গণপরিবহন নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। বার বার নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি আর উদ্যোগের কথা শোনা গেছে। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গণপরিবহনের শৃঙ্খলা আর কোনো দিন হবে, এমন আশা আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সড়কে যখন শিক্ষার্থীরা নেমে ট্রফিক নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলো তখন আমরা বেশ অবাক হয়ে দেখলাম সড়কের শৃঙ্খলা আসলে কেমন। বিশেষ করে রাজধানীর পথে চলতে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম বাসগুলোর স্টপেজ আসলে কোথায় কোথায়। ছাত্র-ছাত্রীদের হাতের ইশারায় যখন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেছিল তখন যাত্রীদের মনে আশা জেগেছিল। সারাদেশের মানুষ আশা করেছিল গণপরিবহনে সত্যিই শৃঙ্খলা ফিরছে। সেই আশায় এবার আলো জালাচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিপ্লবের ফসল বর্তমান সরকার।
বাসরুট রেশনালাইজেশনে আওতাধীন রুটগুলোতে বাস চলতে হলে ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় আসতে হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক ও বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম।
গত সোমবার (১১ নভেম্বর) ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নগর ভবনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ২৯তম সভা শেষে তিনি এ কথা বলেন। বলেছেন, রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়া নগর পরিবহন আবারও ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। আমরা রাজধানীতে গণপরিবহন পরিচালনার জন্য নগর পরিবহনের আওতায় আসতে আবেদন করার নির্দেশনা দিয়েছিলাম আগেই। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ৮০টি বাস কোম্পানি আবেদন করেছে। আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাস কোম্পানিগুলো আবেদন করতে পারবে।
শিক্ষার্থীদের বিপ্লবের ফসল বর্তমান সরকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সফল হবে, এমনটাই আশা সাধারণ যাত্রীদের।
তিনি আরও বলেন, আমরা ১০/১২ জন সদস্য মিলিয়ে একটি কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই কমিটি বিজনেস মডেল এবং বাসগুলো কীভাবে চলবে সেই বিষয়ে রূপরেখা তৈরি করবে। আমরা আগামী ১১ ডিসেম্বর আবার মিটিং করব। আমরা ঢাকার ৪২টি রুটের কোম্পানিগুলোর বাস নগর পরিবহন নামেই করব। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন যোগ্যতায় বিবেচনা করে নির্বাচন করা হবে।
এর আগে গত ২৮তম সভায় বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির পদাধিকার বলে সভাপতি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক জানিয়েছিলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতাধীন নগর পরিবহনের রুটে যদি কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা হয়, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে কমিটি।
রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীনে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি এর আগেও এ রুটে বাস চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। এবারও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা সার্ভিসটি চালু করতে পারে কি না, তা-ই দেখার বিষয়। এটি চালু হলে সাধারণ যাত্রীসহ সবাই অনেক উপকৃত হবেন।
তবে বাস রুট রেশনালাইজেশন চালু করতে হলে আগে রোড সার্ভেটা ভালোভাবে করতে হবে। বর্তমানে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো অপসারণ করে তবেই পথে নামতে হবে। একজন যাত্রী যেন বাসের জন্য অপেক্ষা করার পর সময়মতো তা পান, এটি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো বাস এ রুটে চলতে দেওয়া যাবে না।
সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ে বারবার আমরা বিভিন্ন প্রকল্পে হোঁচট খেয়েছি। শুল্ক প্রত্যাহার করে যখন ঢাকা শহরে ট্যাক্সি ক্যাব নামানো হলো তখনও অভিজ্ঞরা বলেছি, আমাদের আশপাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করে ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু তখন এ বিষয়ে নজর দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে অনেকটা ব্যর্থ হয় এ উদ্যোগ।
এখানেও যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে এ সেবা স্থায়ী হবে না। তাই সবদিক বিবেচনা করে বাস রুট রেশনালাইজেশনের বিষয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে নিতে হবে। এছাড়া যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো আগেই সমাধান করে নিতে হবে। এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা।
যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘সাধারণ নাগরিক পরিষদ’-এর আহ্বায়ক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় মোট ১২০টি নতুন বাস নিয়ে যাত্রা শুরুর বিষয়টি আসলেই প্রশংসার দাবিদার। এমন ঘোষণা এর আগেও আমরা শুনেছি। তবে বিভিন্ন কারণে এটি বাস্তবায়ন হয়নি। এবার ডিসেম্বরে চালু হওয়ার যে ঘোষণা এসেছে, আমরা আনন্দিত।
সেবাটি চালু হলেও যদি রাজধানীর যানজট নিরসনে আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে এটি খুব একটা কাজে আসবে না। তাই বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় এ রুটে নতুন পদ্ধতিতে বাস নামানোর পাশাপাশি রাজধানীর বাকি অংশের যানজটের দিকেও নজর দিতে হবে। পথের মোড়ে মোড়ে পুরাতন সিগনাল আবার চালু করা যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে। দেশের সবগুলো নগরীতে যানজট বড় সমস্যা। সবকিছুর সাথে যানজটের কারণ এবং প্রতিকার করতে হবে।
প্রায় তিন বছর আগে যাত্রা শুরু করা ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ ফের চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রাজধানীর যাত্রীবাহী সব বাস চলবে এই ‘ঢাকা নগর পরিবহনের’ আওতায়। এ খবরে যাত্রীরা উজ্জীবিত। তবে বাসের মালিকানা থাকবে কোম্পানিগুলোর কাছে। নগর পরিবহনের আওতায় বাস চালাতে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও নগর পরিবহনে নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা যাবে র্যাপিড পাস। আগের প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ বলছেন, তৎকালীন যারা ছিলেন, মালিক সমিতি বা এই প্রজেক্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের সবার সদিচ্ছার অভাবে সফল হয়নি এই প্রজেক্ট। তবে আশার খবর হলো, সরকার পরিবর্তন হওয়ায় আবার নড়েচড়ে বসেছে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ। বাস্তবসম্মত করা হচ্ছে বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পকে। প্রথম পর্যায়ের ব্যর্থতার পর নতুন সরকারের সময়ে বাস রুট রেশনালাইজেশনের সফলতা নিয়ে আশাবাদী ডিটিসিএ।
প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, ঢাকায় ৩৪টি ও শহরতলি পরিবহন নামে ঢাকার বাইরে আটটি রুটসহ মোট ৪২ রুটে চলবে বাস। এক রুটে একটি মাত্র কোম্পানির বাস চলবে। যেখানে সেখানে কেউ ওঠানামা করতে পারবে না। আমরা চেষ্টা করছি সবগুলো বাসে জিপিএস ট্র্যাকিং থাকবে। দেখা যায়, একই কোম্পানির বাস নিজেরাই প্রতিযোগিতা করে; অন্য কোম্পানি তো বাদই দিলাম। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা হবে না। পস মেশিন চলে এসেছে। যাত্রীরা ডিজিটালি টিকিট কাটবেন, কন্ডাকটরকে টিকিট দেখিয়ে উঠবেন, গন্তব্যে পৌঁছে টিকিট দেখিয়ে নেমে যাবেন। আগামী জুন থেকে মেট্রোরেলের মতো র্যাপিড পাস দিয়েও ব্যবহার করা যাবে এসব বাস। পর্যায়ক্রমে বসানো হবে ক্যামেরা।
শিক্ষার্থীদের বিপ্লবের ফসল বর্তমান সরকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সফল হবে, এমনটাই আশা সাধারণ যাত্রীদের।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এএসএম