চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানজী পুকুরপাড় ভক্তদের সমাগমে উৎসবমুখর। আলোকসজ্জায় সেজে ওঠা প্রাঙ্গণে চলছে ভক্তি, প্রার্থনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) থেকে চার দিনব্যাপী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ১৩৮তম আবির্ভাব উৎসব শুরু হয়েছে। চলবে আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে আয়োজিত মাতৃসম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএনপি নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফা চৌধুরী মনি।
তিনি বলেন, যুগে যুগে আধ্যাত্মিক মানুষ জন্ম নেন যারা পুরো মানবকুলকে শিক্ষা দেন তাদের মতোই একজন মহান পুরুষ ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। নারীদের কল্যাণে কাজ করেছেন এবং সৎসঙ্গ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজকে শিক্ষা দিয়েছেন। সমাজ ও দেশের উন্নতির প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবারের শান্তি সংসার যদি শান্তি পায়, জাতিও সম্মান পায়।
মনি আরও বলেন, অনুকূল ঠাকুর সৎসঙ্গের চারটি অভিব্যক্তি ছিল— শিক্ষা, শিল্প, কৃষি ও সুবিবাহ। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ধর্ম-বর্ণভেদে বিভক্ত হয়ে নয়, সত্যিকারের একজন মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা বুঝতে হবে। তার ভাষায়, নারী দেবী-নারী দুর্গা, নারী সংস্কৃতি—নারীর সঙ্গে সম্মান করে চলতে হবে। একজন নারী সম্মান পেলে জাতিও সম্মান পায়।
বাস্তব জীবনের কষ্ট-সুখের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির এ নেত্রী বলেন, যদিও ভাষায় নারীদের উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়, বাস্তবে তারা পুরুষদের কাছ থেকে সমান সহায়তা ও সম্মান পান না। পুরুষদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা যদি আমাকে বোন মনে করেন, তাহলে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখবেন, সহকর্মী হিসেবে দেখবেন এবং স্ত্রী-বোন-মাকে সর্বোচ্চ শিক্ষা দেবেন।
সংসারকে ছোট একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করে নিলুফা চৌধুরী বলেন, যে মানুষের সংসারে শান্তি আছে, সে সমাজকে অনেক কিছু দিতে পারে। যার সংসারে শান্তি নেই, সে কিছুই দিতে পারে না।
নারীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নারীরা রাজনীতি ও চাকরিতে যে জায়গা পাওয়ার কথা, সেটি এখনো পুরোপুরি পাচ্ছেন না। একজন পুরুষ কাজ ইচ্ছামতো বেছে নিয়ে বাকিটা নারীর ওপর ছেড়ে দেয়; ডাক্তার, ব্যাংকার হিসেবে কর্মরত নারীও বাড়ির কাজে যুক্ত থাকেন। এজন্য সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
নারী নেতৃত্বের প্রসঙ্গে নিলুফা চৌধুরী মনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগের প্রশংসা করেন। সাবেক এ সংসদ সদস্য বলেন, খালেদা জিয়া বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা চালু করেছিলেন এবং নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়কে উন্নয়ন করেছিলেন। এজন্য তিনি দেশনেত্রীকে সম্মান জানাই। একই সঙ্গে তিনি জিয়াউর রহমানের অবদানও স্মরণ করেন।
নিজের জীবনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আজ আমি যে শিক্ষা পেয়েছি তা অনেকের ত্যাগ ও সহযোগিতার কারণে। নাহলে হয়তো বিয়ের পরই গৃহস্থ জীবনে থেমে যেতাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ঢাকসু) নির্বাচনে জগন্নাথ হলের সমর্থনের জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা জানান। পাশাপাশি চট্টগ্রামের সনাতনী সম্প্রদায়ের উদ্দেশে আহ্বান জানান, তারা যেন আগামীতে ধানের শীষে ভোট দেন, যাতে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার হাত আরও শক্তিশালী হয়।
বিএনপি নেত্রী বলেন, বাংলাদেশের গতি-প্রকৃতি অনিশ্চিত। তাই সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তিনি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সুন্দরভাবে দুর্গাপূজা উদযাপনের আশা প্রকাশ করেন।
চট্টগ্রাম জেলা সৎসঙ্গ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সুমন ঘোষ বাদশা কালবেলাকে বলেন, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ১৩৮তম আবির্ভাব উৎসব আমাদের কাছে বিশেষ কারণ তিনি কেবল আধ্যাত্মিক গুরু নন, সমাজসংস্কারকও ছিলেন। সৎসঙ্গ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি শিক্ষা, শিল্প, কৃষি ও সুবিবাহের মতো জীবনমুখী মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এবারের আয়োজনে নতুন সংযোজন হয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ মেলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। এতে ভক্তদের সন্তানরা ভক্তি-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
স্থানীয় সমাজে উৎসবের প্রভাব প্রসঙ্গে সুমন ঘোষ বাদশা বলেন, এ উৎসব মানুষকে শিখিয়েছে ভিন্ন ধর্ম-বর্ণে বিভক্ত না হয়ে ‘মানুষ’ পরিচয়ে দাঁড়াতে। এখানে যেমন হিন্দু ভক্ত এসেছেন, তেমনি ভিন্ন ধর্মের মানুষও আমাদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন। এটাই আমাদের প্রকৃত শক্তি।
নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। তাদের সহযোগিতায় আমরা শান্তিপূর্ণভাবে উৎসব উদযাপন করতে পারছি।
ভক্তদের ভিড়ে উৎসবমুখর : শনিবার দিনভর ভক্তদের সমাগমে প্রাঙ্গণ মুখর ছিল। সকাল থেকে ভোরের প্রার্থনা, উষাকীর্তন, ভজনকীর্তন, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও প্রসাদ বিতরণে ভক্তরা অংশ নেন। বিকেলে শিশু-কিশোর মেলা, গান ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গণ।
পাঁচ শতাধিক ভক্ত-শুভানুধ্যায়ী অংশ নেন এ আয়োজনে। ভিন্ন ধর্ম ও বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে উৎসব পায় এক অনন্য মাত্রা। নিরাপত্তায় পুলিশের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
মাতৃসম্মেলনে অতিথিরা : সম্মেলনের উদ্বোধন করেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মনিষা চক্রবর্তী। মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন করেন চট্টগ্রাম জেলা সৎসঙ্গের সহ-মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ইতু দাশগুপ্তা। মহান অতিথি ছিলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সুবর্ণা বিশ্বাস। প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শ্রীমতি অনিন্দিতা চক্রবর্তী। অতিথি আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন চিকিৎসক শ্রীমতি সোমা চৌধুরী ও শ্রীমতি পাপিয়া চক্রবর্তী।
সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম জেলা সৎসঙ্গের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা শ্রীমতি ঝিনু প্রভা দাশ (স্বস্ত্যয়নী)। সঞ্চালনায় ছিলেন শ্রীমতি নয়নমনি দাশ।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজীব ধর তমাল, শ্রীশ্রী জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব দে পার্থ।
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র : মানবসেবা ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক
সনাতন ধর্মীয় গুরু ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র (১৮৮৮-১৯৬৯) ছিলেন একজন প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক গুরু ও সমাজসংস্কারক। তিনি পাবনা জেলার হিমাইতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং সৎসঙ্গ নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। তার দর্শনে মানবসেবা, প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্য ও সংযুক্তির সহিত তদগতিসম্পন্ন যারা, তারাই সৎসঙ্গী। তার শিক্ষা, শিল্প, কৃষি ও সুবিবাহ এই চার স্তম্ভের মাধ্যমে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জীবন ও দর্শন আজও লাখো মানুষের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক।