গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সহযোগী পুলিশ সদস্যরা বহাল তবিয়তে

1 month ago 8

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে উত্তাল হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা। স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে অলিগলি। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে তাদের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও তাদের সহযোগী পুলিশ সদস্যরা।

দেশীয় অস্ত্র ছাড়াও সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। সেইসঙ্গে পুলিশও বলপ্রয়োগের পাশাপাশি নানাভাবে হেনস্তা করে শিক্ষার্থীদের। এতে দিনমজুর, কিশোর, শিক্ষার্থীসহ ১০ জন শহীদ হন। অনেকেই হারান দৃষ্টিশক্তি। কেউ কেউ চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এসব পুলিশ সদস্যদের অনেকেই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বা আওয়ামী লীগের সুপারিশে নিয়োগ পান।

সেই জুলাই যোদ্ধাদের স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নেওয়া পুলিশ সদস্যরা এখনো বহাল তবিয়তে আছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে (সিএমপি)। এখনও তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা ও ইউনিটে কর্মরত।

যারা জুলাই যোদ্ধাদের বুক বুট, লাঠি আর গুলিতে ঝাঁঝরা করেছেন, যাদের আঘাতে অনেক শিক্ষার্থী আজও কাতরাচ্ছেন, সেই তারাই আমাদের শহরে এখনও দাম্ভিকতা নিয়ে ঘুরছেন। - শিক্ষার্থী

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা বলছেন, এটি শুধু জুলাইয়ের চেতনায় কুঠারাঘাতই নয়, শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানিও। যারা জুলাই যোদ্ধাদের বুক বুট, লাঠি আর গুলিতে ঝাঁঝরা করেছেন, যাদের আঘাতে অনেক শিক্ষার্থী আজও কাতরাচ্ছেন, সেই তারাই আমাদের শহরে এখনও দাম্ভিকতা নিয়ে ঘুরছেন। সুযোগের অপেক্ষায় তারা ঘাপটি মেরে আছেন প্রশাসনে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে নগরের কোতোয়ালি থানার আন্দরকিল্লা, চেরাগী পাহাড়, নিউ মার্কেট, লালদিঘি, আদালত চত্বর, রেলস্টেশন এলাকায়। এছাড়া নগরের টাইগারপাস, দুই নম্বর গেট, ষোলশহর, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট এলাকাগুলো আন্দোলনের হাব ছিল।

চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীরা গত বছরের ৬ জুলাই আন্দোলনে নামেন। এরপর থেকে চলা টানা আন্দোলনে পুলিশি বাধাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। কোতোয়ালি, চান্দগাঁওসহ বিভিন্ন থানার কিছু পুলিশ সদস্য শিক্ষার্থীদের মিছিল থেকে ধরে নিয়ে মারধর করেন। প্রতিটি কর্মসূচিতে বাধা দেন। কোনো কোনো জায়গায় যুবলীগ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেন পুলিশের সদস্যরা।

শুধু তাই নয়, দোসরদের সহায়তায় অলি-গলি থেকে শিক্ষার্থীদের টেনে-হিঁচড়ে প্রিজনভ্যানে তোলে পুলিশ। এছাড়া আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অনবরত লাঠিপেটা করতেও দেখা যায় কোটাবিরোধী আন্দোলন দমনে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের।

গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সহযোগী পুলিশ সদস্যরা বহাল তবিয়তে

অভিযোগ আছে, আন্দোলনের সময় নগর পুলিশের দক্ষিণের উপকমিশনার (ডিসি) মোস্তাফিজুর রহমান ও ডিসি সদর মো. আব্দুল ওয়ারীশের নেতৃত্বে নগরে এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ভূমিকায় ছিলেন, কোতোয়ালি থানার সহকারী কমিশনার (এসি) অতনু চাকমা। আর তার নির্দেশে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবায়দুল হক, উপপরিদর্শক (এসআই) অর্ণব বড়ুয়া, এএসআই রণবেশ, পেট্রোল ইন্সপেক্টর মো. আলমগীর আন্দোলন দমনে ব্যস্ত ছিলেন। চান্দগাঁও থানার ওসি জাহিদুল কবির, ওই থানার সেকেন্ড অফিসার এমদাদ হোসেনও শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে বেধড়ক পেটান। তবে এমদাদ হোসেন বর্তমানে ডিএমপিতে। কর্ণফুলী থানার বিতর্কিত সেকেন্ড অফিসার নুরুল ইসলাম বর্তমানে বায়েজিদ থানায় সেকেন্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত। কোতোয়ালির এসআই আলমগীর বর্তমানে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগে আর চান্দগাঁও থানার সাবেক ওসি জাহিদুল কবির নৌ-পুলিশে আছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।

শিক্ষার্থীকে মারধর, হেনস্তার জন্য আলোচনায় আসেন কোতোয়ালির এসআই বোরহান, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। গণমাধ্যমের বিভিন্ন ফুটেজে তাকে শিক্ষার্থীদের ওপর আগ্রাসী আচরণ করতে দেখা গেছে। একটি ছবিতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীর জামার কলার ধরে মারধর করতে থাকেন এসআই বোরহান। তার মারমুখী ভূমিকায় ওই সময় গণমাধ্যমকর্মীরাও স্তব্ধ হয়ে পড়েন।

এছাড়া এসআই সাইফুল ইসলাম বাকলিয়া থানায়, এসআই শেখ সাদি, বাহার, মোশাররফ হোসেন আদীব, খায়রুল ইসলাম ও আজিজুল ইসলাম কোতোয়ালি থানায়, মো. মেহেদী হাসান ও মুমিনুল ইসলাম পুলিশ লাইন্সে আছেন।

২৯ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় এলাকায় মিছিলে বাধা দেন এসআই বোরহানসহ ওপরে উল্লিখিতরা। এদের মধ্যে কয়েকজন বাকলিয়াসহ আশপাশের থানায় বদলি নিয়ে চট্টগ্রাম শহরেই আছেন।

চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার এসআই বোরহান ও এএসআই রণবেশ বহু শিক্ষার্থীকে মারধর করেছিলেন। শিবির ট্যাগ দিয়েই মারতেন তারা। এই দুজনের অতিউৎসাহী ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। - শিক্ষার্থী আদনান ওয়াজেদ

আদনান ওয়াজেদ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, কোতোয়ালির এসআই বোরহান ও এএসআই রণবেশ বহু শিক্ষার্থীকে মারধর করেন। বিশেষ করে শিবির ট্যাগ দিয়েই মারতেন তারা। এই দুজনের অতিউৎসাহী ভূমিকায় পেশাদারত্ব নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে তেমনি সমালোচিতও হয়েছেন।

জানা যায়, পুলিশ সদস্যদের হাতে শিক্ষার্থীদের মারধরের একাধিক ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মারধর, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ, টেনে-হিঁচড়ে গ্রেফতার ও আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দেখা গেছে। নগর পুলিশের ডবলমুরিং থানার এসআই আহলা ইবনে জামিল ও এএসআই হিরুও ছিলেন মারমুখী। সদরঘাট থানার এসআই আকতার হোসেন ৪ আগস্ট সিটি কলেজ এলাকায় এবং ওসি ফেরদৌস জাহানসহ পুলিশ সদস্যরা সিটি কলেজের ভেতরে ঢুকে আশ্রয় নেওয়া শিক্ষার্থীদের অতর্কিতভাবে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর এসআই আকতারের নেতৃত্বে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররাও হামলা করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর।

এদের মধ্যে মোশাররফ হোসেন আদীব সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে গিয়ে নিজেই আহত হয়েছেন। এএসআই হিরু নগর পুলিশের পশ্চিম জোনে আট বছরের বেশি কর্মরত। পতেঙ্গা থানার সেকেন্ড অফিসার সাইদুল ইসলাম, এসআই নোমান, সৈয়দ আলম (বাকলিয়া থানা), আকবরশাহ থানার এএসআই আমিনুল ইসলামও আছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি আগ্রাসীদের তালিকায়। এরা প্রত্যেকে এখনও সিএমপিতে কর্মরত।

গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সহযোগী পুলিশ সদস্যরা বহাল তবিয়তে

জুলাইয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়েও কোনো ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি তাদের। ডবলমুরিং থানার এসআই আহলা ইবনে জামিল ৫ আগস্টের পর ঢাকায় বদলি হলেও সেখানে যোগ দেননি। পরে অদৃশ্য কারণে একই থানার আওতায় আগ্রাবাদ ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পান সিএমপিতে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকা এই পুলিশ কর্মকর্তা।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছরে এসে জুলাই যোদ্ধারা বলছেন, যারা জুলাইয়ে বোনদের শ্লীলতাহানি করতেও দ্বিধা করেনি, আন্দোলনের সঙ্গীদের জীবন কেড়ে নিয়েছে, এখনও ঘরে ঘরে মায়েদের আহাজারি থামেনি, যারা টুঁটি চেপে ধরে বলেছে, তুই রাজাকার। এত কিছুর পরেও তারা কী করে এ শহরে থাকে? তারা এখন কীভাবে জনগণের টাকায় বেতন পায়?

আমরা মনে করি এসব পুলিশ সদস্যকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে। এরপর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সেখানে তাদের অপরাধের বিচার হতে হবে। কিন্তু আমরা তার উল্টোটা দেখছি। - এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জুবায়েরুল আলম মানিক

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্দোলনের সমন্বয়ক ও এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জুবায়েরুল আলম মানিক বলেন, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা মনে করি তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা উচিত। এরপর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সেখানে তাদের অপরাধের বিচার হতে হবে। কিন্তু আমরা তার উল্টোটা দেখছি।

সিএমপি অপরাধীদের গ্রেফতারে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। জুলাই ব্যর্থ হলে জাতি ব্যর্থ হবে। যেসব পুলিশ অপরাধ করেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। - বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ

এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, সিএমপি অপরাধীদের গ্রেফতারে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। জুলাই ব্যর্থ হলে জাতি ব্যর্থ হবে। যেসব পুলিশ অপরাধ করেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। জুলাই গণহত্যার বিচারের আগে কোনো নির্বাচন আমরা চাই না।

এ বিষয়ে জানতে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। মোবাইলে এসএমএস দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সহযোগী পুলিশ সদস্যরা বহাল তবিয়তে

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) মো. হুমায়ুন কবিরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কল রিসিভ করেননি। মোবাইলে এসএমএস দিলেও সাড়া দেননি।

তবে নগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মাহমুদা বেগম বলেন, ‘আমরা অনেক অফিসারকে গ্রেফতার করেছি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এটি আমাদের চলমান প্রক্রিয়া।’

রফিক হায়দার/এমআরএম/এমএমএআর/জিকেএস

Read Entire Article