানে পরিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে একটিও নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্কের একজন কর্মচারী জানান, পার্কে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চলছে দীর্ঘদিন। পূর্বে পার্কটির বিভিন্ন প্রকল্প ইজারা দিয়েছিলেন। সরকার পতনের পর থেকে তারা পলাতক। প্রবেশগেটে দলবদ্ধভাবে ঘুরতে আসা স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানুষ এলে ৩০-৪০ জনের টিকিট কেটে বাকি টিকিটের টাকা হদিস থাকে না। পার্কে সিকিউরিটি, টিকিটম্যানসহ বনের লোকদের যোগসাজশে ভেতরে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে চুক্তি করে গাইড পরিচয় দেওয়া এক শ্রেণির দালাল। পার্কে প্রবেশে ফি ছাড়া দর্শনার্থীদের প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে মাথাপিছু ফের কাটতে হয় টিকিট। কিন্তু ওই দালালরা ৯টি স্থান ৪০০ টাকায় ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে চুক্তি করে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। অথচ ওই ৯টি স্থান ঘুরতে প্রতি দর্শনার্থীর গুনতে হতো প্রায় ৮০০ টাকার মতো। এভাবে হচ্ছে রাজস্ব ফাঁকি।

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা মিনহাজ বলেন, পার্কের মধ্যে অনেক কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। হরিণে বেষ্টনীতে খাবার নেই, ঘোড়াটা শুকিয়ে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে দায়িত্বে থাকারা পশু-প্রাণীগুলোর স্বাস্থ্যে বিষয়ে অবহেলা করছেন। এ ছাড়া দর্শনীর্থীদের বসার কোনো জায়গা নেই, ওয়াক ওয়েগুলো ভালো না। এটাকে যদি পরিচর্যা ও প্লানিং করা যায়, আরও সুন্দর করে বনায়ন করা যায় তাহলে হয়তো দর্শনার্থী বাড়বে।

অন্য দর্শনার্থী শহীদুল ইসলাম বলেন, সুন্দর একটা পরিবেশ উপভোগ করার জন্য এখানে আসে। কিন্তু এখানে প্রতিটি প্রাণী দেখেই মনে হচ্ছে অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। যেভাবে থাকা দরকার সেভাবে নেই। ভেতরে একটি মাত্র বাঘ দেখলাম, তাও রোগা হয়ে রয়েছে। অনেক পাখি দেখলাম নেই। খাঁচা আছে, পাখি নেই। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, কার্প মাছগুলো (রঙিন মাছ) সেখানে পানি ঘোলা হয়ে কতগুলো কচুরিপানা পড়ে রয়েছে। যতটুকু দেখে মনোমুগ্ধ হওয়া উচিত সেটা এই পার্কে নেই।

পার্কের গেটের বাইরে ভাতের হোটেলের মালিক আবুল কালাম বলেন, বর্তমানে পার্কে দর্শনার্থী আসে না বললেই চলে। শুধু শুক্রবার কিছু মানুষ আসে। অন্যান্য দিন মাঝে মধ্যে দোকান বন্ধও রাখতে হয়। ব্যবসা একেবারে মন্দা, পরিবার নিয়ে চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কারণ একবার যারা ঘুরে যায়, তারা তো আসেই না; বরং পরিচতদের আসতে নিরুৎসাহিত করে। যার কারণে প্রতিদিন কমছে দর্শনার্থী।

দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, পার্কের কিছু সংস্কার করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পার্ক নিয়মিত খোলা রয়েছে। পার্কের মূল ফটকসহ বিভিন্ন অংশের ইজারা প্রক্রিয়াধীন। চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় পার্কের কার্যক্রম চলমান থাকবে। পার্কের অনুকূল পরিবেশে বিভিন্ন পশুপাখি প্রজনন করছে। পার্কের স্বকীয়তা ধরে রাখতে আমরা প্রাণবন্ত চেষ্টা করছি। পার্কের সমস্যাগুলোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) শারমীন আক্তার কালবেলাকে বলেন, পার্কের রাস্তার বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে চাহিদাপত্র (ইস্টিমিট) দিতে বলা হয়েছে। এটা পেলেই দরপত্র আহ্বান করে দ্রুত সময়ে বেহাল রাস্তার সংস্কার করা হবে।

Read Entire Article