মরুর দেশের খেজুর চাষে কপাল খুলেছে আব্দুল মোতালেবের। এক সময়ের মাটির ঘর হয়েছে দ্বিতল ভবন। কিনেছেন কয়েক বিঘা জমি। যার মূল্য কোটি টাকার বেশি। তাকে নিয়ে উপহাস করা মানুষও এখন ‘কোটিপতি খেজুর মোতালেব’ নামে ডাকেন। তার সফলতায় খেজুর চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে।
আব্দুল মোতালেবের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের পাড়াগাঁও গ্রামে। দুই দশক তিনি নিজের গ্রামে গড়ে তুলেছেন খেজুর বাগান। তার সফলতা দেখে কয়েক বছরে উপজেলায় বেশ কয়েকটি ছোট-বড় খেজুর বাগান গড়ে উঠেছে।
এক সময়ের মাটির ঘর হয়েছে দ্বিতল ভবন। কিনেছেন কয়েক বিঘা জমি। যার মূল্য কোটি টাকার বেশি। তাকে নিয়ে উপহাস করা মানুষও এখন ‘কোটিপতি খেজুর মোতালেব’ নামে ডাকেন। তার সফলতায় খেজুর চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে।
শুরুটা সহজ ছিল না আব্দুল মোতালেবের। এক সময় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাটির ঘরে বসবাস করতেন। একটু সুখের আশায় পরিবার-পরিজন ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদি আরবে। সেখান থেকে খেজুর চাষাবাদের কৌশল রপ্ত করেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে খেজুরসহ চারা বিক্রি করে সফল হবেন- এমন আশায় সৌদি থেকে খেজুরের বীজ নিয়ে এসে বাগান গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে সেই আশা বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
যদিও খেজুর বাগান করার ইচ্ছায় শুরুতে মোতালেব গ্রামে হাসি-তামাশার পাত্র হয়েছিলেন। সৌদি খেজুর বাংলাদেশে ফলানো হবে। চারা বিক্রি করে সফলতা পাবেন- মোতালেবের এমন আত্মবিশ্বাস দেখে এলাকায় ‘পাগল মোতালেব’ হিসেবে পরিচিতি পান। তবে ধীরে ধীরে চিত্র পাল্টে যায় চিত্র। বর্তমানে তার বাগানে উৎপাদিত চারা যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। বিক্রি হচ্ছে সুস্বাদু খেজুর। এক সময় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাটির ঘরে বসবাস করলেও খেজুর বাগান থেকে আয়ের টাকায় দ্বিতল ভবনের বাড়ি করেছেন। কিনেছেন কয়েক বিঘা জমি। যার মূল্য কোটি টাকার ওপরে। সফলতা পাওয়ায় তিনি বর্তমানে কোটিপতি খেজুর মোতালেব নামে পরিচিত। মরুভূমির উত্তপ্ত আবহাওয়ায় উৎপাদিত ফলকে এদেশে চাষ করে মোতালেবের ব্যাপক সাফল্য দেখে এ অঞ্চলের অনেক বেকার যুবকরাও এখন সৌদি আরবের খেজুর চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
- আরও পড়ুন
- হারিয়ে যাচ্ছে দেশি ফল ‘খেজুর’
- খেজুরের বীজ থেকে শাহিনের অভিনব ‘কফি’ উদ্ভাবন
- খেজুর চাষে সফল দিনাজপুরের জাকির
জানা যায়, আব্দুল মোতালেব সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ১৯৯৮ সালে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিন বছর খেজুর বাগানে কাজ করেন। এ সময় তিনি মাতৃভূমিতে খেজুর চাষের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী ২০০১ সালের শেষ দিকে উন্নত জাতের খেজুরের প্রায় ৩৫ কেজি বীজ নিয়ে আসেন। বাড়ির আঙিনায় দুই বিঘা জমিতে রোপণ করেন ২৭৫টি চারা। কিন্তু সে গাছে খেজুর হয়নি। আবার চারা লাগালে আবারও একই অবস্থা। তৃতীয় দফায় দুটি গাছে খেজুর হয়। ধীরে ধীরে সাতটি মাতৃগাছ পাওয়া যায়। বাকিসব গাছ থেকে কাটিং করে চারা উৎপাদন শুরু করেন। হতাশা কাটিয়ে সফলতা দেখা দেয়। প্রায় আড়াই দশকে মোতালেবের সাফল্যের পাল্লা ভারী হয়েছে। বর্তমানে মোতালেবের সাতবিঘা খেজুর বাগানে তিন হাজারের বেশি সৌদি আরবের আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, লিপজেল ও মরিয়ম জাতের খেজুরগাছ রয়েছে। তার বাগান থেকে বছরে এখন আয় ৫০ লাখ টাকার বেশি।
বর্তমানে মোতালেবের সাতবিঘা খেজুর বাগানে তিন হাজারের বেশি সৌদি আরবের আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, লিপজেল ও মরিয়ম জাতের খেজুরগাছ রয়েছে। তার বাগান থেকে বছরে এখন আয় ৫০ লাখ টাকার বেশি।
এছাড়া দেশি ও বিদেশি জাতের চারা ক্রস করে রসের জন্য আরও সাতবিঘা জমিতে প্রায় ৮ হাজার গাছ নিয়ে নতুন একটি বাগান করেছেন মোতালেব। গুড় উৎপাদনের উদ্দেশ্যে এ বাগানটি গড়ে তোলা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাগানের গাছে গাছে ঝুলছে নানা জাতের খেজুর। ছোট গাছের খেজুর মাটিতে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বড় গাছের খেজুরগুলো পাড়তে গাছের সঙ্গে লোহার মই আকৃতির বানানো হয়েছে। বাগানের কর্মচারী এটি ব্যবহার করে গাছে উঠে খেজুর নামাচ্ছেন। বাগান যারা দেখতে আসছেন, তাদের বিনামূল্যে খেজুর খাওয়াচ্ছেন মোতালেব। দেশের মাটিতে সুমিষ্ট জাতের খেজুরের স্বাদে মুগ্ধ সবাই। নয়ন জুড়ানো বাগান গড়ায় প্রশংসা কুড়াচ্ছেন মোতালেব।
স্থানীয়রা জানান, লোকে বিদেশে গেলে সুটকেস-ভর্তি জিনিস নিয়ে আসে। আর মোতালেব খেজুরের বীজ নিয়ে আসেন। এতে স্থানীয় লোকজন হাসাহাসি করতো। অনেকে তাকে পাগল বলতো। কারণ, মানুষের মধ্যে ধারণা ছিল- খেজুর সব মাটিতে হয় না। কিন্তু এ ধারণা ভুল হিসেবে প্রমাণ করেছেন মোতালেব। খেজুরের চারা বিক্রি করে ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করেছেন। তার সফলতা দেখে শিক্ষিত বেকার তরুণ-যুবকরাও খেজুর বাগান করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
মোতালেবের এমন সাফল্য দেখে খেজুর বাগান গড়ে তুলেছেন পাড়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা আফাজ পাঠান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মোতালেবের কাছ থেকে চাষ প্রযুক্তি শিখে ২০০৮ সালের শেষের দিকে দুই বিঘা জমিতে বীজ বপন করি। সে বছরই ৬ হাজার চারা হয়। এরমধ্যে মাতৃগাছ পাওয়া যায় ১৩০টি। এগুলো থেকে কাটিং করে বর্তমানে মাতৃগাছ আছে ৩ হাজার ৫০০টি। এছাড়া অন্য গাছ আছে আরও ৫০০টি।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ১০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছি খেজুর বাগান। খেজুর ও চারা বিক্রি করে বছরে ৩০ লাখের বেশি টাকা আয় হচ্ছে।’
শফিউল্লাহ আনসারি নামের একজন বলেন, ‘মোতালেব পড়ালেখা করেনি। তিনি মূলত কৃষক। সৌদি আরব গিয়েও কৃষিকাজ পেয়েছিলেন। এ কৃষক সৌদির খেজুর চাষে আলোড়ন তুলবেন। এটি কেউ ভাবতে পারেনি।
মোতালেবের বাগানের শ্রমিক মো. সুজন মিয়া বলেন, ‘এখানে উৎপাদিত খেজুরগুলো তুলনামূলক বড় ও খেতে সুস্বাদু। স্বাদে-গন্ধে সৌদির খেজুরের সঙ্গে ভিন্নতা নেই। খেজুর বিক্রি করে নয়, মোতালেবের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে মূলত চারা বিক্রি করে। আমি বাগান পরিচর্যা করাসহ চারা বিক্রির সময় গাড়িতে চারা উঠিয়ে দেওয়া ও অন্যান্য কাজ করি। যে টাকা বেতন পাই, তাতে পরিবারের ঠিকমতো ভরণপোষণ করা যাচ্ছে।’
মোতালেব নিজে পড়ালেখা না করতে পারলেও ছেলেকে করাচ্ছে পড়ালেখা। অনার্স প্রথম বর্ষ পড়ুয়া মোতালেবের ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘পড়ালেখার পাশাপাশি ২০২৩ সাল থেকে খেজুরবাগানে কাজ করছি। আমি খেজুর গাছে কাটিং করে নতুন চারা উৎপাদন কৌশল শিখেছি। এছাড়া দেশি ও সৌদি খেজুরগাছ ক্রস করে একটি জাত উদ্ভাবন করেছি। যেটি থেকে প্রচুর রস উৎপাদন সম্ভব। এর মাধ্যমে গুড় উৎপাদন করা যাবে।’
কথা হয় সফল খেজুর চাষি আব্দুল মোতালেবের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গাছে প্রথম খেজুর ধরেছে ২০০৬ সালে। এরপর থেকে চারা বিক্রি শুরু হয়। বীজের চারা এক হাজার থেকে আট হাজার টাকায় বিক্রি করি। তবে বীজের চারার গ্যারান্টি নেই। কাটিং করা প্রতিটি কলমের চারা ১৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকায় বিক্রি করি। এ চারা বিক্রি করার সময় অনেককে স্ট্যাম্পে লিখিত দেই। কারণ, এ চারা মরে না। বাংলাদেশের যে কোনো জায়গার যে কোনো মাটিতে সৌদি খেজুর লাগালে হবে। তবে মেয়ে গাছ হতে হবে। বছরে একেক গাছে ৫০-৬০ কেজি খেজুর পাওয়া যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশজুড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সৌদি আরবের খেজুরের চাষ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মুকুল আসে এবং জুন-জুলাই-আগস্টে ফল পাকে। বছরে খেজুর ও চারা বিক্রি করে ৫০ লক্ষাধিক টাকা আয় হচ্ছে। পূর্ণ বয়স্ক গাছে ২৫০ কেজি খেজুর ধরে। আজোয়া জাতের খেজুর প্রতি কেজি তিন হাজার টাকা, আম্বার প্রতি কেজি দুই হাজার ৫০০ টাকা, শুক্কারি এক হাজার টাকা, লিপজেল সাড়ে চার হাজার ও মরিয়ম খেজুর ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। এছাড়া বিক্রি হয় খেজুরের চারাও।’
সৌদি খেজুর চাষের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার কথা জানিয়ে উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘খেজুর চাষের ক্ষেত্রে পুরুষ ও মাতৃগাছের চারা নির্বাচনে অনেকের সমস্যায় পড়তে হয়। এজন্য সতর্কতার সঙ্গে চারা নির্বাচন করতে হয়। বীজ থেকে তৈরি চারায় প্রকৃত জাতের গুণাগুণ থাকে না বা কম থাকে। এ কারণে কাটিং করা চারা বেশি বিক্রি হয়। খেজুরের চারায় রোগবালাই খুব কম হয়। আমরা মোতালেবের মতো উদ্যোক্তাদের নিয়মিতভাবে পরামর্শ দিয়ে থাকি। তবে সরাসরি কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে খেজুরবাগানে আমরা কোনো সহযোগিতা দিতে পারি না। সরকারিভাবে প্রকল্প নিয়ে কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসলে তারা উপকৃত হবেন ও চাষি বৃদ্ধি পাবে।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘খেজুরবাগানটি দেখতে গিয়েছিলাম। তখন বাগানের খেজুর খেয়েছি। স্বাদ সৌদির খেজুরের মতোই। বাজারে সৌদির খেজুরের দাম বেশি। তাই মোতালেবের বাগানের চারার মাধ্যমে দেশে পর্যাপ্ত খেজুর বাগান গড়ে উঠলে এবং প্রচুর খেজুর উৎপাদন হলে দেশ উপকৃত হবে। সৌদি খেজুর চাষের সম্প্রসারণ ও প্রণোদনার মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরির পরিকল্পনার বিষয়টি নিয়ে কেবিনেট মিটিংয়ে উত্থাপন করা হবে।’
কামরুজ্জামান মিন্টু/আরএইচ/জিকেএস